অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধির পাশে

প্যারিসে, অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধির পাশে লেখক ও তাঁর মেয়ে
প্যারিসে, অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধির পাশে লেখক ও তাঁর মেয়ে

২০১৭ সালের আগস্ট মাসটি ছিল আমাদের পারিবারিক ছুটির জন্য পূর্ব-নির্ধারিত। এবারের গন্তব্য ইউরোপ। প্যারিসে যাওয়ার আগেই আমার বড় মেয়ে
নাহিয়ান ইলিয়াস সূচি তৈরি করে রেখেছিল, প্যারিসের ‘পের লা শেজ’ সেমেটারি যাবে। এই কবরস্থানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বিশ্বখ্যাত লেখক অস্কার ওয়াইল্ড।
ওয়াইল্ডের পুরো নাম— অস্কার ফিংগাল ও’ফ্ল্যাহার্টি উইলস ওয়াইল্ড। এটাকে বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান কবরস্থান বলা হয়। ১৮০৪ সালে কিংবদন্তি সম্রাট নেপোলিয়ন এটি উদ্বোধন করেছিলেন। রাজা চতুর্দশ লুইয়ের আমলের রাজকীয় পাদ্রি পিয়েরে ল্য শেজের নামে এই সেমেটারি নামকরণ করা হয়। প্রায় ১২০ একর জমির আয়তনে এখানে রয়েছে প্রায় তিন লক্ষাধিক কবর।
২২ আগস্ট ২০১৭-এর সকালটি আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম সেখানে যাওয়ার জন্য। পাতাল রেল ধরে আমরা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছুলাম তখন বেলা এগারোটা। চমৎকার রোদ আলোকিত করে রেখেছে প্যারিসের আকাশ। আমাদের ভ্রমণ দলের অন্য সদস্যরা বললেন, তাঁরা কবরস্থানের বাইরে কফিশপেই বসবেন। অগত্যা আমি আর নাহিয়ান পায়ে হেঁটে কবরস্থানের ভেতরে ঢুকলাম। গাইড দেখে নিলাম। ৮৩ নম্বর ব্লকেই শায়িত আছেন অস্কার ওয়াইল্ড। আমার মেয়ে নাহিয়ান, তাঁর একনিষ্ঠ পাঠিকা। অনেক বই পড়েছে সে অস্কারের। না- পথটি আমাদের জন্য সহজ হলো না। ভরদুপুরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এত বড় পথ! তাও কবরস্থানের ভেতর! মৃত্যুচিন্তাকে পাশে রাখতে চাইলাম। কিন্তু কেন জানি পারলাম না!
ফরাসি ভাষা না জানলে প্যারিসে বিড়ম্বনার শেষ নেই। আমরা হেঁটেই চলেছি। কয়েকজন দর্শনার্থীর সঙ্গে দেখা হলো। তারা কেউ জার্মানি, কেউ ইংল্যান্ড, কেইবা এসেছেন সুইডেন থেকে। তাঁদের কেউই অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধির কোনো সন্ধান দিতে পারলেন না। হঠাৎ দেখলাম একজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি গাছের নিচে একটি বেঞ্চে বসে আছেন। তাঁকেই শেষ ভরসা মনে হলো। অস্কার ওয়াইল্ডের কথা বলতেই তিনি লাফ দিয়ে উঠলেন। জাতে ফরাসি হলেও ভালো ইংরেজি জানেন। আমরা নিউইয়র্ক থেকে গিয়েছি জেনে বেশ আপ্লুত হলেন। তাঁর নাম জেনে নিলাম। মিলান শেফরেজ। বললেন, আমাকে সবাই ‘শেফ’ ডাকে। এবার তাঁকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলাম। গুগল জানাল আরও ১৯ মিনিট হাঁটতে হবে আমাদের! কী আর করা!
শেষ পর্যন্ত আমরা অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধির পাশে পৌঁছালাম। সবুজ অরণ্য-ঘেরা চারদিকে। তাঁর সমাধির চারপাশে ভিড়। তিন শতাধিক মানুষ হবে সেখানে। এত মানুষ এখানে! কিছুক্ষণ পরই আরও একটি দর্শনার্থী দল নিয়ে একজন দোভাষী এলেন। আমরাও তাঁর দলে মিশে গেলাম। তিনি জানালেন, এই সমাধিটি আগে উন্মুক্তই ছিল। কিন্তু অস্কার প্রেমিকেরা সমাধিটির গায়ে এমন সব চিহ্ন এঁকে ভালোবাসা জানাচ্ছিলেন যে, তাতে সমাধির শ্রী-হানি হচ্ছিল। গাইড দেখালেন, কেউ সমাধির কংক্রিটের ক্ষুদ্র অংশও ভেঙে নিয়ে গেছে! অগত্যা অস্কারপ্রেমীদের হাত থেকে অস্কারের সমাধিকে বাঁচাতে ফরাসি সরকার আট ইঞ্চি পুরু বুলেটপ্রুফ গ্লাস লাগিয়েছে চারপাশে।
আমার মনে পড়ল অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন— ‘কেবল আবেগ ছাড়া আমি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।’ ভাবলাম আইরিশ এই প্রখ্যাত লেখকের উক্তিটি সত্যি হলো তাঁর ভক্তদের বেলায়ও। ভক্তদের ভালোবাসার অত্যাচার থেকে অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধিকে রক্ষা করতে তাই ফ্রান্সের সরকারকে নিতে হয়েছে নানা পদক্ষেপ। ভক্তরা ভালোবাসেন অস্কার ওয়াইল্ডকে। আর এই ভালোবাসা পাগলের মতো। আর সেই ভালোবাসা জানাতে অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধিসৌধে তাঁরা রাখছেন নানা চিহ্ন। ভক্তদের চুম্বনে কবির সৌধ ভরে গেছে লিপস্টিকের দাগে। সেই দাগ এমনই অমোচনীয় যে পানি দিয়ে ধুয়েও মোছা যায় না। ফলে জনপ্রিয় এই কবির সমাধিসৌধ হারাতে বসেছিল এর জৌলুশ।
গাইড বললেন, গত প্রায় ১০০ বছর ধরেই কবির সমাধিসৌধে চলছে ভক্তদের ভালোবাসার এই অত্যাচার। অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধিসৌধের চারপাশে এবার তাই তুলে দেওয়া হয়েছে কাচের দেয়াল। ফ্রান্স সরকারের সাফ কথা, এই সমাধি এখন ঐতিহাসিক সৌধে পরিণত হচ্ছে। যারা এর ক্ষতি করবে, তাদের জরিমানা হবে। ফলে ইচ্ছা করলেই যখন-তখন ভক্তরা চুমু খেতে পারবেন না আর কবির সমাধিতে।
আমি প্যারিসের আকাশের দিকে আরেকবার তাকালাম। অস্কার ওয়াইল্ড ১৬ অক্টোবর ১৮৫৪ আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ৩০ নভেম্বর ১৯০০ সালে। মাত্র ৪৬ বছরের জীবন ছিল তাঁর। প্রেমের কবি হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁর। কিন্তু প্রেমের এই কবিকেও জেল খাটতে হয়েছিল নানা মিথ্যা অভিযোগে। অবশেষে লন্ডন ছেড়ে থিতু হন সংস্কৃতির রাজধানী প্যারিসে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর সব সংস্কৃতির ও ঐতিহ্যের ধারক হলো ফ্রান্স। অস্কার ওয়াইল্ড চেয়েছিলেন, ফ্রান্সেই তাঁর সমাধি হোক। জীবনের শেষ দিকে যুক্তরাজ্যের প্রতি তিনি তাঁর ঘৃণা প্রকাশ করতেন। অস্কার ওয়াইল্ড প্যারিসেই মারা যান। সে সময় তিনি ছিলেন কপর্দকশূন্য। তাঁর বন্ধুরা মিলে প্যারিসের বাইরে ‘বেগন’ নামে একটি ছোট শহরে তড়িঘড়ি করে তাঁকে সমাহিত করেন। সে সময় দরিদ্রদের সেখানে সমাহিত করা হতো। পরে অস্কার ওয়াইল্ডের লেখা বই বিক্রি করে তাঁদের হাতে অর্থ চলে আসে। তাই প্যারিসের বিখ্যাত ‘পের লা শেজ’ সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে আবার সমাহিত করা হয়। এখানে ফ্রান্সের কবি জিম মরিসন, ইডিথ পিয়াফ ও নাট্যকার মলিয়েরের সমাধিও রয়েছে।
ভিড়ে কবি-ভক্তদের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে কবির জীবনটাই যেন এক ঝলকে চোখের সামনে চলে এল। এক সময় পুরু কাচে ঘেরা সমাধির পাশে আমি আর আমার মেয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম একান্তে। গ্লাস ভেদ করে অনেকেই উপর দিয়ে তাজা গোলাপ ছুড়ে দিচ্ছেন সমাধির ভেতরে। কেউ লিখেছেন চিরকুট। আমি খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চিরকুটগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। পোল্যান্ড থেকে আসা বিভিয়ান নামের এক ব্যক্তির চিরকুট নজরে এল। লিখেছেন- ‘স্টিল আই লাভ ইউ-বিভিয়ান, পোল্যান্ড’। আরেকটি চিরকুটে লেখা- ‘হু টোল্ড ইউ ডাইড!- জেনি, জার্মানি’। তাজা ফুলগুলো যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নজরে এল পুরু কাচের ওপরই লেগে আছে লাল লিপস্টিকের দাগ। এখনো সেখানে কেউ চুমু দিচ্ছে তবে!
এক পর্যটক জানালেন, তিনি শুধু এই সমাধি দেখার জন্যই হাঙ্গেরি থেকে এসেছেন। মানুষজন কেন এখানে আসে! ভাবতে ভাবতে আমি আমাদের সঙ্গী ‘শেফ’-কে বিদায় জানাই। বলি, ‘আবার দেখা হবে বন্ধু!’ তিনি বললেন, ‘আমি প্রায়ই নিউইয়র্কে যাই। তোমার সঙ্গে দেখা হয়েও যেতে পারে।’
আহা! এভাবে কি মানুষের সঙ্গে মানুষের আবার দেখা হয়! আমার মনে পড়ে যায় মার্কিন কবি জন অ্যাশবেরি’র কথা। তিনি বলেছিলেন- ‘একটি মানব জীবনে সবার সঙ্গে সবার দেখা হতে হবে কেন?’ আমি বলি, ‘না- সবার সাথে সবার দেখা হয় না।’ এভাবেই আয়ু ফুরিয়ে যায়।
তাকিয়ে দেখি, কারা নেই এই সমাধি চত্বরে। দার্শনিক, চিত্রকর, সংগীতজ্ঞ, লেখক, রাজনীতিবিদ, রূপালি পর্দার তারকা। কেউ ফ্রান্সেই জন্মেছেন। কেউ এসেছিলেন অন্য কোনো দেশ থেকে। আশ্রয় নিয়েছিলেন প্যারিসে। সবারই শেষ বিশ্রামস্থল হিসেবে হাজির হয়েছে ‘পের লা শেজ’; যা পরিণত হয়েছে লাখো মানুষের অবশ্য গন্তব্যে। এখানেই অসংখ্য সমাধির ভিড়ে নিভৃতে রয়েছে ফরাসি ভাষার জনপ্রিয় কবি গিয়ম অ্যাপোলোনিয়রের সমাধি। গ্রানাইটে খোদাই করা আছে তাঁর অমর অক্ষয় পঙ্‌ক্তিমালা। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ গিয়েছিলেন এই সমাধি দেখতে। এরপর প্রাণের আবেগ দিয়ে লিখেছিলেন ‘অ্যাপোলোনিয়রের সমাধিতে’ নামে একগুচ্ছ অসাধারণ কবিতা।
আমিও প্যারিস নিয়ে ভাবতে থাকি। হ্যাঁ, একগুচ্ছ কবিতা আমিও লিখব। শিরোনাম ঠিক করি মনে মনে; ‘প্যারিস, প্রণয়ের প্রদীপ হাতে’। আমার মেয়ে তার মতো করে ঘুরছে। আমি তন্ময় হয়ে বসে আছি। ভাবছি অস্কার ওয়াইল্ডকে নিয়ে। কয়েক বছর আগে সংবাদে পড়েছিলাম, অস্কার ওয়াইল্ডের নিজের হাতে লেখা কিছু প্রেমপত্র প্রথমবারের মতো প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সেসব কোনো প্রেমিকার কাছে লেখা পত্র ছিল না। ওই চিঠিগুলোয় এক তরুণ বন্ধুর প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশিত এসব চিঠিতে সমসাময়িক এক তরুণের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের বিষয়টি ফুটে উঠেছে, যিনি ছিলেন একটি পত্রিকার সম্পাদক।
অস্কার ওয়াইল্ড এসব চিঠি লেখেন ১৮৮৭ সালে। ওই সময় তিনি যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু সাময়িকীতে নিয়মিত লিখতেন। লেখা সম্পাদনাও করেছেন বিস্তর। আলসাজার ভিয়ানও ছিলেন সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত। তাঁকে একাধিক চিঠিতে ওয়াইল্ড সিগার ও ইতালীয় মদ পানের দাওয়াত দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠিতেই ভিয়ানকে তাঁর কাছে আসার আমন্ত্রণ জানান ওয়াইল্ড। প্রথম চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘কাল বিকেলে আমার এখানে চায়ের দাওয়াতে এলে খুব খুশি হব। সাংবাদিকতা-বিষয়ক লেখা নিয়ে শিগগিরই এক সন্ধ্যায় আমাদের অবশ্যই বসতে হবে।’ সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানিয়ে ওই বন্ধুর কাছে পাঠানো আরেক সুদীর্ঘ চিঠিতে ওয়াইল্ড লেখেন, ‘সেখানে শুধু আমরাই থাকব, আর থাকবে এক ফ্লাস্ক ইতালীয় মদ।’ চিঠিতে ওয়াইল্ড তাঁর সম্পাদক বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘বাইরের ভিড়ভাট্টায় কথা বলা দায়। এর চেয়ে একান্তে যাওয়াই ভালো।’
এই বিশেষ চিঠিগুলোর সূত্রেই মনে পড়ে, আঠারো শতকের শেষদিকে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন অভিজাত বংশ ‘মারকুয়েজ অব কুইনসবেরির’ ছেলে লর্ড আলফ্রেড ডগলাসকে বিপথগামী করার অভিযোগে অস্কার ওয়াইল্ড দুই বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। তা ছিল মূলত ডগলাসের সঙ্গে তাঁর সমকামিতার অভিযোগ। ওয়াইল্ডের সময় সমকামিতা ছিল কারাভোগের মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অস্কার অবশ্য তা অপরাধ বলে মনে করতেন না। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘এর পুরোটাই যে ভুল, তা নয়।’
প্রায় চার ঘণ্টা কবরস্থান ভ্রমণ করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ি। পরদিনই প্যারিস থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে উড়াল দেব। বাইরে এসে আবার বসলাম কফিশপে। আমার ছোট মেয়ে নাশরাত ইলিয়াস খেপিয়ে তুলতে চাইল নাহিয়ানকে। বলল— ‘মৃত মানুষদের সঙ্গে তোমাদের কথোপকথন কেমন হলো!’ আমরা হাসলাম। ফারহানা ইলিয়াস তুলি বলল, ‘তুমি তা মিস করেছ নাশরাত!’ নাশরাত জবাব দিল, ‘মৃত মানুষদের খোঁজার সময় আমার এখনো আসেনি।’
স্মিত হাসলাম আমরা। আমাদের চোখে-মুখে তখনো অস্কার ওয়াইল্ড। একজন লেখককে মানুষ এভাবেই মনে রেখেছে। গর্বে বুকটা ভরে গেল। সেই সঙ্গে বিষণ্নতাও ঘিরে ধরল। হায়! জীবনে ভালো কিছুই লেখা হলো না আমার।