একটি অন্যরকম ঈদের স্মৃতি

আমরা ভাইবোনেরা প্রতি ঈদেই একটা করে সুন্দর জামা উপহার পেতাম। আমাদের ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার। যখন-তখন কোনো রকম উৎসব ছাড়া আমাদের জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমার বাবার ছিল না। বাবা ছিলেন বাংলাদেশের মফস্বল শহরের একটি কলেজের শিক্ষক। কলেজের বেতন ছিল খুব সামান্য। গ্রামের বাড়ি থেকে চাল-ডাল আসত। তাতেই হয়তো সংসার রক্ষা পেয়েছিল। তারপরও আমাদের সন্তানদের গায়ে কোনোরকম অভাবের আঁচড় যাতে না লাগে, সে জন্যে আমার মা-বাবা দুজনই খুব সজাগ ছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই তাঁরা ঈদে অথবা জন্মদিনে একটা নতুন কিছু কিনে দিতেন। বছরে দুটো কি তিনটে জামা অথবা দুটো প্যান্ট, এই নিয়েই আমি ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। তবে কেন জানি জামা কাপড়ের জন্য কখনোই মনে কোনো দুঃখ হতো না। একটু বড় হয়ে যখন বুঝতে পারলাম আমরা গরিব নই, আবার বৈভবও আমাদের নেই, তখন থেকেই খুব সাবধানে হিসাব করে চলতে শুরু করি। আব্বার ওপর যেন কোনো রকম অর্থনৈতিক চাপ না পড়ে, সে দিকে আমি খুব সজাগ ছিলাম। তাই কোনো বায়না ধরাতো দূরের কথা, আমার এটা লাগবে, ওটা লাগবে —এই সব বলে বাবা-মাকে কখনোই বিব্রত করতাম না। কিন্তু ছেলেবেলার একটা ঘটনা মনে হলে এখনো খুব বিব্রত বোধ করি। সত্যি; লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। একটা ঈদকে কেন্দ্র করেই সেই ঘটনা, যা এখনো বিব্রত করে আমাকে।
আমার ছোট বোনের নাম তুলি। আমরা দুজনই পিঠাপিঠি। ঈদ সমাগত। তখন সম্ভবত ক্লাস সেভেনে পড়ি। আব্বা আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে গেলেন স্থানীয় একটা পরিচিত কাপড়ের দোকান ‘সাদেক টেইলার্স’-এ। কাপড়ের দোকানের মালিকের নাম মোহাম্মদ সাদেক। আমাদের গ্রামের লোক। আব্বাকে খুব মান্য করেন এবং তাঁর ভক্তও। আমরা তাঁকে ডাকি সাদেক চাচা বলে। দোকানে ঢুকতে ঢুকতেই আব্বা হাঁক দিলেন, ‘ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছি সাদেক। ছেলেটার জন্য একটা শার্ট, আর মেয়েটার জন্য একটা ভালো জামা দেখাও দেখি।’ সাদেক চাচা সস্নেহে তিন-পাওয়ালা দুটো টুল আমাদের দুজনের দিকে এগিয়ে দিলেন। আব্বাকে সম্মান জানিয়ে একটা কাঠের চেয়ারে বসতে দিলেন। এদিকে সাদেক চাচা তাঁর ছোট দোকানের আলমারিতে সাজিয়ে রাখা সংগ্রহ থেকে এটা দেখায়, ওটা দেখায়; কিন্তু আমার কোনোটাই পছন্দ হয় না। এবার আব্বা মুখ খুললেন, ‘কিরে বাবা, তোর বুঝি কোনো শার্টই পছন্দ হচ্ছে না?’ আমি চুপ করে থাকলাম।
অন্য শার্ট পছন্দ হবে কীভাবে? আমার নাকের ডগার ঠিক সামনেই ঝুলছিল অসাধারণ একটা শার্ট। এখনো মনে আছে শার্টের রংটা ছিল হালকা আকাশি। আর বুকের মাঝে কালো একটা স্ট্রাইপ। সেখানে ছোট করে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘ডিসকো’। সম্ভবত ডিসকো শার্ট তখন নতুন বাজারে এসেছে। খুব জনপ্রিয়। আমার কী হলো জানি না শার্টের দিকে লোভনীয় দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়েই থাকলাম। আব্বার আবার প্রশ্ন, ‘কিরে তোর কি এই শার্টটা পছন্দ হয়েছে?’ আমি এবারও চুপ। শুধু মাথা নিচু করে বার দু-এক মাথা ঝাঁকালাম। এবার আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ‘এত লজ্জা কিসের? তুই এটা বলবি না?’, বলেই সাদেক চাচাকে বললেন, ‘সাদেক, দেখো তো ওর গায়ের মাপের এই ধরনের কোনো শার্ট আছে কিনা?’ সাদেক চাচা সাদা প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়ানো একটা প্যাকেট আব্বার সামনে এনে ধরলেন। ‘স্যার, আছে। এই যে, দ্যাখেন।’ আব্বাকে তখন খুব আনন্দিত দেখাচ্ছিল।
এবার মূল্য জিজ্ঞাসা করতেই সাদেক চাচা কাঁচুমাচু হয়ে আব্বাকে কী যেন ফিসফিস করে বললেন। আমি বুঝতে পারলাম শার্টের মূল্য অনেক বেশি। অন্তত আব্বার যে বাজেট ছিল, তা অতিক্রম করেছে। আব্বার মুখেও সেই আগের হাসিটা আর দেখতে পেলাম না। আমি এবার আব্বাকে বললাম, ‘না, আমি এটা নেব না, আমি আগের শার্টটাই নিব। এটা আমার পছন্দ না।’ আব্বা এবারও আমার দিকে হাসিমাখা মুখে তাকালেন। ‘কিরে? ঈদ কি বারবার আসবে বোকা ছেলে? বছরে মাত্র দুইটা ঈদ। যেটা তোর পছন্দ হয়েছে, তুই সেটাই কিনবি। ঠিক আছে?’
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম এই শার্টের মূল্য আগেরটার চেয়ে অন্তত তিনগুণ। এসব ভেবে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল, আবার অন্যদিকে ভেতরে-ভেতরে একটা আনন্দও পাচ্ছিলাম। স্কুলে এই শার্টটা পরে গেলে ভাবই অন্যরকম হবে। এবার কাপড়ের মূল্য পরিশোধ করার সময় এল। আমাদের ঈদের কেনাকাটায় আমার জন্য ডিসকো শার্ট, বোন তুলির জন্য সালোয়ার-কামিজ, আম্মার জন্য একটা শাড়ি, আর আব্বার জন্যও একটা নীল রং এর শার্ট। কিন্তু একী! আব্বা সাদেক চাচাকে বললেন, ‘সাদেক আমার শার্টটা না হয় দিয়ো না। ওটা তুলে রাখ। তার পরিবর্তে আমি না হয় পরে এক সময় এসে তোমার কাছ থেকে কিছু গজ কাপড় কিনে নিয়ে যাব। আমি তো এখন মাপজোখ কিছু বলতে পারব না, ওর মার কাছ থেকে জেনে এসে পরে আবার আসব।’ সাদেক চাচা আব্বার দিকে চেয়ে মুখটা নিচু করে শুধু বললেন, ‘জি স্যার, তাই হবে।’
ঈদের কাপড় নিয়ে ঘরে ঢুকতেই আরেক দফা আনন্দ বন্যা শুরু হয়ে গেল। আম্মা প্যাকেট থেকে একে একে সবার কাপড় খুললেন এবং মন্তব্যও করলেন। নিজের শাড়িটা বুকে জড়িয়ে এর প্রশংসায় মেতে উঠলেন। কিন্তু ব্যাগে আব্বার কোনো শার্ট না পেয়ে আম্মার চোখে বিস্ময়! ‘তোমার শার্ট কোথায়, শার্ট কিন নাই?’ এবার আব্বা মাথা নিচু করে জবাব দিলেন, ‘প্রতি বছরই ঈদে তো শার্ট কিনি, এবার ভাবছি শার্ট কিনব না। বরং গজ কাপড় কিনে নিয়ে আসব, তুমি সেটা দিয়ে ভালো একটা শার্ট বানিয়ে দেবে। তোমার তো সেলাইয়ের হাত ভালো। এবার ঈদে তোমার বানিয়ে দেওয়া শার্টই পরব।’ আম্মা সম্ভবত আব্বার কথাটার গভীর মানে ঠিক আঁচ করতে পেরেছিলেন। ‘তাহলে আমার জন্যই বা শুধু শুধু শাড়ি কিনতে হলো কেন? পরেওতো কিনতে পারতে?’ আম্মা আর আব্বা দুজন কথা বলছিলেন; কিন্তু এদিকে আমাদের ঘরে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দুই ভাইবোন, আমাদের সদ্য কেনা ঈদের কাপড়গুলোর কখনো ঘ্রাণ নেই, কখনো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, কখনোবা কিছুক্ষণ গায়ে পরে থাকি। আবার কাপড়গুলো খুব সাবধানে লুকিয়েও ফেলি। ঈদের আগে আমাদের ঈদের কাপড় যদি আবার কেউ দেখে ফেলে!
পরদিনই দেখি আব্বা শার্টের মাপ অনুযায়ী একটি হালকা নীল টেট্রনের কাপড় কিনে নিয়ে আসলেন। গজ কাপড়টি কিনে নিয়ে আসায় নিশ্চয়ই রেডিমেইড শার্ট থেকে কিছুটা টাকা সাশ্রয় হয়েছিল! আম্মা তার সন্তানতুল্য সিঙ্গার মেশিন দিয়ে আব্বার জন্য শার্ট বানাতে মেশিনের হাতল ঘুরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সেই ঈদটি ছিল আমার জন্য খুব আনন্দের আবার খুব বেদনারও। প্রতি বছর যখন ঈদ আসে তখন আব্বার চশমার আড়ালে সেই ভালোবাসা মাখা দুটো চোখ, মায়া জড়ানো সেই ভরাট কণ্ঠ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।