নিউইয়র্ক দর্শন

সাপলুডু খেলা
আমরা সামাজিক মানুষেরা জীবনের প্রয়োজনে বারবার স্থানচ্যুত হই। এখানে-ওখানে, স্থানে-অস্থানে জীবনকে বারবার প্রথম থেকে শুরু করি। নিজের নাম-পরিচয় এভাবে প্রথম থেকে পুনঃ পুনঃ শুরু করাকে আমাদের কাছে বারবার শৈশবের সূচনার মতো মনে হয়।
ভরা সুরমার জল-জোছনা আর মেঘালয়-উপত্যকাবর্তী না গ্রাম না শহর সুনামগঞ্জ ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যাই রাজশাহীর মতিহার সবুজে। ওখানেও যথারীতি নাম কী, বাড়ি কোথায়? কী পড়ি, কী করি দিয়ে শুরু হয় জীবনের আরেক শৈশব। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে পেশা ও জীবিকার প্রয়োজনে এখানে-ওখানে পুনঃ পুনঃ শৈশবের সূচনা করে নিউইয়র্কে শুরু হচ্ছে জীবনের নতুন শৈশব। মানুষের জীবন বড় বিচিত্র। প্রবহমান নদীর মতো এর বাঁকে বাঁকে কেবলই শুরু ও শেষের কাহিনি। জীবনে এ যেন এক চিরন্তন সাপলুডু খেলা।

ধনী দেশের দীনতা
৬ মে ২০১৮, সকাল আটটার মতো হবে। ‘আকাশে তখন সূর্যের সঙ্গে মেঘেরা করিছে খেলা’। জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে নেমেছি মিনিট বিশেক আগে। অপেক্ষা করছি লাগেজের জন্য। লাগেজ নিতে ট্রলি লাগবে। মেয়েদের বললাম ট্রলি নিয়ে আসতে। বড় মেয়ে ফিরে এসে বলল, ট্রলি আনতে টাকা লাগবে, প্রতি ট্রলি ৬ ডলার! শুরুতেই মৃদু ধাক্কা! যাত্রীদের মালপত্র নির্বিঘ্নে পার্কিং স্পট পর্যন্ত নিতেও টাকা দিতে হবে! বাংলাদেশ অনেক দরিদ্র দেশ, তবু যাত্রীর প্রতি এ রকম অসৌজন্যতাবোধের বহিঃপ্রকাশ ওখানে নেই।

অভিবাসী: অভিভাষী
আমেরিকা হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ। বিশ্বের বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির লোকজনের বাস এখানে। শত শত বছর ধরে এই বহুমুখী বৈচিত্র্যের শক্তিতে, সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হয়েছে এই ভূখণ্ড, বৈচিত্র্যের মধ্যেই রোপিত রয়েছে এর ঐক্যের বীজ।
তবে এঁদের ‘ইংরেজি’ একজন আগন্তুকের কাছে শুরুতে বেশ দুর্বোধ্য ঠেকে। এখানে বিভিন্ন ভাষা-ভাষী, জাতিগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এঁদের সবার বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ-সক্ষমতা এক রকম নয়। একজন ভারতীয় যে অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলে অভ্যস্ত বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, একজন আরব, একজন চীনা, হিস্পানিক বা আফ্রিকানের উচ্চারণ ও বলার ধরন নিশ্চয়ই এক নয়। অভিবাসীদের উচ্চারণগত ভিন্নতা এবং উচ্চারণ-সক্ষমতার অভাবই কী এ অবোধগম্যতার প্রধান কারণ? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না।
সামরিক ব্যয়: সামাজিক ব্যয়
নিউইয়র্ককে জেনেছি আমেরিকার অঙ্গরাজ্য হিসেবে নয়, পৃথিবীর রাজধানী হিসেবে। জাতিসংঘ ভবন, বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র, ওয়াল স্ট্রিট সবই তো এখানেই। এ বিশ্ব নগরীর সিংহভাগ রাস্তাঘাট ও মেট্রো স্টেশন যথেষ্ট বিপর্যস্ত আর অপরিচ্ছন্ন। যে দেশ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে সামরিক খাতে, সে দেশের মধ্যে এমন বিব্রতকর অসংগতি চোখে লাগে বৈকি। এ দেশের জনপরিবহন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরও অনেক উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও পরিবর্তনের সূচনা হওয়া সময়ের চাহিদা এখন।

স্টেট ব্র্যান্ডিং
নিউইয়র্কের রাস্তায় আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গাড়ির নেম-নাম্বার প্লেট দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নেমপ্লেটধারী গাড়িতে নাম্বারের নিচে লেখা থাকে দা এম্পায়ার স্টেট, নিউজার্সি রাজ্যের গাড়িগুলোর নেমপ্লেটে আছে দা গার্ডেন স্টেট, শুনেছি ফ্লোরিডা রাজ্যের গাড়িতে উৎকীর্ণ রয়েছে দা সান শাইন স্টেট। পরিচিতিমূলক প্রধান বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে প্রতিটি প্রধান নগরীকে এভাবে ব্র্যান্ডিং করার এ ধারণাটি সত্যিই অভিনব। একই সঙ্গে দূরদর্শী এবং পর্যটন-প্রসারীও বটে।

পরধর্ম-পরমতসহিষ্ণুতা
এত কিছুর পরও পরমত আর পরধর্মসহিষ্ণুতার আদর্শ দৃষ্টান্ত নিউইয়র্ক। নিউইয়র্ক নগরীতে অনেক প্রাচীন, বৃহৎ ও দৃষ্টিনন্দন চার্চ যেমন নজর কাড়ে, হাঁটতে-চলতে মন্দির, মসজিদও চোখে পড়ে। বড় মন্দিরগুলোর প্রায় সবই ভারতীয় হিন্দুদের ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগত দানের অর্থে নির্মিত। আমাদের উপমহাদেশীয় অভিবাসী-অধ্যুষিত মুসলিম এলাকাগুলোতে বেশ কটি মসজিদও গড়ে উঠেছে এবং ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ যথারীতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও চালু রয়েছে। পবিত্র রমজানের শুরুতে চলতি পথে নাম-অজানা এক চার্চের ডিজিটাল বোর্ডে চোখ আটকে গিয়েছিল। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমজানের শুভেচ্ছা জানানোর সেই বার্তাটি ছিল পরধর্মসহিষ্ণুতার উত্তম উদাহরণ।
যত মত, তত পথ, তত পত্রিকা
পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলার পর প্রবাস বাংলার মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক বাংলা সংবাদপত্র সম্ভবত নিউইয়র্ক থেকেই প্রকাশিত হয়। দোকানপাটে, রাস্তাঘাটে, ধর্মালয়ে অন্য কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষীর পত্রপত্রিকা নজরে না এলেও বাংলা সংবাদপত্রের ছড়াছড়ি। সাইজে ট্যাবলয়েড হলেও এগুলোর কলেবর যথেষ্ট বড় (অন্যূন ষাট থেকে শতাধিক পৃষ্ঠা)। বিজ্ঞাপননির্ভর পত্রিকাগুলোর প্রায় সবই বিতরণ করা হয় বিনা মূল্যে। প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ১৯। শত মত ও শত পথ যে আবহমান বাংলার যুগপৎ শক্তি ও দৌর্বল্যের দিক, তা এ পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা এবং সংবাদ পরিবেশনার মধ্যেই সন্নিহিত রয়েছে।

শ্রমের মর্যাদা
নিউইয়র্ককে বলা হয় ল্যান্ড অব অপরচুনিটি। এখানে সময় ও সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। নিউইয়র্কাররা কাজ পাগল জাতি। সব কাজকে এরা সম্মান করে। স্কুলে ‘শ্রমের মর্যাদা’ বলে যে শব্দটি শুনেছিলাম, তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি এখানে এসে। প্রবাসী মানেই ওসি (ওনিওন কাটার) ও ডিসি (ডিশ ক্লিনার ) হিসেবে যে ধারণাটি সমাজের একাংশের কাছে এখনো জনপ্রিয়, তা যে সর্বাংশে অসত্য-প্রায়, তা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করা যায় এখানে এলে। এখানকার বাংলাদেশিরা সদর্পে মূলধারায় ঢুকে পড়ছে। ব্যবসা, বাণিজ্য, সরকারি চাকরি, সমাজকর্ম, সাংবাদিকতাসহ জাতীয় রাজনীতি ও আইন পেশায় দাপটের সঙ্গে কাজ করছে।

ওপি এবং ডিভি লটারি
ঢাকা-সিলেট-ঢাকা রুটে ‘লন্ডন এক্সপ্রেস’ নামে একটি আধুনিক কোচ সার্ভিস চালু হয়েছে। চেন্নাই এক্সপ্রেস, রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেসের আদলে এ নামকরণের পেছনে সিলেট ‘দ্বিতীয় লন্ডন’ (লন্ডনপ্রবাসী লোকজনের আধিক্যের কারণে) এমন পূর্বধারণা বা ভাবনাচিন্তা কাজ করে থাকতে পারে।
অবশ্য এ ধারণা সর্বাংশে অসত্য নয়। প্রথমবার লন্ডনে গিয়ে তেমন ধারণা সবারই হয়। নিউইয়র্কে আসার আগে ট্রেন, বাস, হাটবাজারে গিয়ে ভাববিনিময়ের মাধ্যম নিয়ে খানিকটা বিচলিত ছিলাম। কিন্তু এখানকার বাস্তব অভিজ্ঞতা একেবারে ভিন্ন। ব্যস্ত এ বিশ্ব নগরীর কুইন্স, ব্রঙ্কস, ব্রুকলিন, ম্যানহাটন বরোতে চলতে-ফিরতে গিয়ে এত বেশি বাঙালির (বিশেষত সিলেটি) দেখা মিলেছে যে মনে হয়েছে ইংরেজি বা বাংলা না জানলেও (শুধু সিলেটি জানা থাকলেই) এখানে চলাফেরা করা সম্ভব।
চলতি পথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজনের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই এসেছে ওপি ও ডিভি লটারির মাধ্যমে। ওপি ও ডিভি লটারি কার্যক্রম না থাকলে অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সিলেটিদের সংখ্যা হতো ৯৫ শতাংশের বেশি। সে বিবেচনায় নিকট ভবিষ্যতে ‘লন্ডন এক্সপ্রেস’-এর আদলে সিলেট-ঢাকা-সিলেট রুটে ‘নিউইয়র্ক এক্সপ্রেস’ চালু হলে বিয়ানীবাজারবাসী নিউইয়র্কাররা নিশ্চয়ই অখুশি হবেন না।
লেখক ইডেন কলেজের শিক্ষক ও ঢাকায় কর্মরত বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা