চিত্তরঞ্জন সাহা: স্মৃতিতে সম্ভ্রমে

চিত্তরঞ্জন সাহা
চিত্তরঞ্জন সাহা

আশির দশকের গোড়ার দিকে কবি নজরুল সরকারি কলেজে অধ্যয়নকালে পুরোনো ঢাকা চষে বেড়ানো ছিল আমার অবসর সময়ের অন্যতম শখ। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, সিনেমা দেখা, মনোহর স্থানগুলো পরিদর্শন আর বিমুগ্ধ আমোদে মেতে থাকা। সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, ধূপখোলা, কুলুটোলা, কাঠের পুল, ফরাশগঞ্জ, প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, বাহাদুর শাহ পার্ক, আহসান মঞ্জিল, লালকুঠি, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, শাঁখারীপট্টি, চকবাজার, লালবাগ, আজিমপুর তারুণ্যোদ্দীপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি অমলিন। প্রাণবন্ত ঢাকা শহরের প্রতিটি পান্থপথ যেন এখনো হাতের মুঠোয়। মনে হয়, চোখের আলোয় মুগ্ধ নয়নে অনায়াসেই দেখি আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার রূপ।
চিত্তরঞ্জন সাহাকে চিনি স্বাধীনতা-উত্তর নবচেতনার সেই কিশোরবেলা থেকে, যিনি ছিলেন সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘মুক্তধারা’ এবং পাঠ্যবই কেন্দ্রিক পুথিঘর লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক। সৃজনশীল প্রকাশনা জগতের কিংবদন্তি প্রকাশক, যার মাধ্যমে বাংলা প্রকাশনা শিল্পের জাগরণ সৃষ্টি হয়। পুরো বাংলাদেশেই ছিল তাঁর পরিচিতি।
সমাজের উচ্চমার্গের মানুষ ছাড়াও সব স্তরের কবি-সাহিত্যিক ও লেখক চিত্তরঞ্জন সাহার কাছে আসতেন। মৌচাক ঘিরে যেমন মৌমাছির আনাগোনা তেমনই বাবু চিত্তরঞ্জন সাহার কাছে সুশীলজন সেভাবেই আসতেন। তিনি সাধ্যমতো প্রায় সবার বই প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতার পর নব্বইয়ের দশকের শেষ অবধি কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে এত বেশি সংখ্যক বই বের হয়নি। মুক্তধারা থেকে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য ছাড়াও বিষয়বৈচিত্র্যে সমুজ্জ্বল প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সমস্যা, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর বই বের হতো। মুক্তধারার মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা জগতের সংকট কিছুটা হলেও দূরীভূত হওয়ার পথ খুলে গেল।
চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় প্যারিদাস রোডের মুক্তধারার মূল লাইব্রেরিতে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র লালসালু, শাহেদ আলীর জিব্রাইলের ডানা, ফজল শাহাবুদ্দীনের সম্ভবত সান্নিধ্যের আর্তনাদ কবিতার বই কিনেছিলাম। কাউন্টারে তিন/চারজন লোক কর্মরত। হঠাৎ সৌম্য শান্ত গোছের একজন ফরসা ভদ্রলোক কাউন্টারে ঢুকে তোয়ালে ঘেরা চেয়ারটিতে বসলেন। আমার কৌতূহল দৃষ্টি তাঁর দিকে। ততক্ষণে মনের কুয়াশাজাল দূর করে বুঝতে বাকি রইল না যে, ইনিই চিত্তরঞ্জন সাহা।
মূল্য পরিশোধ করে বইয়ের প্যাকেটটি হাতে নিয়েছি। হঠাৎ অত্যন্ত শান্তভাবে স্থির নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। যুবক, বইগুলো কি নিজে পড়ার জন্য? উত্তরে আমি তাঁর দিকে সচকিত তাকিয়ে বললাম, জি! তিনি আমাকে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের উপন্যাস দুই সৈনিক এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই বইটি পড়ে দেখ। আমি কাউন্টারের সেলসম্যানকে কত টাকা প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন, টাকা লাগবে না! এটি গিফট। তুমি যখন ইচ্ছে আসবে তোমার পছন্দের বই নেবে। নির্ধারিত কমিশনের পরও ১০% কম মূল্য আমার থেকে নেওয়ার জন্য তিনি বিক্রেতাদের বলে দিলেন।
সেই অনুপম দৃশ্যের কথা আজীবন মনে থাকবে। যার ফলে বই পড়ার প্রতি আমার ভেতরে উদ্যম উদ্দীপনে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করেছিল। সত্যিই তারপর থেকে যতবার বাংলাবাজার যেতাম মুক্তধারায় যেতে ভুল হতো না।
এমনই দৃষ্টি নন্দন মহৎ মানুষ চিত্তরঞ্জন সাহা, যাঁর সঙ্গে এভাবেই সম্পর্ক গড়ে উঠল। সেই সব মায়া-মোহ স্মৃতির কথা কখনো ভুলবার নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার মননধর্মী শিল্প-সাহিত্যের উন্মেষ ও সৃজনশীল প্রকাশনার মূর্ত প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। অসীম সাহস ও উদ্যমে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মুক্তধারা প্রকাশনা সংস্থাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করল। নবীন বাংলাদেশের অনেক সমস্যা ও সংকটের মধ্যেও মুক্তধারা থেকে সহস্রাধিক বই প্রকাশ করে যেন দেশের প্রকাশনা জগতের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দিল।
আর বইমেলার কথা উঠলে তো সর্বাগ্রে বাবু চিত্তরঞ্জন সাহার অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে। বাংলাদেশের নবীন, প্রবীণ লেখক-সাহিত্যিক ও অগ্রসর পাঠকদের সুপ্রসারের লক্ষ্যে চিত্তরঞ্জন সাহা ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত মুক্তধারা ছিল পথিকৃতের ভূমিকায়। ১৯৭৫ সালে প্রথমে বাংলা একাডেমির বইমেলার নেতৃত্ব দান এবং একই বছর পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বইমেলার মাধ্যমে তিনি যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তারই ধারাবাহিক ফলশ্রুতিতে অমর একুশের মাসব্যাপী বইমেলা ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক জেলা ও বিভাগে বর্তমানে সাড়ম্বর বইমেলার আয়োজন হয়ে থাকে। এ ছাড়া কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের প্রকাশনার অংশগ্রহণ হয়ে থাকে।
সৃজনশীল প্রকাশনা ছাড়াও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনার বিপণন সংক্রান্তেও চিত্তরঞ্জন সাহার অবদান রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতির (যার সদস্য সারা দেশে) সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরা অনেকেই পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্য ছিলাম।
তেমনই বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নয়ন ও ভারতের পাইরেসি বইয়ের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার সর্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য বিপণন ব্যবস্থা জোরদার করা এবং জাতীয় গ্রন্থোন্নয়নে সরকারের গ্রন্থনীতির আধুনিক নীতি প্রণয়নের ব্যবস্থাদি ইত্যাদির দিকে অগ্রসরমাণ বিধি প্রণয়ন এবং দেশের সর্বত্র বইমেলায় সরকারের সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাহিত্য প্রকাশের কর্ণধার মফিদুল হককে সভাপতি করে এবং ইউপিএলের মহিউদ্দীনকে সহসভাপতি এবং পর্যায়ক্রমে বাংলাবাজারের সৃজনশীল প্রকাশনায় অগ্রসরমাণ প্রকাশনা সংস্থার সমন্বয়ে যেখানে আগামী, কাকলি, সময়, মাওলা ব্রাদার্স, প্রতীক, বিদ্যা প্রকাশ, দিব্য প্রকাশ, অনুপম প্রকাশনী, বিউটি বুক হাউস, স্টুডেন্ট ওয়েজ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, সূচিপত্র অনন্যা ও বাড পাবলিকেশনসসহ অন্য প্রকাশনার মালিকদের নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়। এখানেও চিত্তদার অনেক উৎসাহ ও প্রেরণা ছিল।
আশির দশকের শেষ দিকে বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষে ঢাকায় ফিরে ধানমন্ডির ৭ নম্বরে ইনলাইটন প্রি-ক্যাডেট স্কুল করেছিলাম। একই সঙ্গে মতিঝিলে পত্রিকা ও বাংলাবাজার কেন্দ্রিক প্রকাশনা ব্যবসায় জড়িয়ে গেলে চিত্তদার উৎসাহে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘বাড পাবলিকেশনস’ ও ‘বাড কম্পিউটার’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান শুরু করি। প্যারিদাস রোডে (মুক্তধারার কাছাকাছি) ‘বাড’-এর কাউন্টারে তখন চিত্তদাকে অনেকবার পেয়েছি। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি বইমেলায় মুক্তধারার স্টল থেকে তিনি ‘বাড’-এ আসতেন। আমাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছেন। সব সময়ই খোঁজখবর নিতেন। ১৯৯৮ সালের শেষদিকে আমি যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে চিত্তদার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতাম। এ সময়ের পর থেকে মুক্তধারার ব্যবসায় ঘাটতি শুরু হয়ে যায়। তাঁর ভেতরে কেমন যেন নীরবতা পরিলক্ষিত হতো। যেটি আগে কখনো দেখা যায়নি।
চিত্তদার উদ্যমপূর্ণ আগেকার ঔজ্জ্বল্য কমে গিয়ে ম্লান মনে হতো। মুক্তধারা ও পুথিঘরের প্রচুর মানুষের কর্ম-কোলাহলও অনেকটা থেমে গেল। হয়তো নিজের লোকদের কোনো কোনো অবিশ্বস্ততা এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তাদের অবহেলাজনিত কারণে তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন। ফলে ব্যবসার মন্দাভাব আর ঘনায়মান ধস তাঁকে আরও বেশি উৎকণ্ঠিত করে তুলেছিল। এর চেয়ে বেশি মন্তব্য না করাই শ্রেয়। ২০০০ সালের পর বৌদি অর্থাৎ চিত্তদার সহধর্মিণীর অসুস্থতায় চিত্তদার মনোবল ভেঙে চুরমার হয়ে গল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। পরবর্তীতে চিত্তদা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
নব্বইয়ের দশকের পর যখন প্রকাশনা শিল্পের প্রসার তুঙ্গে এবং বাংলাবাজার কেন্দ্রিক কোনো কোনো প্রকাশক বিত্তবৈভবের সন্ধান পেয়ে গেছেন, সে সময়টায় আমি নিউইয়র্ক চলে আসি। তেমনই বলা যায়, তারপর থেকে চিত্তদার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঝিমিয়ে পড়া ও মুক্তধারার ব্যবসায় ভাটা পড়তে শুরু করে।
ঢাকায় থাকাকালে কয়েকটি অনুষ্ঠানে চিত্তদার সঙ্গে ছিলাম। একবার নন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর একটি অনুষ্ঠানে চিত্তদার সঙ্গে মঞ্চে বসার সৌভাগ্য হয়েছিল। এমন অনেক টুকরো স্মৃতিময় গল্পের প্রহেলিকা হৃদয়কে ব্যাকুল করে তোলে। তাঁর শুভ্র শান্ত মুখাবয়ব আর মৃদু কথার ছবি এখনো চোখের আলোয় ঝলমল করে ভাসে। আমাদের মাটি ও মানুষ আর দেশের প্রতি তাঁর ঐশ্বর্য ও গভীর মমত্ববোধ ও নিবিড় সম্পর্কের কথা কখনো ভুলবার নয়।
হ্যাঁ! মানুষের আত্মা অমর। শারীরিক কিংবা দৈহিক মৃত্যু হলেও ওই অবিনশ্বর অমরত্বই মানুষকে পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখে এবং মূলত তাই মানুষের আসল পুঁজি।
বাংলাদেশের কিংবদন্তি প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহাও তেমনই অমর ও অনির্বাণ। কখনো তাঁর অবদানের কথা বিস্মৃত হওয়ার নয়। তবু কোনো কোনো মানুষের জন্য খোদার কাছে আমাদের এমন আকুতি থাকে। যেমনটি কবিগুরুর ভাষায়, ‘যদি এ আমার হৃদয়-দুয়ার/ বন্ধ রহে গো কভু/ দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে/ ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।’ অতএব, প্রিয় মানুষদের টানে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমে সর্বদাই যেন আমাদের হৃদয় দুয়ার সব সময় খোলা থাকে। তেমনই বাবু চিত্তরঞ্জন সাহার আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।