নিউইয়র্ক টু সিলেট

দ্বিতীয় কিস্তি

হোটেল ফরচুন গার্ডেনে চেক ইন শেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি চারটা বাজে। নাতি নাদিমকে বললাম, আমার সঙ্গে চলো, সিলেট মিলনায়তনে যাব। সে একটি সিএনজি অটোরিকশা ডেকে নিয়ে এল। কুমার পাড়া, চৌহাট্টা হয়ে কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেলাম সিলেট মিলনায়তনে। হলে ঢুকে দেখি সামনের সারিতে কয়েকজন বসে আছেন। কয়েকজন আমার বয়সী, শ্মশ্রুমণ্ডিত। নাদিম সামনের এক চেয়ারে আমাকে বসিয়ে দিল। কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলাম। কাউকে চিনি না। কেমন করে চিনব? ৩০-৩৫ বছরের বছরের ব্যবধান। এখন সাংবাদিকতা করছেন, এমন অনেকের বয়স ত্রিশের নিচে। অস্বস্তি কেটে গেল, যখন হলে ঢুকে বদর উদ্দিন কামরান (সাবেক মেয়র) জড়িয়ে ধরলেন। গল্পে মেতে উঠলাম আমরা।
সামনের আসনেই বসা শ্মশ্রুমণ্ডিত আ ন শফিকুল হক এগিয়ে এলেন। বললেন মাহবুব ভাই, কত বছর পর দেখা! এগিয়ে এলেন মালেক খান, শ্মশ্রুমণ্ডিত। আমেরিকায় যাওয়ার আগে তাঁর নাট্য সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাকে বিদায় জানিয়েছিলেন। বললেন, এতক্ষণ আমি ভেবেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক, এই অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছেন। এখন দেখি আমাদের মাহবুব ভাই। সিলেট প্রেসক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এম এ হান্নান তাঁর প্রকাশিত দৈনিক সিলেট বাণীর একটি কপি হাতে দিয়ে বললেন, আপনি সময় দিন, আমরা একসঙ্গে বসতে চাই। এক তরুণ পাশে এসে বসলেন। সম্ভবত তাঁর সঙ্গে এই প্রথম দেখা। নাম ইকবাল মাহমুদ, তিনি একাত্তর টিভির প্রতিনিধি ও সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। বললেন, মাহবুব ভাই, আপনাকে নিয়ে আমরা ক্লাবে আড্ডা দিতে চাই। বললাম, অবশ্যই আড্ডায় যাব। ওই ক্লাবতো আমারই।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সাড়ে চারটায় অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে না। বদর উদ্দিন কামরান বললেন, মনে হচ্ছে দেরি হবে। খুব ক্লান্তি বোধ করলে চলে যান। বিদায় নেওয়ার জন্য আহমেদ নূরকে খুঁজছিলাম। হলের বাইরে এসে দেখি কামরানও প্রস্থান করছেন। এ সময় ঢাকার অতিথিরা হলে প্রবেশ করছেন। নামটা মনে রাখতে পারছিনা, যুগান্তরের প্রতিনিধি। এসে বললেন, আপনারা যাবেন না। এখনই অনুষ্ঠান শুরু হবে। আহমেদ নূরের স্বগত বক্তব্যের পর বদর উদ্দিন কামরান এবং মাহবুবুর রহমান বলবেন। হলোও তাই। আহমেদ নুর পত্রিকা প্রকাশের প্রেক্ষাপট সুন্দর করে উপস্থাপন করলেন। আমি যুগভেরীর প্রাণ পুরুষ আমীনুর রশীদ চৌধুরীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকেই স্মরণ করছিলাম। ১৯৭৩ সালে যখন যুগভেরীতে আমার হাতে খড়ি তখন রশীদ চৌধুরী বলেছিলেন, সাংবাদিকতার পথ বড় কঠিন ও কষ্টকর। সাংবাদিকদের এক পা ঘরে, আরেক পা জেলে রাখতে হয়। এটা মেনে নিতে পারলে থাকো, না হলে বয়সে এখনো তরুণ। অন্য কোনো পেশা বেছে নাও। অনুষ্ঠানে তাঁর সেই কথা বলে বক্তৃতায় বলছিলাম, সাংবাদিকতাকে শুধু একটি পেশা হিসেবে না নেওয়ার অনুরোধ জানাই। টক শো’তে আসিফ নজরুলের সাহসী বক্তব্যের প্রসঙ্গ উল্লেখকালে দর্শক সারিতে যে প্রতিক্রিয়া হয়—তাতে বোঝা যায়, তিনি বেশ জনপ্রিয়।
শুনে ভালো লাগল, সিলেট শহর থেকে এখন ১০টি দৈনিক পত্রিক বের হয়। স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের শুরুতে যুগভেরী, দেশ বার্তা ও জনশক্তি—এই তিনিটি সাপ্তাহিক ছিল। পরে এল সিলেট সমাচার, সিলেট কণ্ঠ, জালালাবাদ। ফয়জুর রহমান বের করলেন প্রথম দৈনিক সিলেটের ডাক। এরপর এল আবদুল ওয়াহেদ খানের দৈনিক জালালাবাদী। এবার তাঁদের দুজনের সঙ্গেই ফোনে কুশল বিনিময় হলো।
১৮ বছর পর অনুষ্ঠানে দেখা হলো শ্রদ্ধেয় ফাহমিদা রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে। আম্বরখানার জ্যোতি মঞ্জিলে ঢুকে অবাক হই, বাড়ির সাজসজ্জা, পরিবেশ, কাঠামো-৩৩ বছর আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি অটুট যেন এক অমলিন ঐতিহ্য। সামনের বাগান, লন, প্রশস্ত বারান্দা। ওই বারান্দার যে সোফায় আমীনুর রশীদ চৌধুরী বসতেন, সেই সোফা অবিকল তেমনি আছে। সামনে টেবিল, টেবিল ঘিরে আরও তিনিটি চেয়ার। ভেতরে ডাইনিং টেবিল, সেই আগের মতো। বারান্দায় গিয়ে মনে হলো, একটু অপেক্ষা করি, এখনই আসবে আমীনুর রশীদ চৌধুরী। বলবেন, মাহবুব বসো। মুহূর্তে সংবিৎ ফিরে পেলাম। বের হলো দীর্ঘশ্বাস। খুশি হলাম ফাহমিদা রশীদ চৌধুরীকে দেখে। তিনি সুস্থ, সজীব এবং প্রাণবন্ত। তাঁর স্নেহের বাঁধন কত আন্তরিক—তা নতুন করে উপলব্ধি করলাম। সিলেটের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা ও নারী আন্দোলনে ফাহমিদা রশিদ চৌধুরীর অবদান অপরিসীম।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক