পৌনঃপুনিক

ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে রোদের প্রখর ছটায় অন্ধ হয়ে গেল আরেফিন। অশ্রুতে এমনিতেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছিল, এখন তা পুরোপুরি আঁধার হয়ে গেল। জামার হাতায় ভালো করে চোখ মুছে আরেফিন বন্ধ চোখ ধীরে ধীরে খুলল। আর তখনই দমকা বাতাসের সাথে ঘন কালো মেঘ উড়ে এসে ঢেকে ফেলল সূর্য। রোদের চোখধাঁধানো দীপ্তি ম্লান হয়ে এলে আশপাশের দৃশ্য পরিষ্কার হয়ে এল ক্রমশ। আরেফিন দেখল, কাছের কংক্রিটের ফলকের ওপর বসে আছে এক দম্পতি। ধ্যানমগ্ন, গম্ভীর, বিষণ্নভাবেœদূরের দিকে দৃষ্টি মেলে আছে। দৃষ্টি কোনো কিছুর ওপর কেন্দ্রীভূত নয়, বরং তাদের চোখের সামনে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কল্পচিত্র। আরেফিন এগিয়ে গেল তাদের দিকে। লোকটি হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের আকাঙ্ক্ষায়।

ইউরোপে নিহত ইহুদিদের স্মৃতিসৌধ। শহর থেকে দূরে কোথাও নয়। একদম বার্লিন শহরের কেন্দ্রে। প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে মাটির ওপর সারবেঁধে ছড়িয়ে আছে নানা উচ্চতার ২ হাজার ৭১১টি কংক্রিটের ফলক। একেকটি ফলক লম্বায় ৭ ফুট, চওড়ায় ৩ ফুট আর উচ্চতায় ৮ ইঞ্চি থেকে সাড়ে ১৫ ফুট অবধি। আড়াআড়ি নকশায় ঢালু জমির ওপর সাজানো ফলকগুলোর মাঝখানে দুজন পাশাপাশি দাঁড়ানোর মতো প্রশস্ত জায়গা। গোলকধাঁধার মতো এই পরিসরে লুকোচুরি খেলছে অনেকে। কিছু কিশোর-কিশোরী প্রাণচাঞ্চল্যে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে এক ফলক থেকে অন্য ফলকে। আবার এই দম্পতির মতো কয়েকজন চুপ করে বসে আছে ফলকের ওপরে।

বেশি বয়স নয় এই সৌধের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬০ বছর পর স্থপতি পিটার আইসেনম্যানের নকশায় তৈরি এই সৌধ এখনো খুব বেশি পরিচিতি পায়নি। অফিসের কাজে আরেফিন বার্লিনে যাবে শুনে ওর জার্মান প্রতিবেশী ডেড্রিক বারবার করে বলেছিল সৌধটি দেখার জন্য। এখানে এসে মনে মনে ডেড্রিককে ধন্যবাদ জানাল আরেফিন। রাজধানীর কেন্দ্রে ব্যস্ত সড়কগুলোর মাঝে গাঢ় ধূসর এই ফলকগুলো বিষণ্ণতা ওœগাম্ভীর্য তৈরি করে রেখেছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে অতীত এই ইতিহাসের মাঝে কোনো আলো নেই, রং নেই, হাসি নেই। শুধুই অন্তহীন বিষাদ আর হাহাকার এখানে। স্থপতির বোধ আর চিন্তাশৈলী ইতিহাসকে যথার্থভাবে উপস্থাপন করে হৃদয় স্পর্শ করে যাচ্ছে। একেকটি ফলক ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একেকটি বন্দিশিবিরের প্রতীক। প্রতিটি বন্দিশিবিরে নিহত ইহুদিদের সংখ্যা নির্ধারণ করছে ফলকের উচ্চতা। সিঁড়ি বেয়ে মাটির নিচে তথ্যকেন্দ্র। নাৎসিদের উত্থানের মধ্য দিয়ে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যার মাতনের ইতিহাস ধারণ করে আছে দুপাশের দেয়াল। এতই করুণ, এতই কর্কশ, এতই ভয়ানক এই ইতিহাস যে চৌদ্দ বছরের নিচে কোনো শিশুর এখানে একা প্রবেশ নিষেধ। ভেতরের প্রায়ান্ধকার একটি ঘরে মেঝের ওপর নরম সাদা আলোর প্রেক্ষাপটে সাজানো বন্দিশিবিরগামী ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলা পিতার বিদায়ী চিঠি, সন্ত্রস্ত কিশোরীর লুকানো ডায়েরির পাতা, মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে নীল কালিতে লেখা কিশোরের আশাবাদী কবিতা। পড়তে পড়তে চোখ বাষ্পায়িত হয়ে আসছিল আরেফিনের। একটি ঘরে নরম গম্ভীর সৌম্য কণ্ঠে অন্তহীন উচ্চারিত হচ্ছে নিহত ইহুদিদের নাম। ধর্মগ্রন্থের স্তোত্র উচ্চারণের মতো এই গুঞ্জন আরেফিনকে অশরীরী শীতলতায় আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।

লোকটা আরেফিনের হাতে হাত মিলিয়ে বলল, ‘তুমি কাঁদছ নাকি?’ একটু যেন শ্লেষের ছোঁয়াচ আছে লোকটার কণ্ঠে। ‘এই ভয়াবহ ইতিহাস পড়লে চোখে তো জল আসবেই। আমার জন্ম বাংলাদেশে। বাঙালি হওয়ার জন্য, বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য পাকিস্তানিরা ৩০ লাখ লোক হত্যা করেছে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়। আমাদের শ্রেষ্ঠ মেধাকে বাড়ি থেকে হেঁচড়ে টেনে এনে বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছে। আমি নিজে হারিয়েছি বড় ভাইকে। সেই সব স্মৃতি মনে পড়ে গেল আবার।’ আরেফিনের গলা ধরে আসে।

আরেফিনের কথা শুনে মেয়েটি আলতো করে হাত রাখে আরেফিনের হাতের ওপর। যেন বলতে চায়, তুমি একা নও। আমরা আছি তোমার সাথে। সমব্যথী। সহানুভূতি নিয়ে।

আরেফিন ভালো করে তাকিয়ে দেখে এই দম্পতিকে। বয়সের ছাপ আঁচড় ফেলতে শুরু করেছে মুখমণ্ডলে। লোকটির কানের পাশের চুলে সাদা ছোপ পড়েছে। মেয়েটির ছড়ানো চুলে ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রুপালি তন্তু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পূর্বপুরুষকে হয়তো হারিয়েছে তারা আর সেই স্মৃতি বিষাদে আবিষ্ট করেছে তাদের।

‘আমার নাম আরেফিন। এখন আমেরিকায় থাকি আমি।’ নিজের পরিচয় দিয়ে দম্পতির সাথে আলাপচারিতায় প্রয়াসী হয় আরেফিন।

‘আমি ম্যানফ্রেড আর ও ডেবরা।’ লোকটা বলে আর পরক্ষণেই শ্লেষমাখা মুচকি হাসি হেসে বলে, ‘তুমি আমেরিকায় থাক!’ যেন আমেরিকায় থাকা তামাশার বিষয়।

‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে নিশ্চয়ই গিয়েছিলে আমেরিকায়? কেমন লাগছে চোখের সামনে সেই স্বপ্নগুলোর মৃত্যু দেখতে?’ আরেফিন কিছু বলার আগে ডেবরা কঠিন গলায় যোগ করে।

‘সামনে কোনো আলো দেখতে পাই না। যত দিন যায়, অন্ধকার আরও ঘনীভূত হতে থাকে। এই একবিংশ শতাব্দীতে তিরিশের দশকের নাৎসি শাসন যেন আরোপিত হতে যাচ্ছে আমেরিকায়।’ আরেফিন ম্লান কণ্ঠে বলে।

‘এভাবেই কিন্তু শুরু হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মৌলিক না পাওয়াকে সোপান করে ক্ষমতায় আসে একনায়ক, তার সাথে চাটুকার। আর ক্ষমতায় এসেই শুরু হয় সংখ্যালঘুদের প্রান্তিকীকরণ। তৈরি হয় পদে পদে বাধা। কেউ শান্তিতে নেই তোমার দেশে। সাদা ত্বক আর খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী না হলেই বিপদ। তুমি ফিরতে পারবে তো? বিমানবন্দরে তোমাকে আটকে দেবে না তো?’ ম্যানফ্রেডের কণ্ঠ ঝাঁজালো হয়ে ওঠে।

‘আমি নাগরিক হয়েছি অনেক দিন। পাসপোর্টে পৃথিবী ভ্রমণের ছাপ আছে অনেক। তাই আশা করছি কোনো ঝামেলা হবে না। কিন্তু কী হয় কে বলতে পারে? নাৎসিদের হাত থেকে জার্মানির নাগরিক সমাজের উঁচুতলার ধনী ইহুদিরাও তো রক্ষা পায়নি। জঙ্গি, নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক আখ্যা দিয়ে যেকোনো সময় আমার হাতে হাতকড়া পরাতে পারে। আগে অন্তত এটুকু আশা ছিল যে আমেরিকায় আইনের শাসন আছে। কিন্তু এখন যেভাবে নগ্ন ভাষায় বিচারকদের সমালোচনা চলছে, তাতে আইনের সুস্থ প্রয়োগ আর কত দিন হবে সেটাই ভাবনার বিষয়।’ আরেফিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।

‘তাহলে ফিরে যাও না কেন বাংলাদেশে?’ ডেবরা জিজ্ঞেস করে।

‘কোথায় ফিরব বল? ২৪ বছর বয়সে দেশ ছেড়েছি। আমেরিকায় আছি গত ২৫ বছর। জন্মভূমিতে জীবনের যত দিন ছিলাম, তার চেয়ে বেশি আছি আমেরিকায়। বাংলাদেশের পাসপোর্ট কবে হারিয়ে গেছে! এখন আমেরিকাই তো আমার দেশ। আমার সন্তানের জন্মস্থান। আমার স্থায়ী ঠিকানা।’ আরেফিন বলে, তারপর যোগ করে, ‘থাক আমার কথা। যত বলব, তত মন খারাপ হবে। বরং তোমাদের কথা বল। কোথায় থাক তোমরা?’

‘আমরা থাকি দূরে। পোল্যান্ডের সীমানার কাছে ছোট এক গ্রামে। মুদিদোকান চালাই আমরা। আচ্ছা, তোমার ধর্ম কী? কোথায় প্রার্থনা কর তুমি?’ ডেবরা জিজ্ঞেস করে আগ্রহ নিয়ে।

‘আমি মুসলিম। আমার বাড়ির কাছে মসজিদ আছে।’ আরেফিন বলে।

‘তোমার ভয় করে না যেতে?’ জিজ্ঞেস করে ম্যানফ্রেড।

‘একটু ভয় তো করেই। মসজিদের দরজায় সোয়াস্তিকা চিহ্ন, কে যেন এঁকে দিয়ে গেছে কিছুদিন আগে। উটকো ফোন করে বোমা হামলার ভয় দেখিয়েছে। মাঝে মাঝে নামাজ শেষ করে বের হয়ে দেখি উল্টো দিকে মোটরসাইকেলে দুজন লোক বসে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। হেলমেটে ঢাকা ওদের মুখ। পরনে গাঢ় কালো পোশাক। চিনতে পারি না। আমরা এগিয়ে গেলে এক টান দিয়ে বের হয়ে যায়। কী যে কুমতলব আছে কে জানে! আগে মসজিদের ইমাম রাতে থাকতেন। এখন আর থাকেন না। কখন কে রাতের আঁধারে এসে আগুন লাগিয়ে যায় কে বলতে পারে? এখন আর তো কোনো লুকোছাপা নেই। সরকারি রাবার স্ট্যাম্প নিয়ে সাদাদের কৌলিন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এখন আমাদের নিয়ে যে কেউ যেকোনো কিছু করতে পারে।’ আরেফিনের কণ্ঠ স্তিমিত হয়ে আসে।

‘আমাদের বাড়ির কাছে একটা সিনাগগ আছে। শনিবার সকালে প্রার্থনায় বসেছিলাম আমরা। গোটা পনেরো পরিবার। অনিশ্চয়তা আর সংশয়ে দুরু দুরু মন নিয়ে। এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রামে কিছু হয়নি। কিন্তু বাতাসে ভেসে আসা অসংখ্য ঘটনার বিবরণে উৎকণ্ঠিত হয়ে ছিলাম। হঠাৎ বাইরে একটা ট্রাক থামার শব্দ আর তার সঙ্গে ভারী বুটের আস্ফালনে মাটি কেঁপে ওঠায় চমকে উঠলাম আমরা। আমাদের কোনো সুযোগ দিল না। একটা কথাও বলতে দিল না। এক কাপড়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুঁতিয়ে ওঠাল ট্রাকে। সেই শেষ যাওয়া। আর ফেরা হয়নি। প্রার্থনা করি, তোমাদের অবস্থা যেন সে রকম না হয়।’ বলতে বলতে স্কার্টের কোনায় চোখ মোছে ডেবরা।

আরেফিন চমকে ওঠে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে দম্পতির মুখ। খুব চেনা যেন। নিচের তথ্যকেন্দ্রে একটা ছবি ছিল না? ম্যানফ্রেড আর ডেবরা ব্র্যান্ডসডরফার। পোল্যান্ডের ক্র্যাকো বন্দিশিবিরে নথিভুক্ত জার্মান ইহুদি দম্পতি। এরা এখানে এল কীভাবে? আরেফিন বুঝে ওঠার আগেই   দমকা বাতাস মেঘ উড়িয়ে নিয়ে সোনালি রোদে ঝলমলে করে তুলল চারদিক।   আলোর ছটায় ম্যানফ্রেড আর ডেবরা ফুৎকারে হারিয়ে গেল আরেফিনের চেতনার পরিধি থেকে।