পথ খুলল, সামনে চ্যালেঞ্জ

সিঙ্গাপুরের সেন্তোসা দ্বীপে গত মঙ্গলবার পাশাপাশি হাঁটছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও কিম জং–উন।  ছবি: এএফপি
সিঙ্গাপুরের সেন্তোসা দ্বীপে গত মঙ্গলবার পাশাপাশি হাঁটছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও কিম জং–উন। ছবি: এএফপি

তিন মাস আগেও ছিলেন একে অপরের শত্রু। একজন হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের জন্য তৈরি হও। অন্যজন বলেছিলেন, তাঁর টেবিলে পারমাণবিক বোমার বোতাম রয়েছে, টিপলেই প্রতিপক্ষ নিশ্চিহ্ন। দুই অস্থিরমতি নেতার হাতে পৃথিবী আরেক মহাযুদ্ধের মুখোমুখি, এই ভয়ে অনেকেই আতঙ্কিত হয়েছিলেন।
মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে সেই দুই নেতা, ৭১ বছর বয়স্ক ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ৩৪ বছর বয়স্ক কিম জং-উন, দেড় পাতার এক কাগজে স্বাক্ষর করে জানালেন, যুদ্ধ নয়, তাঁরা শান্তিতে বিশ্বাসী। সমগ্র কোরীয় উপদ্বীপে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় যা যা করা দরকার, তার সবই করতে তাঁরা প্রস্তুত। কিম জানালেন, শান্তির লক্ষ্যে তিনি তাঁর দেশের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করতে রাজি। কথা দিলেন, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একটি পারমাণবিক পরীক্ষাকেন্দ্র তিনি ধ্বংস করবেন। ট্রাম্প জানালেন, এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর যে সামরিক মহড়া পরিচালনা করে থাকে, তিনি অবিলম্বে তা স্থগিত করার নির্দেশ দিচ্ছেন। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে নিতেও তিনি আগ্রহী।সন্দেহবাদীরা বলছেন, বিপারমাণবিকীকরণের কথা বলেও কিম ঠিক কী করবেন, কত দিনের মধ্যে করবেন, তার কিছুই সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি। বস্তুত, যে যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা দুজন স্বাক্ষর করেছেন, কার্যত প্রায় একই ভাষায় এর আগে আরও তিন-তিনবার চুক্তি করেছেন কিমের দুই উত্তরসূরি—তাঁর পিতামহ ও পিতা। এ বছর এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কিম নিজে যে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, তাতেও শান্তির পক্ষে সেই একই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত তাঁদের প্রদত্ত কোনো কথাই উত্তর কোরীয় নেতারা রাখেননি। এবার যে রাখবেন, তারই-বা কী নিশ্চয়তা? 

ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি কিমকে বিশ্বাস করেন। উত্তর কোরীয় নেতার সঙ্গে তাঁর চমৎকার বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছে। তিনি কিমকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে দেশটিকে সোনার দেশে পরিণত করা সম্ভব। উত্তর কোরিয়ার সমুদ্রসৈকত দেখেই তাঁর মনে হয়েছে এখানে তো দারুণ সব হোটেল বা বহুতল ভবন বানানো যায়। ট্রাম্পের নির্দেশে হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে এক বিজ্ঞাপনী ভিডিও পর্যন্ত বানিয়ে কিমকে দেখানো হয়েছে চাইলে কী পরিবর্তন তিনি আনতে পারেন।
যে ত্বরিতগতিতে, পর্যাপ্ত আগাম পর্যালোচনা ছাড়া এই শীর্ষ বৈঠক সম্পন্ন হলো, তাতে স্পষ্ট উভয় পক্ষই এই বৈঠক সম্পন্ন করতে অতি আগ্রহী ছিল। কিমের পারমাণবিক হুমকির মুখে ট্রাম্প একবার বৈঠক বাতিল করেছিলেন, কিন্তু তাঁরই নির্দেশে পূর্বনির্ধারিত তারিখেই শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি জানিয়েছেন, বৈঠক বাতিল হওয়ার পর কিম জং-উন ফের বৈঠক শুরুর জন্য রীতিমতো হাতে-পায়ে ধরা শুরু করেছিলেন। অন্যদিকে, ট্রাম্প নিজেও বৈঠকের জন্য প্রস্তুতি থামাননি।
বস্তুত, তাঁদের দুজনের জন্যই এই বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি এখন তলানিতে পৌঁছেছে, অব্যাহত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে টিকে থাকাই তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। কিম সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার কমতির হাল এমন দাঁড়িয়েছে যে সিঙ্গাপুরের হোটেলের ভাড়া জোগাড়ের অবস্থা পর্যন্ত তার নেই, ভাবা হচ্ছিল হয়তো আমেরিকাকেই সে ভাড়া চুকাতে হবে।
অন্য আরও একটি হিসাব কিম মাথায় রেখেছেন। সোমবারের আগ পর্যন্ত তাঁর পরিচয় ছিল একজন রক্তচোষা একনায়ক হিসেবে। ক্ষমতা ধরে রাখতে নিজের ভাই ও চাচাকে খুন করতে দ্বিধা করেননি তিনি। জাতিসংঘ তাঁর নামে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ এনেছে। অথচ আমেরিকার সঙ্গে সমানে সমান বৈঠক করে সেই লোকটি একলাফে একজন বিশ্বনেতা হয়ে গেলেন। শান্তির জন্য ট্রাম্প যদি নোবেল পুরস্কার পান, তাহলে সে পুরস্কারের আধখান তো তিনিও দাবি করতে পারেন।
অন্যদিকে, ট্রাম্প ভেবেছেন বিশ্বনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার এটাই সেরা সুযোগ। প্রেসিডেন্ট ওবামা বিদায়ের আগে তাঁকে বলে গিয়েছিলেন, উত্তর কোরিয়াই হবে তাঁর জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ওবামাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে তাঁকে ঠিক এই চ্যালেঞ্জটিই নিতে হলো। ট্রাম্প হিসাব করে দেখেছেন, ওবামার মতো তাঁকেও যদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে হয়, তাহলে এটি হবে তাঁর সুবর্ণ সুযোগ।
জাতিসংঘে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন বিল রিচার্ডসন। তিনি বলেছেন, নিচ থেকে ওপর বা বটম টু টপ—এই পথে এগোলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কোনো অর্থপূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়। সে চেষ্টা ৬৫ বছরে ধরে আমেরিকা করেছে। এখানে সবকিছুই একজনের হাতে। এবার হয়তো ওপর থেকে নিচ বা টপ টু বটম—এই পথে এগোলে ফল মিলবে।
ট্রাম্প নিজে বিশ্বাস করেন, উত্তর কোরিয়ার নেতার সঙ্গে অর্থপূর্ণ চুক্তি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব। ‘আমার কোনো সন্দেহই নেই চেয়ারম্যান কিমের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই সুন্দর হবে’, সিঙ্গাপুরে তিনি সাংবাদিকদের জানান।
শেষ পর্যন্ত তাঁর এই আশা বাস্তবায়িত হয় কি না, সে কথা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। তবে আপাতত কোরীয় উপদ্বীপে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা কমেছে, পৃথিবীর সব মানুষই তাঁকে স্বাগত জানাবে।