বই হোক আমাদের উত্তরাধিকার

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই আমাদের এই অঞ্চল, আচমকা একটি নতুন অভিবাসী সমাজ-শক্তির আগমন অবলোকন করেছিল। ঠিক অবলোকন নয়, ছিল একটি ছায়াপাত। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন পেশার যৌবনঋদ্ধ মানুষ, যে অজানা মোহে ও নিজ নিজ জীবনের উজ্জ্বল সৃজনকল্পে এই শহরে এসেছে, তার প্রক্রিয়ায়, তখন ছিল, বিশালতায় বিলীন হওয়া এক বপন, যা সেই সময়টায় চোখে না পড়লেও পরে আর সবার নজরে পড়েছে। যেন ছিল একটি অনুপ্রবেশ, অগোচরে, নিঃশব্দে, নিস্তরঙ্গে আসা এক বন্দী আশা। বাংলাদেশে এরা গৃহী না হলেও এদের গৃহ ছিল, আত্মীয়পরিজন ছিল, আবর্ত ছিল ভালোবাসার আর জ্বলে ওঠার, জীবন-বিভাস ছিল উজ্জীবনে সুবাসিত। তবুও তারা পৃথিবীর বিচিত্র লীলার বিজ্ঞাপন, যা অনেকটাই অবিশ্লেষিত ও মুগ্ধতা-আবিষ্ট, যতটা না উন্মোচনের আয়োজনে, তারও বেশি, তাকে কেবল চোখের দেখার জন্য, জীবনের ভিটায় উপহার হিসেবে পেতে চাইল। চার যুগ আগের কথা। সেই একটি দুটি আগমন তখন কোনো জীবন-বিস্তৃতির কথা বলেনি, কেবল রচনা করেছে নিজ নিজ অন্তর্ভূমির মর্মবেদনা, প্রাণের মানুষ চোখে নেই, জীবনযাপনের কোনো অভিজ্ঞতাও, তখন গ্রহণে-বর্জনে-চৈতন্যে অভিষিক্ত হয়নি। তবুও অচেনা আবাস ভূমে ও সংস্কৃতিতে কেবল টিকে থাকার আপ্রাণ-চেষ্টায় তারা একই সঙ্গে, শ্রমী, পরিশ্রান্ত ও শক্তি-প্রাপ্ত হতে লাগল।
তারা সার্বিক অর্থেই তখন নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন, দেশ থেকে, দেশের মানুষ থেকে। তারা শক্তি-প্রাপ্ত হতে পারল, এই কারণে যে, নতুন দেশের মানুষজন, বেশভূষা, চলন-বলন, আচার-বিচার ও নাগরিক অভিজ্ঞতা সেই বিচ্ছিন্নতাকে আরও বিপন্ন করে তুললেও, যেহেতু তারা বদ্বীপ উদ্গত বঙ্গসন্তান, সেহেতু অর্জনে তাদের রয়েছে ভাষা ও স্বাধীনতার মতো দৃঢ়, শিখর-স্পর্শী, অবিচ্ছিন্ন এক অন্তর-সমষ্টি-উপাসক, অজান্তেই তাই, অভিবাসীর অসহায়ত্বের মধ্যেও, শ্রমে-ঘামে, নাগরিক চলিষ্ণুতায়, কয়েক বছরের মধ্যেই তারা পায়ের নিচে মাটি পায়, বাংলার আবহমান শক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে, তারা পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধের জোটবদ্ধতায়, এক সপ্রতিভ জীবন-সংগীতের আভাস-ধ্বনি শোনে। সেই ধ্বনি আজ বয়সী ও অর্থময়। অভিবাসী বাংলাদেশির জীবন আজ পৃথিবীর এই প্রান্তে, আমাদের এই শহরে, সব বিবেচনায় ও অহংকারে বর্ণময়।
এই শহরে আমি জন্মাইনি, কিন্তু নিউইয়র্ক আমার জীবনের শহর। বাংলাদেশ আজও আমার প্রাণের পরতে পরতে সর্বসময়ের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার সব আসরের অখণ্ড এক ঐশী বাঁশি। আমি জানি, আমৃত্যু আমি এই বাঁশির সুর-স্নিগ্ধতায় আমার চিরকালের আনন্দধ্বনি ও অন্তর্বেদনা বহন করে যাব। আর এও জানি, আমার আজকের এই শহরে স্বাভাবিকতার পথে পাওয়া জীবনের সব অন্তঃশীল আনন্দ, সব দহন ও প্রাপ্তি-প্লাবন আমি তিল তিল চয়ন করেছি। আজ এক দেশের অভিবাসী হয়ে অন্য সব দেশের অভিবাসীর সুখ-দুঃখকে নিঃসংকোচে একটি মিলনমেলার শামিয়ানার নিচে বসতে দেখে আনন্দিত হই। আমি অনুমান করি, অনুভব করি, আমরা সবাই এই মহাপৃথিবীর মহামানবকুলের মহাবোধির অংশীদারত্ব নেওয়ার নিত্য সম্ভাবনার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। আর এজন্য আমরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করি। করি বলেই, করতে পেরেছি বলেই মধ্যসত্তর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশি অভিবাসী যাত্রাটি এখনো নিরলস ও চলমান এবং বিকাশ-উন্মুখ।
সেদিনও চলমান ছিল, কিন্তু তা ছিল জনে জনে প্রতিজনে এবং গুনে গুনে। চলমান জীবন-জোয়ালের কোনো সম্মিলিত চালক ছিল না। যে অর্থে আজকের অভিবাসী জীবন বিবর্তনের ভেতর দিয়ে অবিচ্ছিন্ন, সে অর্থে আমরা সেই সময় প্রচণ্ডভাবে শ্রমের মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে উদ্‌গ্রীব, আর উদ্‌গ্রীব বলেই ঘরে-বাইরে দৃশ্যত ও কার্যত আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এ দেশ শ্রমের মর্যাদায় আমাদের অভিষিক্ত করল, কিন্তু মন রইল অতৃপ্ত ও বিচ্ছিন্ন, হৃদয়বৃত্তির স্তরে স্তরে সাজানো সংবেদনশীলতা পথে।
অতৃপ্ত, আর যেহেতু ‘হৃদয়ের কথা বলতে ব্যাকুল’, যেহেতু আমরা বাংলা-সুষমায় বিশ্বের সর্বত্র মহিমান্বিত, আর আমাদের মানসচৈতন্যে বাংলা ভাষার ইমারত এতই মজবুত ও সৌকর্যমণ্ডিত যে, সমবেত ও সমস্বরে সকাল-সন্ধ্যার আহার-বিহারের বাইরে কণ্ঠে তুলে রাখা কম্পমান শব্দাবলি হয়তো একদিন, কবিতায়, গানে, নাটকে, লেখায় প্রকাশ উন্মাদনায় থর থর করে কেঁপে উঠবে। এই আবেগাশ্রিত বিশ্বাসটি তখন আমরা ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেই বিশ্বাসের পথেই ফলিত হয়েছে, একটু একটু করে শিল্পকলা ভাবনা ও এর প্রকাশ-মাধ্যম। আজকের এই যে আমাদের শত সাফল্য শত ধারায়, আমাদের শহরের সংস্কৃতির উঠোনে বাংলাদেশির এত যে সাংস্কৃতিক সুখ-উল্লাস আপন আপন মাধুর্যে নেচে নেচে উঠছে, সেদিনের সেই চিরায়ত চাওয়া, একটু একটু, ভেঙে ভেঙে, জড়িয়ে জড়িয়ে, তা বাংলাদেশির অখণ্ড ও অসামান্য চিত্তবৃত্তিকে বাহুডোরের উষ্ণতা দিতে পেরেছিল বলেই সম্ভব হয়েছে।
আজ বিশ্বজোড়া জাগরণের গানে মিশে আছে বাংলাদেশির স্বর ও সুর, কান পেতে শুনি বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশির জীবন-ধ্বনির জয়গান। যে জীবন নিজ দেশে পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল, সে জীবন পৃথিবীর অচেনা লোকালয়ে ছিটকে পড়ে হতবাক হলেও প্রতিভাসে জয়ী। বাংলাদেশের বাইরে শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, বাণিজ্যের অগ্রযাত্রা, বাংলাদেশির আজ আর কোনো দৈবক্রম নয়—মেধা, শ্রম, ঘাম সমন্বয়ে অর্জিত ফসল সব। এটা অনুমান করা যেতে পারে যে, অন্তত আমাদের শহরে আজ সমষ্টি-নিঃসঙ্গতা বিরল হয়েছে, পরিবর্তে আপন সংস্কৃতির একটি উত্তাল সময়ের মধ্যে অভিবাসী বাংলাদেশি তার জীবনকে অতিবাহিত হতে দেখছে। তার অগ্রগামিতা নিকটকালে থেমে যাবে না, বরং গতিপ্রাপ্ত হবে। আর তার স্বরূপটি উদ্‌ঘাটন করবে ইতিহাস, অন্য কথায় অন্যসময়।
আমাদের অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব শাখা দিনে দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছে। নাচ হচ্ছে, হচ্ছে গান, নাটক, কবিতা, সিনেমা, টিভি, রেডিও। রাজনীতি, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, রূপ-লাবণ্য, বিজ্ঞান, আইন ইত্যাদি ভাবনা নিয়ে নির্মিত ও আয়োজিত হচ্ছে সম্মেলন। সম্মিলন সম্মিলন, খোলা খোলা সংবেদে ও সৌরভে, আরতিতুষ্ট হচ্ছে মহামিলনের দীপ্তি। আর এসবের খবর ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশের বাংলাদেশি অভিবাসীর কাছে, স্থানীয় খবরের কাগজের পাতায় পাতায়। ছড়িয়ে পড়ছে বা পড়তে পারছে বলেই, অনুভব করি আজ আর দ্বীপবাসীর স্বভাবে একা একা আমরা ‘বাংলা’র সুষমা থেকে বঞ্চিত নই। সর্বোপরি, আমরা নিঃসঙ্গ নই, আমাদের ভাষা, আমাদের দেশ, আমাদের সংস্কৃতি আর মানুষ, আমাদের জীবন-ভঙ্গিমার তরঙ্গে তরঙ্গে আমোদিত ও মহিমান্বিত। আর এই অনুভবেই শতবর্ষের আশ্বাসে আগামীর পথে টর্চ ফেলি।
এত যে প্রাপ্তির সন্তুষ্টি, আমি সর্বান্তকরণেই অনুভব করি, এসব কিছুই শেষাবধি সমষ্টির বলয়ে অধরা থেকে যেত। যদি না, যার মালিকানায় কেউ কখনো নিঃসঙ্গ হয় না, যার বাহুল্যে কেউ কখনো ফুরিয়ে যায় না, যদি না তার প্রাপ্তি-সম্ভাবনা কখনো প্রস্ফুটিত হতো- চাই বই, কিছু বই, বই আর বই।
তখনো সত্তর-আশির দশকে, সংখ্যায় অপ্রতুল বাংলাদেশি অভিবাসীর জীবনে, তার ফেলে আসা সংস্কৃতির বসতি-সম্ভাবনা অল্পবিস্তর চপল হয়ে উঠছিল। একুশ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এসব বিশেষ দিনগুলোতে অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো সাধ্যমতো। হতো কখনো কখনো নাটক। নির্মিত ও প্রচারিত হয়েছে এ দেশের টিভির জনপ্রিয় একটি চ্যানেলে। ১৯৮৪ সালে এক ঘণ্টার একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, তারও আগে সত্তরের শেষের দিকে সত্যজিৎ এলেন সোনার কেল্লা নিয়ে, এলেন হেমন্ত, রুনা লায়লা, উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া, ফিরোজা বেগম, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, ভূপেন হাজারিকা, সাবিনা ইয়াসমিন প্রমুখ। সেই সব বিখ্যাত তারকার আগমন বার্তা ও তাদের চাক্ষুষ দেখা অবর্ণনীয় আনন্দ দিয়েছে আমাদের। ‘পদ্মার ঢেউ’ নামে আধঘণ্টার একটি সাপ্তাহিক রেডিও প্রোগ্রাম, আন্তরিক নামের একটি প্রায় নিয়মিত ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা, ‘উন্মূল’ নামের একটি অনিয়মিত সাহিত্য আসর, আর কিছু আয়োজনের মধ্যে প্রথমে প্রবাসী, পরে ঠিকানা এবং তার অল্প পরেই বাঙালি নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা আমাদের প্রবাস জীবনকে ঝলমল করে তুলল। পত্রিকগুলোর অভাবিত ও বিরামহীন অবদান বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আজও অব্যাহত রেখেছে। একই ভূমিকা রাখছে আজকের অন্যান্য পত্রিকা ও গণমাধ্যম।
এসবের পর শুরু থেকেই যে অভাব বা চাহিদা দিনে দিনে প্রবল হয়ে উঠছিল, তা মেটানোর কোনো সম্ভাবনা দেখা দিল না। বাংলাদেশ ছেড়ে আসার সময় বয়ে আনা স্যুটকেসের কয়েকটি বই ও পত্রপত্রিকা বারবার পড়ে পড়ে চোখ মন অবসিত হলো। কালেভদ্রে অঙ্গীকারবদ্ধ কিছু আপনজনের পাঠানো পাতলা বই বা বিচিত্রা অবসাদকে মুহূর্তেই চাঙা করে তুললেও গোটা বই পড়া মাত্রই আবার আমরা ক্ষুধার্ত ও তৃষিত হয়ে উঠি।
একটা পীড়ন, না পাওয়ার আর সব পাওয়ার ইতিবাচক সম্ভাবনাকে বিলীন করে দিল। তারপর একদিন সেই দিন, ব্যক্তিমানস ও সামাজিক উপকারিতার পথে উদয় হয়ে বিশ্বজিত সাহা বললেন, ‘এই নিন বই। দেখি, তার হাতে সদ্য প্রকাশিত কিছু বই, বাংলার, কিছু সাহিত্যপত্র, দেশ, সানন্দা, আনন্দলোকসহ আরও কী কী পত্রিকা। মনে পড়ে, ১৯৯১ সালের সেই বয়সী সকালের হঠাৎ পাওয়া নেশাগ্রস্ত খুশির সব অস্থিরতা। আজও মনে পড়া মাত্রই মনে হয়, সেই দিনই তো, মাত্র সেদিনের সাতাশ বছর আগের, অনন্য সেই দিন।
উডসাইডের তার বইয়ের দোকান, নাম ‘মুক্তধারা’। মুক্তধারা নামটি শোনামাত্র চোখে ভেসে উঠল আমার একদার রমণীয় ঢাকা। মনে পড়ল ‘নলেজ হোম’, ‘ম্যারিয়েটা’, ‘হাক্কানি’ আর বাংলা বাজারের বইয়ের সারি সারি দোকান। মনে হলো, আমি ‘সব পেয়েছির দেশে’ নতুন এক উন্মেষ-বোধে আলোড়িত, জীবনের না-চাওয়া উন্মূলতার পথে আসা সব দুঃখবোধকে অতিক্রম করে বিপুল ছায়াতলে আশ্রিত হতে যাচ্ছি। এত দিন বাংলাকে মঞ্চে দেখেছি, ক্যাসেটে শুনেছি, কিন্তু বাংলার বহমান স্বরূপটি অনেক দিন দেখিনি, কে কী লিখছেন, কার কী বই, কত কত বই, এসব খবর থেকে যোজন যোজন দূরে থেকে ‘বাংলা’র ধারাকে আমি ‘অজানা’ করে তুলছি। সব হচ্ছে, আবার কী যেন হচ্ছে না, বিশ্বজিত সাহার উদ্দীপ্ত ও সময়োপযোগী এই কর্মযোগ, এই হচ্ছে-হচ্ছে না—এর মতো সংকটের আশু সমাধানের ইঙ্গিত দিল। এই প্রথম অনুভব করি, আমরা একের-সঙ্গে-আরেক যোগ হতে যাচ্ছি।
সত্তরের মধ্যভাগে আজকের জ্যাকসন হাইট্‌সের ৭৪ নম্বর সড়কের দুপাশে লাগোয়া সব বসত বাড়ি, ‘আইএসপি’ নামের একটি শাড়ির আর ‘স্যাম অ্যান্ড রাজ’ নামের একটি ইলেকট্রনিকসের দোকান এই সারিবদ্ধ বাড়িগুলোর মধ্যে ‘সাবকন্টিনেন্ট’-এর আবেদন জানাচ্ছে। উডসাইড বুলেভাডের একপাশে ‘উমা’ নামের আরেকটি শাড়ির আর উল্টোদিকে ‘শাহিন’ নামের কৌলিন্যহীন ছোট্ট একমাত্র উপমহাদেশীয় মিষ্টির দোকান (স্থানান্তরিত হয়ে এখনকার ‘ডেরা’), এই-ই। পরে আরেকটি শাড়ির দোকান হয়েছিল এলমহার্স্টের ব্রডওয়ের ওপর, ‘কামদর’। রিগো পার্কে ছিল ‘বম্বে সিনেমা’, বড় পর্দায় হিন্দি সিনেমার সেই সময়কার বিশাল বাণিজ্যিক আমন্ত্রণ। তখনো ভিসিআর আসি আসি করছে বা মাত্র এসেছে। আরও একটি দুটি দোকানপাট ছিল এই অঞ্চলে, সেসবের নামধাম বিস্মৃত হয়েছি।
আসি আসি সেদিনের ‘ভিসিআর’ একদিন এসে এখন বিলুপ্ত, কিন্তু বিকশিত হয়েছে আমাদের জীবনযাপনকে বাংলার নৈকট্যে এনে দিতে একে একে সব বাংলাদেশি বিপণি, নানা সামগ্রী-সম্ভারে ও বিচিত্রতায় আমাদের শহরের সকল প্রান্তে। মুক্তধারাও একসময় এল বাংলা-শোরগোলের প্রাণকেন্দ্রে, জ্যাকসন হাইট্‌সে এবং এই অবস্থিতি, এই ঠিকানায় হয়ে উঠল জরুরি।
আজ সব বিবেচনায় মুক্তধারার বর্তমান বই ও পত্র-পত্রিকায় ঠাসা দোকানটি হয়ে উঠেছে আমাদের নিউইয়র্কের আবশ্যিক একটি সাহিত্য কেন্দ্র। বইয়ের পর বইয়ে পরিবেষ্টিত হয়ে, আড্ডা, আলোচনা, পাঠক-লেখক মুখোমুখি বৈঠক, যা ছিল চিন্তার অতীত—তা ঘন ঘন ঘটছে। বাংলার খ্যাতনামা লেখকদের কে না এসেছেন এই মুক্তধারায়, পুস্তক-উষ্ণ-আমন্ত্রণে! সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কে না! এঁদের আগমন মুক্তধারায়, আমাদের অঞ্চলে তো বটেই, পুরো উত্তর আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে বাংলাদেশের বা পশ্চিম বাংলার বাইরেও, বাংলা ভাষা তথা ‘বাংলার’ আবহমান সৌন্দর্য কেবলই স্ফীত হচ্ছে, এই খবরটি বাংলাদেশি অভিবাসীর জীবনে এক উৎসাহের প্লাবন এনে দিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চিত্রটি এঁকেছেন এরকম, ‘মুক্তধারা নামে বইয়ের দোকানটিতে কখনো কখনো ঢাকা বা কলকাতা থেকে কোনো কোনো খ্যাতিমান লেখক যান, ক্রেতাদের বইয়ে স্বাক্ষর দেন। সে খবর পেলে শত শত মানুষ ছুটে আসে, অনেকে অফিসের কাজে ছুটি নিয়ে, কেউ কেউ একদিনের উপার্জন নষ্ট করে। লেখক স্বাক্ষরিত বাংলা বই সংগ্রহ করার জন্য এঁদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখার মতো। এঁদের অধিকাংশই অবশ্য বাংলাদেশি’ (আমি কি বাঙালি?)।’
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এই যে অনুগামিতার চাষাবাদ, এটুকু উভয় বাংলা থেকে বই এনে ও দিয়ে, শুধু এইটুকুতেই মুক্তধারার সাফল্য অসামান্য ও অসাধারণ হিসেবে চিরকালের জন্য শনাক্ত হয়ে থাকত, আমি এই বিবেচনা করি। কিন্তু, যে স্বপ্ন আমরা সবাই মিলে ২৭ বছর আগে দেখিনি, বিশ্বজিৎ সাহা সেই স্বপ্নকে, সেই ২৭ বছর আগেই আলো দিলেন। সেদিন তার পদক্ষেপের পথে যোগ দিয়েছেন আরও অনেকে। দিয়েছিলেন বলেই, আজ ফি বছরের ‘বই মেলা ও বাংলা উৎসব’ অভিবাসী বাংলাদেশির প্রাণে প্রাণে অপরিহার্য এক উপাত্ত হয়ে উঠে। এক মুক্তধারা আজ বই মেলায় এনে দিচ্ছে অনেক অনেক বইয়ের দোকান, নামি দামি লেখকের বই।
এই বইমেলা, এই বাংলা উৎসব, এই অভিবাসী সমাজ যে গৌরব গাঁথার আয়োজনে মনোযোগী, আজ বিশ্বের সর্বত্র এই খবর পৌঁছে গেছে। আমাদের জীবনভরের বিচ্ছিন্নতা—ভাষার, সংস্কৃতির, মনের, মননের, জীবনের, আত্মার, পাওয়া-না-পাওয়ার, প্রজন্মের, কাছের, দূরের—আজ একটু একটু করে, কাঁধে কাঁধ রেখে বিলীন হবে বলে প্রস্তুত। আর সব অভিবাসীর মতো আমিও ফিরে তাকাই, সময়ে-অসময়ে, আমার জীবনের এই শহরের সত্তর-আশির দশকের বাঁকে বাঁকে, নিজেকে দেখি, গলদঘর্ম আর তৃষিত হয়ে আমি একা একা বেঁচে থাকার আর্তি নিয়ে, শ্লথ হয়েও গতি সিক্ত, ক্লান্ত হয়েও অক্লান্ত আমার প্রবাসজীবন গমন। ভাবি, হবে, কোনো একদিন হবে। কিন্তু কী হবে, কেমন করে হবে তার কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। সেদিন আমার ভাবনা ছিল শুধুই স্বপ্ন তাড়িত। আজ সেই একই পথে বিস্ময়ে দেখি, স্বপ্ন উত্থিত এক মনন-স্পর্শী মোহর, আমাদের অভিবাসী মিছিলের অগ্রভাগে, সাতাশ বছর বয়সী মুক্তধারা, জ্বল জ্বল ধারণ করছে এই স্লোগান, ‘বই হোক আমাদের উত্তরাধিকার’।

লং আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক