বিশ্বে একা হয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

কানাডার কুইবেকে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর শীর্ষ সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে সিঙ্গাপুরে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রোববার আকাশপথে থাকতেই তিনি নির্দেশ দেন, সম্মেলন শেষে প্রথামাফিক যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র তাতে যোগ দেবে না। তিনি মার্কিন প্রতিনিধিদের বিবৃতিতে সই না করতে বলেন।

অবশ্য সে বিবৃতি যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ট্রাম্পকে খুশি রাখতে তাতে বেশ কিছু পরিবর্তনও আনা হয়েছে। এই জোটের নেতা তিনি, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বেই এর প্রতিষ্ঠা। তা সত্ত্বেও বাণিজ্য শুল্ক প্রশ্নে অন্য দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে ব্যবধান মিটিয়ে ফেলার বদলে তিনি যে এমন নাটকীয়ভাবে নিজের মতভেদ ঘোষণা করবেন, তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।

বাণিজ্য শুল্ক প্রশ্নে এই জোটভুক্ত শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে, এটি কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। কানাডা ছাড়ার আগে যে সংবাদ সম্মেলন তিনি করেন, তাতে ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছিলেন পশ্চিমা দেশগুলো এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে বাণিজ্য ফায়দা আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু আর নয়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সে সুযোগ দেবে না। বাণিজ্য-ব্যবধান কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র যে শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করেছে, সেটি তার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। এ সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হবে না।

কানাডা ও অন্য ইউরোপীয় অংশীদারেরা ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র যুক্তি দেখানোয় তীব্র আপত্তি করেছিল। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সে কথা উল্লেখ করে অভিযোগ করেন, আমেরিকার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে। অথচ তাঁদের বিরুদ্ধেই ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ প্রশ্ন তুলে শুল্ক আরোপ করা হলো, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি রীতিমতো অপমানজনক। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কানাডীয়রা নম্র ও যুক্তিসংগত মানুষ। তাই বলে আমাদের ওপর জোর করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে আমরা তা মেনে নেব না।’

সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডোর বক্তব্য শোনার পর বেঁকে বসেন ট্রাম্প। এক টুইটে তিনি জানান, ট্রুডো মিথ্যা বলেছেন। সে কারণে ও মার্কিন কৃষিজাত পণ্যের ওপর কানাডার আরোপ করা বিপুল শুল্কের কারণে তিনি যৌথ বিবৃতি থেকে নাম প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বিদেশি মোটর গাড়িতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার যেভাবে সয়লাব হয়ে গেছে, তা ঠেকাতে নতুন করে শুল্ক আরোপের বিষয়টিও তিনি বিবেচনা করবেন।

যুক্তরাষ্ট্র তার ঘনিষ্ঠতম অংশীদারদের সঙ্গে এভাবে প্রকাশ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়বে, এটি একেবারে অপ্রত্যাশিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার ভিত্তিমূলে রয়েছে এই অংশীদারত্ব। এই সম্পর্কের কেন্দ্রে রয়েছে একদিকে নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, অন্যদিকে ন্যাটোর মাধ্যমে সামরিক প্রশ্নে সমন্বয়। ট্রাম্প এখন এই উভয় নীতির বিরুদ্ধেই খড়গহস্ত হয়েছেন।

ইতিপূর্বে এককভাবে জলবায়ু প্রশ্নে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে এবং ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করে ট্রাম্প ইউরোপীয়দের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তটিও তাদের বিরক্ত করে। বৈঠকের আগে ট্রাম্প রাশিয়াকে জি-৭ জোটে ফিরিয়ে আনার এক প্রস্তাব করেন, সেটিও সবাইকে বিস্মিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শেই ইউক্রেনের অংশবিশেষ দখল করার প্রতিবাদে রাশিয়াকে এই জোট থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে কতিপয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সে সিদ্ধান্তের জন্য সব দায়ভার প্রেসিডেন্ট ওবামার ওপর চাপিয়ে দিয়ে ট্রাম্প প্রস্তাব রাখেন, রাশিয়াকে জোটে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ রাশিয়া বিশ্ব অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাশিয়াকে স্বাগত জানাতে জোটভুক্ত অন্য দেশ সম্মত ছিল না।

পশ্চিমা নেতারা খোলামেলাভাবেই তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি ডোনাল্ড টাস্ক বলেছেন, ট্রাম্পের গৃহীত ব্যবস্থার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে আইন ও নীতিভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ট্রাম্পের পদক্ষেপগুলো কেবল তাদেরই খুশি করবে, যারা পশ্চিমের উদার গণতন্ত্র ও মৌলিক স্বাধীনতার বিপক্ষে।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিমা জোটের ভাঙন কতটা স্থায়ী, তা নির্ণয়ের সময় এখনো আসেনি। তবে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে একা হয়ে পড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেই দিয়েছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি না চায়, তাহলে জি-৭-এর পরিবর্তে জি-৬ গঠিত হবে। আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, মূল্যবোধ রয়েছে; আমরাই তা রক্ষা করব।’ ট্রাম্পও জানিয়ে দিয়েছেন, তেমন কিছু ঘটলে তাঁর তেমন কোনো আপত্তি থাকবে না।

যুক্তরাষ্ট্র কতটা একা হয়ে পড়ছে, তা বেশ বোঝা যায় সম্মেলন শেষে জার্মানির বিলি করা একটি ছবি থেকে। ছবিটিতে একা চেয়ারে বসে ট্রাম্প, যথারীতি বুকের ওপর দুই হাত গোটানো। আর টেবিলের অপর পারে তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন জি-৭-এর অন্য নেতারা। জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের নির্দেশে বিলি করা এই ছবি ইউরোপীয়দের চোখে ট্রাম্পের একাকিত্বের প্রমাণ। সেই একই ছবি ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনও বিলি করেন। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা ছিল ভিন্ন। ছবিটির সঙ্গে এক টুইটে তিনি লেখেন, জি-৭-ভুক্ত অন্য দেশগুলো আশা করে যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ব্যাংক হয়েই থাকবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন তা আর হওয়ার নয়।