দেশের ঈদ স্মৃতি

আমার বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব ছোট্ট একটা আবেগমাখা স্ট্যাটাস দিয়েছে, আমেরিকায় আসার আগে, ওর ছোট চাচা ওকে একটা ফতুয়া (যেটা সে নিজে পরতো) দিয়ে এসেছে। প্রথম দিন সেটা পরতে পারেনি (কারণ সে গায়েগতরে চাচার চেয়ে বড়) মনে হয়েছে এটা ফেটে যাবে। কিন্তু এই মায়ার জিনিস তো হাতছাড়া করা যাবে না। তাই সে রোজা রেখে এবং খাবার নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে এটা পরার যোগ্য করে তুলেছে। আমার ছোট ভাই, ছোট্ট মন্তব্য করেছে, ‘তোমাদের খুব মিস করি’। সে মাত্র মাস দেড়েক হয় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এসেছে। মন্তব্যটা পড়ে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম, মনে মনে বললাম, ‘ভাই, সবে তো শুরু, মিস করার দেখেছ কি?’ এটাই তো মায়া, এটাই পরিবার। পরিবারের কেউ কাউকে যদি মিস না করে, অনুভব না করে, তবে কে করবে?
সামনে ঈদ আসছে, আবেগঘন মুহূর্ত আরও আসবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক পদে গুরুদায়িত্ব পালন করা কামরান, আট ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। পারিবারিক গণ্ডিতে খুব নরম মনের। সময়ে আমি কিছু শক্ত হয়ে গেছি। কিন্তু নিমেষেই সব আবেগঘন স্মৃতি অ্যাটম বোমার মতো বিস্ফোরণ ঘটাল। অনেকের কাছে আবেগের দাম নেই কিন্তু এই আবেগ, মায়া-মমতা ভালোবাসার অনেক মূল্যবান। অনেক সময় এই একটু আবেগের জন্য ভুলে যেতে হয়, আমি কে? আবেগের জন্যই মানুষ আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। লেখা শেষ করার আগে একজনের দুঃখের উদাহরণটা দেব।
বিদেশের মাটিতে ২০১৪ সালে প্রথম রোজার মাস শুরু হলো। যদিও ঢাকায় আমি দীর্ঘ কয়েক বছর একাকী আবার দুজন—দুভাবেই কাটিয়েছি। সিলেটে ফিরে প্রায় ১০ বছর আবার সেই ভাই-বোনদের মধ্যে কেটেছে। ২০১৪ সালে প্রথম রোজার দিনই ইফতারি করতে বসে মেয়ে বলেছিল, ‘মাম্মি আজ আমরা দেশে থাকলে, সবাই একসঙ্গে মামার বাসায় ইফতার করতাম।’ আমি শুধু ‘হ্যাঁ’ বলেছি কিন্তু কথাটা যে কত তীব্রভাবে আমার ভেতর ছুঁয়ে গেছে! কষ্ট হলেও আবেগ চেপে ইফতার করলাম। আমি চাই না, মেয়েরও মন খারাপ হোক। আব্বা-আম্মা নেই দীর্ঘ ২২/২৩ বছর। রসুনের মতো সব আচার-অনুষ্ঠানে, আনন্দ-বেদনায় আমরা ভাইবোন শক্ত করে আঁকড়ে থাকি পরস্পরকে—এটাই আমাদের জীবনে একমাত্র প্রাপ্তি। সবাই মিলে প্রথম দিন ভাইয়ের বাসায় একসঙ্গে ইফতার করি। সেদিন, আমি জিলাপি বক্স নিয়েও ভুল করে রেখে এসেছি প্রিমিয়ামে। ঈশায়া যোগ করল, ‘মাম্মি জিলাপি আননি? আমার খুবই ফেবারিট রোজার মাসে।’ সে কোনো মিষ্টি জাতীয় খাবার খায় না। ভাগ্যিস সেদিন আমাদের বাড়ির মালিক ইফতারি পাঠিয়েছিলেন। আমি খুলে ২ পিস জিলাপি পেলাম, নতুবা আমার আরও বেশি কষ্ট হতো। এই মেয়ে এখন এসব খাবার ভুলে যাচ্ছে। আমারও একা একা ইফতার খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। মেয়ে সঙ্গ দেয় তবে সে এখন চিজ, চিকেন বা স্বাভাবিক ভাত মাছ, গোশত খাবে। আমাদের গতানুগতিক ইফতারি খায় না। জিলাপিও না সব সময়। এটা শুধু আমার নয়, বিদেশে বড় হওয়া সব বাচ্চারাই এমন হচ্ছে। যাই হোক, প্রতি সপ্তাহে আমরা ভাইবোন একেক বাসায় একত্র হতাম। রীতিমতো পার্টি হয়ে যেতো।
আর ঈদের বাজারের যে আমেজ তাতো সবাই জানেন।
রোজার শুরুতে চাঁদনীচক থেকে আমি মেয়ের জন্য সবচেয়ে সুন্দর গজ কাপড় কিনতাম। ডিজাইন নিজে করে দিতাম। রাজশ্রীর দাদা ওর লেহেঙ্গা বা আনারকলি ড্রেস খুবই সুন্দর করে বানিয়ে দিতেন। ঢাকা সিলেট সব জায়গায় পরিচিত-অপরিচিতরা জিজ্ঞেস করতেন, কোথা থেকে কিনেছি। অনেক ভাবিই বলতেন, ‘আমরাও তো তাঁকে দিয়ে বানালাম, কই এত সুন্দরতো হয় না?’ এটা ঠিক দাদা ওর কাপড়গুলো যত্ন নিয়ে বানাতেন। ফেন্সি পোশাকের সঙ্গে দৈনন্দিন কিছু কিনতে হতো। গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের আউটফিট খুব পছন্দের ছিল, বেশির ভাগ প্যান্ট, টি শার্ট ওখান থেকে কেনা। মামা-খালাদের কাছ থেকে সিলেটের পাওনা পূর্ণ হতো। আড়ং-এ গিয়ে কোনো থ্রি পিস পছন্দ হলে ঈশায়ার জন্য আমি কিনে নিতাম। সে এই অপশনাল থ্রি-পিসগুলো পরে ইফতার-পার্টিতে যেত। যদিও তার কাপড়ের প্রতি আগ্রহ কম। আমি প্রচুর আগ্রহ নিয়ে পরাতাম, সে বিরক্ত হতো, ছোট ছোট থ্রিপিসে ওকে অপূর্ব লাগত। মা হিসেবে মুগ্ধ হতাম, গর্ববোধ করতাম আল্লাহ এত সুন্দর একটা মেয়ে দিয়েছেন, যা-ই পরতো পুতুল মনে হতো।
বোনের মেয়ে, ভাইপো, ভাতিজি—সবাই আমার পছন্দের ভক্ত। আমাকে নিয়ে মার্কেটে না গেলে মন ভরে না। সে অছিলায় আমিও প্রতিদিনই একবার ঢুঁ মারতাম সিলেটের ঈদ মার্কেটে। আমার তো প্যাঁচার স্বভাব, কেন জানি দিনে বের হতে ইচ্ছে হয় না। রোজা রেখে তো অসম্ভব ব্যাপার। তাই পনেরো রোজার পর থেকে বেশির ভাগ রাতেই নামাজ শেষ করে কফি খেয়ে দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। রাতে বের হওয়ার জন্য সবক যে শুনিনি, তা কিন্তু না। মেঘ-বৃষ্টির কবলে পড়ে গেলে বা বেশি দেরি হলে শুধু আমার ভাই কামরানকে ফোন দিতাম। বড় ভাইয়ের ছেলে, সজীব, সৌরভের কাপড় কেনার ভার আমার ওপর পড়ত। ওরা বড় হওয়াতে আমি বেঁচে গেছি। তাও ওদের আলাদা করতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। ওদের সঙ্গে আমার বড় ভাইও একটু অভিমান নিয়ে থাকতেন, তাঁর ছেলেদের সময় দেওয়া হচ্ছে না।
সন্ধ্যার পর মেয়ে তৈরি কেনাকাটা করতে যাবে। তার প্রধান আকর্ষণ ছিল আড়ং-এর বইয়ে, আর জুতা কেনার প্রতি। সে কোনো দিন কোনো খেলনা কিনতে চায়নি। তার জুতার প্রতি আগ্রহ, আমার পাশাপাশি কামরানও কিনে দিত। সে মহাআনন্দে পায়ের জুতা ব্যাগে রেখে নতুনটা পরা শুরু করত। আড়ং-এ যাওয়ার জন্য সে বেশি উৎসাহ জাগাতো, কারণ সে বই পড়বে। ছোট ছোট ৪/৫টি বই সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিনে পয়সায় পড়ে ফেলতো। হাতে থাকত আরও কয়েকটা। সে কিছু কৌতুকের বই এখানেও নিয়ে এসেছে। হাসতে হাসতে পেটে খিল, নাসিরউদ্দিন হোজ্জা, গোপাল ভাঁড়ের হাসির গল্প, কৌতুক ওর মুখস্থ।
সে বছর মেজ বোনের মেয়ে নোহা, বলল, ‘আন্টি তুমি নাই মার্কেটে ভালোমতো যাওয়া হয় না। খুবই মিস করছি তোমারে।’ আমি তখন কাজে ছিলাম না, মেয়ে স্কুলে চলে গেলে বা ঘুমিয়ে পড়লে শুধু চোখ মুছতে থাকতাম। নিজের হাতের রান্না করা খাবার ভালো লাগত না। মুন্নিকে মিস করতাম। এটা আমার না শুধু, বিদেশে পাড়ি জমানো প্রতিটা মানুষের কাহিনি। যা বলতে চাচ্ছিলাম, প্রথম দু’বছরই, সন্ধ্যার পর হলেই সিলেটের মার্কেট মিস করতাম। খুব জানতে ইচ্ছে করত, কে কি পোশাক কিনল। মাঝে মাঝে মন খারাপ একটা ভাব হতো, ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতাম। এখানে অনেক মার্কেট, সারা রাত খোলা তবে সেখানে দেশের ঈদ মার্কেটের আমেজ নাই। জ্যাকসন হাইট্‌সে আছে, আলহামরা টাইপ মার্কেট। মেয়েকে অনেক সময় যাওয়ার কথা বলতাম, তারা কোনো উৎসাহ নাই। সে হলো যখন যে টাইপ, সে টাইপের মেয়ে। আমি গ্রীষ্মের কিছু কাপড় কিনে দিয়েছিলাম। একটা অভারওলস পরা হয় নাই, সে বলেছে এটি পরে সে ঈদ করে ফেলবে, সমস্যা না। সময়ের সঙ্গে তার মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা দেখে আমার খুবই ভালো লাগে।
ঈদের দিনটাও জমে উঠত এভাবে। কিন্তু বিদেশে ঈদের দিনও অনেকের কাজ থাকে, সত্যিকারের সে আমেজ তো বিগত কোনো ঈদেই পাইনি। বছর কয়েক আগে আমার খালাতো ভাই কয়েক বছর ইংল্যান্ডে গেল। ঈদের দিন সে ফোন দিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কিরে ঈদ কেমন কাটল?’
সে আমাকে সংক্ষেপে সুন্দর করে বোঝাল, ‘আপা শোনো, আমাদের দেশে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানরা আছেন না?’ আমি বললাম , ‘হ্যাঁ’
‘তুমি কি বুঝতে পারো ওরা উৎসব পালন করছেন?’ ‘না’। ‘আমরাও এখানে এ রকমই ঈদ করছি।’
সেদিন তার কথাটা গুরুত্ব দিয়ে না বুঝলেও এখন খুব উপলব্ধি করছি। দার্শনিক কথা শুনে হেসেছিলাম। এখনো ঈদের সময় আছে, কিন্তু এসব ভাবলে মনটা সত্যি দেশে চলে যায়। সবাই মিলেমিশে ঈদ করা যে কী আনন্দের! পারিবারিক এই মিলনমেলার মূল্য অনেক বেশি। পরিস্থিতিতে পড়ে ছড়িয়ে পড়েছি লন্ডন, আমেরিকায়। কিন্তু মনটা পড়ে থাকে এক জায়গায়। এটাই হচ্ছে জগৎ সংসারের মায়া, অনেক মূল্যবান এই আবেগ।
শুরুতে একটা দুঃখের কাহিনির বলব বলেছিলাম, কারণ স্বামী-স্ত্রী-সন্তান-সংসার থাকার পরও মানুষ শূন্যতা বোধ করে। কিছুদিন আগে প্রিয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, এক বড় ভাই ছাড়া কোনো ভাইবোনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। অনেক কষ্ট ভরা লেখা। এ রকম সাধারণ মানুষরাও লেখেন। বোন দেখতে পারে না। আমিতো বিশ্বাস করতে পারি না। কেন লেখেন তারা? এই একটু মায়ার অভাবে।
সবশেষে বলতে চাই, এই আবেগ মায়া-মমতা ধরে রাখার চেষ্টা করুন। আমি গর্ব করে এটুকু বলতে পারি, অন্তত মরার আগে হাসিমুখে আনন্দ নিয়ে মরতে পারব, আমরা ভাইবোন সব সময় সবার জন্য ছিলাম, আছি, থাকব। এটা অনেক আনন্দের বন্ধন, সব নিয়েই তো মায়ার জগৎ।