সীমান্তজুড়ে শিশুদের আর্তনাদ

অভিবাসী শিশুদের প্রতি নির্মমতার প্রতিবাদে বুধবার মধ্যরাতে লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দরে ও নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে নাগরিক বিক্ষোভ। ছবি: রওশন আরা ও রয়টার্স
অভিবাসী শিশুদের প্রতি নির্মমতার প্রতিবাদে বুধবার মধ্যরাতে লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দরে ও নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে নাগরিক বিক্ষোভ। ছবি: রওশন আরা ও রয়টার্স

ঘরে-বাইরে চতুর্মুখী সমালোচনার পর অভিবাসী শিশুদের তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করার আইন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে হোয়াইট হাউস। ২০ জুন বিকেলে হঠাৎ করেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সীমান্তে আটক পিতা–মাতা থেকে সন্তানেদের বিচ্ছিন্ন না করার নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে এ সম্পর্কিত একটি আইন পাস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, শিগগিরই এমন কিছুতে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছি, যা অভিবাসী পরিবারকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হাত থেকে বাঁচাবে। ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা পরিবারগুলোকে একসঙ্গে রাখতে যাচ্ছি।’ তবে এই সিদ্ধান্তে আসতে বেশ কষ্টই হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। তিনি যে চাপে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা তাঁর বক্তব্যে সুস্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি সত্যি সত্যি মানসিকভাবে দুর্বল হন তবে পুরো দেশ মানুষে ভরে যাবে। আবার আপনি কঠোর হলে আপনাকে হৃদয়হীন হতে হবে। এটা উভয়সংকট।’

শুরু থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের কট্টর অভিবাসন-বিরোধী নীতি আমেরিকাজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু এই সমালোচনার মুখেও ট্রাম্প প্রশাসন এই অবস্থানে অটল ছিল। বিশেষত মেক্সিকো সীমান্তে চরম কঠোর হয়ে উঠেছে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) এজেন্টরা। আর এই কঠোর পদক্ষেপের কারণে সীমান্তে আটক হওয়া অভিবাসী শিশুদের তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছিল। ২০ জুন অবশেষে এই কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। অথচ এই নির্বাহী আদেশে সইয়ের আগের দিনও ট্রাম্প কিন্তু ঠিক উল্টো কথাই বলছিলেন। তাঁর মতে, শিশুদের পরিবার বিচ্ছিন্ন হওয়া বন্ধ করতে হলে কংগ্রেসকে একটি আইন পাস করতে হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ ‘নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নেওয়া যায় না’ বলেও সে সময় মন্তব্য করেছিলেন তিনি। কিন্তু পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ, ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান, মানবাধিকার সংগঠন, এমনকি ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প ও বড় মেয়ে ইভানকা ট্রাম্পের সমালোচনার মুখে তিনি সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হন।
নির্বাহী আদেশে সইয়ের পর দেওয়া ট্রাম্পের বক্তব্যেও বিষয়টি সুস্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘সীমান্তে কড়াকড়ি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে পিতামাতা থেকে সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি আমার পছন্দ হচ্ছে না। আমার স্ত্রীও খুব জোরালোভাবে বলেছে যে, এটা ভালো নয়। ইভানকাও এর বিরুদ্ধে। কিছু রাজনীতিবিদও নিশ্চয় এই পরিবর্তিত সিদ্ধান্তে খুশি হবেন। তবে আমি আশা করি সবাই এখন সমস্যাটা বুঝবেন এবং করণীয় ঠিক করতে মাঠে নামবেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষত ডেমোক্র্যাটদের এগিয়ে আসাটা জরুরি।’
চার পৃষ্ঠার এই নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প বলেছেন, অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে যারা ধরা পড়বে, তাদের বিরুদ্ধে আগের মতোই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে সেখানকার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হবে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে থাকা শিশুদের তাদের পরিবারের সঙ্গেই কীভাবে রাখা যায়, তা দেখা। এমনকি এ বিষয়ে মামলা চলাকালেও ওই শিশুরা যাতে তাদের পরিবারের সঙ্গেই থাকতে পারে সে ব্যবস্থা করা। এ জন্য সীমান্তে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে। তবে এই অবকাঠামো গড়ে তোলার সময় সীমান্তে আটক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে কী ঘটবে, তা আদেশে বলা হয়নি। একই সঙ্গে এই পরিবারগুলোকে কোথায় আটক রাখা হবে সে সম্পর্কও আদেশে কিছু বলা নেই। এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারাও অন্ধকারে আছেন।

অবৈধ অভিবাসী বাবা–মা থেকে সন্তানদের আলাদা করার ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির প্রতিবাদে নিউইয়র্কে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
অবৈধ অভিবাসী বাবা–মা থেকে সন্তানদের আলাদা করার ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির প্রতিবাদে নিউইয়র্কে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

তবে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ এলেও পরিবার বিচ্ছিন্নের ঘটনা বন্ধে এখনো কিছু আইনি বাধা রয়েছে। কারণ নির্বাহী আদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিবার বিচ্ছিন্ন না করার কথা বলার পাশাপাশি শিশুসহ পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে আটক রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু ১৯৯৭ সালের ফেডারেল আদালতের আদেশ অনুযায়ী, কোনো শিশুকে একটানা ২০ দিনের বেশি আটক রাখা সম্ভব নয়। কয়েক বছর আগে একই ধরনের অভিবাসী স্রোত শুরু হলে ১৯৯৭ সালে দেওয়া আদেশটি রদ করে বারাক ওবামা প্রশাসন শিশুদের তাদের পরিবারের সঙ্গে একই আটককেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এসে আগের আদেশটিই অনুসরণ শুরু করে। ওই আদেশটির বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ জানতে চেয়ে আবেদন করেছে অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্সের কার্যালয়। এ বিষয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট আদালতের বিচারক ডলি এম জি কিছুদিনের মধ্যেই আদেশ দেবেন।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে সীমান্তে এরই মধ্যে পরিবার বিচ্ছিন্ন হওয়া ২ হাজার ৩০০ শিশু সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বলা হয়েছে, এই শিশুদের তাদের পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়ার আপাতত কোনো সুযোগ নেই। তাদের অভিভাবকদের আগের জায়গাতেই আটক রাখা হবে। অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টার কারণে তাদের আইনের মুখোমুখি হতে হবে। এই আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলেই কেবল তারা পরিবারের সঙ্গে মিলতে পারবে।
এ বিষয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর স্বাস্থ্য ও মানবিক সেবা বিভাগের শিশু ও পরিবার বিষয়ক প্রশাসনের মুখপাত্র কেনেথ উলফ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘বিদ্যমান মামলাগুলোর ক্ষেত্রে শিশুদের পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নেবে হোয়াইট হাউস।’
তবে উলফ ভুল বলেছেন বলে দাবি করেছেন এজেন্সির যোগাযোগ পরিচালক ব্রায়ান ম্যারিয়ট। তিনি বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন হওয়া শিশুদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াটাই মূল লক্ষ্য। এ বিষয়ে কাজ করছে আইস। তবে বিষয়টি সহজ নয়। তাদের একটি পরিবার দেওয়াটাই এখন প্রথম কাজ।’
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ম্যারিয়টের ভাষ্য অনুযায়ী, ট্রাম্প প্রশাসন এখন পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুদের জন্য পরিবার খুঁজছে। তাদের সত্যিকারের পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়া এখনই সম্ভব না হলে, অন্তত আমেরিকায় বসবাসরত কোনো পরিবারে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা, তাই এখন খুঁজে দেখছে ট্রাম্প প্রশাসন।
এ বিষয়ে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের লি গ্যালার্নট নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না কেউ শিশুদের দীর্ঘদিন বন্দী দেখতে চায়। প্রশাসন যদি পরিবারগুলোকে বন্দী রাখতে চায়, তাহলে এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রেসিডেন্ট নিজের আইনি দুর্বলতা ঢাকতে শিশুদের বন্দী করতে চান। এটা রীতিমতো পাগলামি। এ ক্ষেত্রে সেরা সমাধানটি হতে পারে, কোনো আমেরিকান পরিবারের তত্ত্বাবধানে আটক পরিবারগুলোকে রাখা, কিংবা আমেরিকার অভ্যন্তরেই কমিউনিটির মধ্যে এসব পরিবারকে নজরদারির মধ্যে রাখা। এতে ব্যয়ও কম হবে। আর এটা মানবিকও।’
এদিকে সীমান্তে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শিশুদের গোপনে অন্যত্র স্থানান্তর করা হচ্ছে এমন খবরে ২০ জুন রাতেই বিভিন্ন ইমিগ্রান্ট গ্রুপ নিউইয়র্কের লাগার্ডিয়া বিমানবন্দর ঘেরাও করে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। বিক্ষোভে যোগ দেন নিউইয়র্ক নগরীর মেয়র কার্যালয়ের প্রতিনিধি নিকোলাস, কাউন্সিল মেম্বার জুমানি উইলিয়াম ও ব্রাড লেনডার, নগরীর মহাহিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা, মুসলিম নাগরিক সংগঠক লিন্ডা সারসার, ইমিগ্রেশন কোয়ালিশনের অ্যাড ক্রিস্টিনা, দেশি’স রাইজিং আপ অ্যান্ড মুভিংয়ের (ড্রাম) কাজী ফৌজিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সংগঠকেরা।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও জানান, পরিবার বিচ্ছিন্ন ২৩৯ জন শিশুকে এরই মধ্যে গোপনে নিউইয়র্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেডারেল কর্তৃপক্ষের এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ড্রামের পরিচালক কাজী ফৌজিয়া প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে বলেন, ‘আমরা বিমানবন্দরে অবস্থান নিয়েছি। আজকের এই জমায়েত প্রশাসনের, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে।’