বিবেক নাড়িয়ে দেওয়ার মতো বই 'দ্য ব্যালাড অব আয়েশা'

জনপ্রিয় লেখক, কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার আনিসুল হকের আয়েশা মঙ্গল উপন্যাসটির ইংরেজি সংস্করণ দ্য ব্যালাড অব আয়েশা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এতে করে উপন্যাসটি নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। বইটি পড়ার জন্য ভীষণ কৌতূহল বোধ করছিলাম। দেশ থেকে আনানো বইয়ের বাংলা সংস্করণটি একটানে পড়ার পর থেকে কেমন একটা স্থবিরতা কাজ করছে। একটি চিন্তাই কেবল বারবার মনে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরছে। একজন খুনের আসামিরও নিজের পক্ষ নিয়ে লড়ার অধিকার থাকে। জীবন ভিক্ষা চাওয়ার অধিকার থাকে। কিন্তু এ কেমন বিচারবহির্ভূত দণ্ডাদেশ। কোন মনুষ্যত্বহীন, বিবেকহীন, বিচারহীন সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বাস করছি। একজন মানুষের ফাঁসির আদেশ হয়ে গেল অথচ তার পরিবার জানতেও পারল না কোন অপরাধে ফাঁসি হল, মৃত দেহ পর্যন্ত হস্তান্তর করা হলো না! কী হবে মৃত ব্যক্তির পরিবারটির? তাদের কী অপরাধ? কে বহন করবে তাদের দায়িত্ব? কে নিশ্চিত করবে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের? এ রকম হাজারো প্রশ্ন নিয়ে লিখতে বসলাম আয়েশা মঙ্গল নিয়ে।
২০১০ সালে প্রকাশিত এই গল্পটির উৎস জীবন থেকে নেওয়া সত্যি ঘটনা। আয়েশা প্রধান চরিত্র। তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সৈনিক জয়নাল আবেদীনের বিধবা স্ত্রী। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অপরাধে ফাঁসির আদেশ হয় জয়নালের। বিচারবহির্ভূত এই ফাঁসিকে ঘিরে আবর্তিত কাহিনির মূল পটভূমি সত্তর দশকের রংপুরের দুই পরিবার এবং ১৯৭৭ পরবর্তী তাদের জীবন প্রবাহ। ক্ষমতার মগডালে বসে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের উচ্চাভিলাষ কেমন করে খুব সাধারণ মানুষের জীবনকে এক করুণ মহাকাব্য বানিয়ে দিতে পারে তারই এক সত্যভাষণ আয়েশা মঙ্গল। মূলত উপন্যাসের নামকরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে গল্পের প্রেক্ষাপট।
মধ্যযুগের কবির রচিত মনসামঙ্গল বিংশ শতাব্দীতে আবার ফিরে এসেছে ভিন্ন রূপে। এবার সেখানে বেহুলা, লখিন্দর নেই। রয়েছে আয়েশা ও জয়নাল। ক্ষমতালোভী খ্যাপাটে দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারকেরা মনসার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে শূলে চড়ায় নিরীহ লোকদের। যেন কিছু পোকামাকড় মেরে দূর করে নিজের বাসস্থানের নিশ্চিত সুরক্ষা করা। কী নির্দয়, কী নিষ্ঠুর মানসিকতা। সেই চরম নিষ্ঠুর অন্যায় নির্যাতনের ভার বয়ে চলছে নিহত সৈনিকদের পরিবার। এমনই এক স্বামীহারা বঞ্চিত নারীর স্বপ্নভঙ্গের প্রতিচ্ছবি আয়েশা মঙ্গল।
মাত্র ষোলো বছর বয়সে যিনি বাবা-মায়ের বাড়ি ছেড়ে স্বামী জয়নালের সঙ্গে সংসার শুরু করেন। তাদের দুই চোখ তখন মহাজগতের জাগতিক সুখস্বপ্নে বিভোর। পৃথিবী কোমল তাঁদের সন্তানের গুটিগুটি পায়ের হাঁটা চলায়। দ্বিতীয় সন্তানের মহা আগমনের আনন্দের ঢেউয়ে যখন দুলছে তাদের সংসার নামক সুখের ছোট্ট ভেলা, ঠিক তখনই ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর প্রচণ্ড এক সাইক্লোনের ঘূর্ণি এসে উলট-পালট করে দেয় সবকিছু। প্রতিদিনের মতোই অফিসের উদ্দেশ্যে সকালে বেরিয়ে যায় সৈনিক জয়নাল, কিন্তু ঘরে আর ফেরা হয় না। দিন যায়, মাস গড়ায়। দুটি ছোট শিশু নিয়ে নিজ সংসার ছেড়ে শ্বশুরালয়ে শুরু হয় আয়েশার স্বামীহীন নতুন জীবন ।
এরই মধ্যে জয়নালের মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে আসে বিমান বাহিনীর খামে নীল কালিতে লেখা সেই চিঠি। যার একটি মাত্র লাইন, ‘জয়নাল আবেদীনের মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হইয়াছে’। এই চিঠি পালটে দেয় আয়েশা আর তার সন্তানদের জীবনের চলার পথ। শোকে দিশেহারা আয়েশা। মৃতদেহ না পাওয়ায় অবিশ্বাসী মন মানতে চায় না কিছুতেই যে জয়নাল বেঁচে নেই। কতইবা বয়স তার। সমাজের চোখে সে বিধবা। কিন্তু নিজের মনের অন্তঃকরণে সে জ্বালিয়ে রাখে স্বামীকে ফিরে পাওয়ার আশার সন্দীপক। স্বামীর ভালোবাসার সংসার থেকে ছিটকে পড়া আয়েশা পক্ষীমাতার মতো চিঠি আর দুই সন্তানকে বুকে আগলে রেখে শুরু করে তার সংগ্রামী জীবন। অতি সাধারণ নিরপরাধ মেয়েটি বুঝতেই পারল না ক্ষমতাবান নেতাদের রাজনৈতিক চালের পাশবিকতার মাশুল সে গুনছে।
সমাজে একজন বিধবার দৈনন্দিন জীবনচিত্র কতটা বিপন্ন, তা ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
অদৃশ্য শিকলে বাঁধা উপেক্ষিত বিধবা নারী হিসেবে কোনো বিষয়েই যে তাঁর মতামত প্রতিষ্ঠার অধিকার নেই, নিজের আয়ের ওপর অধিকার নেই, এমনকি অধিকার নেই নিজের সন্তানকে কাছে রাখার, সবাইকে সন্তুষ্ট করে চলাই তাঁর একমাত্র কাজ, সেসব অসহায়ত্বের কথা লেখক তুলে ধরেছেন নির্ভুলভাবে। পরিবারের কাছেও এক বিধবা কতটা অবহেলিত, আয়েশার প্রতি তাঁর শাশুড়ি, ননদ ও ভাই-ভাবিদের ব্যবহার তারই ইঙ্গিত করে। এমনি করে কত ঘটন-অঘটনের মধ্যে কেটে যায় ২০ বছর। তবুও আশা স্বামীকে ফিরে পাওয়ার, হয়তো সেই সঙ্গে নিজের হারিয়ে যাওয়া আধিকার ফিরে পাওয়ার।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সালের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসে যে সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অবস্থাকে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ সালে এসেও তার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? এখনো সমাজে লুটতরাজ শাসকদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য কত জয়নাল নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছে। কত অবহেলিত, অত্যাচারিত আয়েশারা এখনো গলিত পতিত সমাজের ঘানি টেনে যাচ্ছে।
তাই আমি মনে করি লেখক সময়োপযোগী একটা চমৎকার গল্প সবার সামনে তুলে এনেছেন। শব্দের জটিলতায় না গিয়ে বরং নিতান্ত সহজ সাবলীল ভাষায় সমাজের অসমতা, অসংগতি, হিংসা বিদ্বেষ, নির্বিচারে ঘটে যাওয়া অন্যায় হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো উপন্যাস সৃষ্টির জন্য লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন। বর্তমান সময়ের সমাজ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এই গল্পটি সময়ের দাবি। আশা করি পাঠকেরা উপন্যাসটি পড়ে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন।
এই বইটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের মাধ্যমে লেখক আমাদের বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার যে চেষ্টা চালিয়েছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। লেখকের জন্য শুভ কামনা।