নিউইয়র্ক বইমেলার টুকরো স্মৃতি

মুক্তধারার বইমেলা এখন আক্ষরিক অর্থেই মিলনমেলা, বাঙলা ও বাঙালির। নিউইয়র্কে আয়োজিত এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বই সম্পৃক্ত আলোকিত মানুষদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য আমি লক্ষ্য করি। বই লেখা, বই প্রকাশ ও বই পাঠ করা মানুষের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে এ সময় নিউইয়র্ক থাকে সরগরম। বেশ কয়েক বছর ধরে আমিও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি এই ‘বই উৎসবে’।
বইমেলাকে আমি কখনোই শুধু বই কেনাবেচার মেলা বলে মনে করি না। বইমেলা আসলে বইকে কেন্দ্র করে একটা মেলা। আর মেলা মানেই বিপুল জনসমাগম। আর যেখানেই জনসমাগম সেখানেই নানান রঙের উপস্থিতি, নানান বিষয়ের উপস্থিতি। নানান অনুষঙ্গ যুক্ত হয় একটা মেলায়। যে কারণে নিউইয়র্কের বইমেলায় বইয়ের স্টলের পাশাপাশি থাকে শাড়ি-পোশাক-পিঠাপুলিসহ নানান রকম স্টল।
মুক্তধারার বইমেলায় কত টাকার বই বিক্রি হয়, তার ওপর এর সাফল্য নিরূপণ করতে রাজি নই আমি। বইকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির যে জাগরণ বা আলোড়ন সেটাও অমূল্য। প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনে এই বইমেলা যেন বা ভীষণ খরায় এক পশলা বৃষ্টির মতো।
আমি নিজেই তো নিউইয়র্ক বইমেলায় বই কিনতে ছুটে যাই না। বরং আমি যাই আমার আত্মার আত্মীয় বইয়ের মানুষদের সান্নিধ্য পাওয়ার আকর্ষণে। ঢাকা থেকে আমার লেখক ও প্রকাশক বন্ধুরা আসেন। আসেন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় লেখক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। ভারত থেকেও আসেন প্রিয় লেখকেরা। মূলত তাঁদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডার লোভই আমাকে সেখানে টেনে নিয়ে যায়।
গত কয়েক বছরে এ রকম কতজনের হীরকদ্যুতি সান্নিধ্যই না পেলাম! আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শামসুজ্জামান খান, শহীদ কাদরী, সেলিনা হোসেন, রামেন্দু মজুমদার, ফরিদুর রেজা সাগর, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কিংবা পবিত্র সরকার। নক্ষত্রপ্রতিম এই মানুষেরা নানাভাবে দীপান্বিত করেছেন আমার জীবনকে। এসব প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা করতে প্রয়োজনে আমি সাত সমুদ্র পাড়ি দিতেও প্রস্তুত। তুলনায় অটোয়া থেকে নিউইয়র্ক তো বাড়ির কাছে আরশীনগর!
বাংলাদেশের মানচিত্রের উল্টো পিঠে কানাডায় থাকি বলে এমনিতেই মন খারাপ থাকে। স্বদেশ স্বদেশ বলে এক ধরনের হাহাকার জাগরুক থাকে বুকের গহিনে। তখন বাংলাদেশ থেকে উড়ে আসা প্রিয় একজন মানুষই আমার কাছে হয়ে ওঠেন একটা বাংলাদেশের মতন। তাঁদের একটু ছুঁয়ে দিয়ে আমি আমার বাংলাদেশকেই ছুঁয়ে ফেলি যেন। তাঁরা সেটা বুঝতেও পারেন না। গোপনে আমি মুগ্ধ হই, গোপনে আমি ঋদ্ধ হই। গোপনে আমি সংগ্রহ করি বিপুল ফুয়েল। প্রবাসের নিস্তরঙ্গ প্রাত্যহিক যাপিত জীবনে সেই ফুয়েল আমাকে সজীব সতেজ রাখে। আমি উজ্জীবিত হই। আমি জীবিত থাকি। আমি প্রাণবন্ত থাকি।
মুক্তধারার বইমেলায় আসি বলেই তো আমার সঙ্গে আমেরিকায় বসবাসকারী প্রিয় বন্ধুদেরও সাক্ষাৎ ঘটে অনায়াসে। সাঁজোয়া তলে মুরগার লেখক হালের চলচ্চিত্র নির্মাতা আনোয়ার শাহাদাতের চৌকস উপস্থিতি আমাকে প্রাণিত করে। দূরের একটা শহর থেকে ট্রেনে চেপে উপহার হাতে ছুটে আসে নসরত শাহ। সত্তরের দশকে কী চমৎকার গল্প লিখত ছোটদের জন্য! এখলাসউদ্দিন আহমেদ ও লীলা মজুমদার সম্পাদিত দুই বাংলার ছোটদের সেরা গল্পের সংকলনে নসরত শাহের গল্প মুদ্রিত হয়েছিল। এখন সে আর লেখে না। কেন লেখে না কে জানে!
দেখা হয় শরীফ মাহবুবুল আলমের সঙ্গে। কিশোর বাংলায় গল্প লিখতেন। ‘হলদে বাড়ির রহস্য’ নামে বই বেরিয়েছিল আশির দশকে। মাঝখানে দীর্ঘদিন লেখালেখি থেকে দূরে ছিলেন। কোনো মন্ত্রে জানি না ফের উদ্দীপ্ত হয়েছেন, প্রচুর লিখছেন। বই বেরোচ্ছে ফি বছর।
নাসরীন চৌধুরীও নিয়মিত লিখত ছোটদের পাতায়।
ফখরুল ইসলাম রচি এক সময় সরব ছিলেন কুমিল্লা ও ঢাকার শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে। কবিতা লিখতেন। নসাস প্রকাশিত ‘অগ্রন্থিত আবুল হাসান’ নামের সম্পাদিত বইটির কল্যাণে কবিতাপ্রেমী পাঠকের সমাদর পেয়েছিলেন। তাঁর হস্তাক্ষরও ছিল চমৎকার। নিউইয়র্কে এসে সরব রচি নীরব হয়ে গেলেন। এখন আর লেখেন না। কিন্তু নিজের বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে লাল টমেটো কিংবা সবুজ মরিচ ফলিয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড করেন। বইমেলায় মুফতে দেখা হয়ে যায় তাঁর সঙ্গেও।
দেখা হয় মাহবুব হাসানের সঙ্গে। আশির দশকে কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সুদর্শন মাহবুব হাসান। তারপর একদিন চলে এলেন আমেরিকায়।
ছড়াকার আলমগীর বাবুল দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর ফের সরব হয়েছেন। আমাকে দেখতে ছুটে এসেছিলেন বইমেলায়। অনেক কথা হয় তাঁর সঙ্গে। দাদাভাইকে নিয়ে। অনুশীলন সংঘ এবং শেখ তোফাজ্জল হোসেনকে নিয়ে। নতুন করে আবার শুরু করেছেন লেখালেখি।
মানিক রহমান কিশোর বেলায় চমৎকার ছড়া লিখত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে আমার সম্পাদিত বাংলাদেশের নির্বাচিত ছড়ার একটি খণ্ডে মানিকের ছড়া আছে। সাপ্তাহিক বিচিন্তায় কাজ করত মিনার মাহমুদের সঙ্গে। এখন থাকে স্থায়ীভাবে আমেরিকায়। আমার সঙ্গে দেখা করতে দূরের কোনো এক শহর থেকে ছুটে আসে মানিক। ছড়া আর লেখে না সে। মুক্তধারার বইমেলায় না এলে মানিকের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ হয়তো হতো না।
প্রীতিভাজন গোধূলি খান ছিল ফটোসাংবাদিক। ঢাকায় ওকে আমি বিখ্যাত আলোকচিত্রী মোহাম্মদ আলমের সঙ্গে ফটোগ্রাফি করতে দেখেছি। নিউইয়র্কে এসে কিশোরী মেয়েটা হয়ে গেছে পুরোপুরি সংসারী, ফুটফুটে কয়েক সন্তানের মা। ওর স্বামী রাজুও বিখ্যাত ফটোসাংবাদিক। প্রেসিডেন্ট ওবামার অফিশিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করত। বইমেলায় গোধূলির পুরো পরিবারের সঙ্গে আমার সময় কাটে দুর্দান্ত। ওর ছোট্ট মেয়েটার সঙ্গে আমার খুনসুটি ভালোই জমে।
নিউইয়র্কের কবি বন্ধু শামস আল মমিন, তমিজ উদ্দিন লোদী, ফকির ইলিয়াস, আদনান সৈয়দ, কাজী জহিরুল ইসলাম, দর্পণ কবীরদের সঙ্গে দেখা হলে আমি আনন্দিত হই। দেখা হয় বন্ধু আবৃত্তিশিল্পী ক্রিস্টিনা রোজারিওর সঙ্গে। প্রীতিভাজন আবৃত্তিশিল্পী ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধা মিথুন আহমেদের সঙ্গে। বিখ্যাত অভিনয়শিল্পী লুৎফুন নাহার লতার সঙ্গে।
সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরণ ও নিহার সিদ্দিকী মানিকজোড় হয়ে ঘুরে বেড়ান বইমেলায়। ভয়েস অব আমেরিকায় কর্মরত প্রীতিভাজন ছড়াকার ফকির সেলিম কত উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে আসে আমার কাছে! ফেসবুকে প্রায়ই দেখি প্রখ্যাত সংবাদ পাঠক সরকার কবির উদ্দিন ছড়াবন্ধু ফকির সেলিমের ছড়া আবৃত্তি করছেন। কী যে ভালো লাগে দেখে!
বাংলাদেশ বেতার থেকে এক সময় আজকের ঢাকা নামে খুবই জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো কৌশিক আহমেদের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায়। সেই বিখ্যাত কৌশিক এখন নিউইয়র্কের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বাঙালির সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে আড্ডায় কত কত প্রিয় অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে আসে!
ঢাকার দৈনিক খবরে একদা আমার সহকর্মী সাংবাদিক মুহম্মদ ফজলুর রহমান এখন নিউইয়র্কের পত্রিকা সাপ্তাহিক ঠিকানার সম্পাদক। একবার হলেও তিনি আসবেন বইমেলায়, আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ জমিয়ে কথা বলতে। তাঁর অধ্যাপক স্ত্রীও সঙ্গে থাকেন। এটা প্রতিবারই ঘটে। ঢাকায় কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক রাহাত খান একবার নিউইয়র্ক ভ্রমণ শেষে ফিরে আমাকে বলেছিলেন ফজলুর রহমানের প্রচণ্ড হোমসিকনেসের কথা। ফজলুর রহমানের মেয়ে মুমু খুদে লিখিয়ে হিসেবে আমাদের খুব স্নেহের পাত্রী ছিল ঢাকায়। মুমু এখন অনেক বড় হয়েছে। আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে খুব নামডাক ওর নিউইয়র্কে।
নিউইয়র্ক বইমেলায় কয়েকজন ছড়াবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে খুবই প্রাণিত বোধ করি আমি। মনজুর কাদের, শাহ আলম দুলাল, শামস রুশো, খালেদ শরফুদ্দিন এবং সাজ্জাদ বিপ্লবের সঙ্গে দেখা হওয়া মানে ছড়ার ঝুমঝুমিটা বেজে ওঠা।
সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী আমার বহু পুরোনো বন্ধু। থাকত সিলেটে। ধোপা দিঘির পূর্ব পাড়ে। চাঁদের হাট করত। বাংলাদেশের সব পত্রিকায় ওর ছড়া ছাপা হতো। পেশায় অ্যাডভোকেট। শিশুর মতো সরল একজন মানুষ। এত বছর ধরে নিউইয়র্কে আছে, কিন্তু একটুও পাল্টায়নি। প্রতিবার কাজ ফেলে ছুটে আসে আমার সঙ্গে গল্প করতে। ওকে দেখি আর অবাক হই। মানুষ কী করে এতটা সারল্য নিয়ে টিকে থাকে!
খুব ভালো ছড়া লিখত সালেম সুলেরী। নিউইয়র্কে থিতু হওয়ার কারণে তার ছড়াচর্চায় আগের সেই গতি বোধ হয় নেই। সাংগঠনিক তৎপরতায় খুব পটু ছিল সুলেরী।
একাত্তর টিভির সংবাদ বিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে পরিচিতি অর্জন করেছিল তরুণ লেখক শামীম আল আমিন। শামীম এখন নিউইয়র্ক থাকে সপরিবারে। বইমেলায় শামীম অনেক আবেগ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে।
আমাদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কয়েকজন প্রীতিভাজন এখন আমেরিকায় স্থায়ী নিবাস গেড়েছে। যেমন মনিজা রহমান, মৃদুল আহমেদ, দেবানন্দ সরকার। সাংবাদিকতা করত মনিজা। মৃদুল করত লেখালেখি আর টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা। কৃতি ছাত্র হিসেবে দেবানন্দের ছিল আলাদা জৌলুশ। ওদের সঙ্গে অনেক আনন্দ ভাগাভাগি করি প্রতিবার, বইমেলায়। দেবানন্দ অনেক দূরের শহর থেকে পাঁচ/ছয় ঘণ্টার বাস জার্নি করে নিউইয়র্ক আসে, আমাদের কয়েকজনকে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে খাইয়ে-দাইয়ে আড্ডা মেরে তারপর ফিরে যায় নিজের শহরে। ফের ক্লান্তিকর আরেকটা দীর্ঘ বাস জার্নি করতে হয় ওর। খুব ভালো গল্প লেখে ক্যানসার গবেষক হিসেবে খ্যাতি পাওয়া আমাদের দেবানন্দ।
ছড়াবন্ধু চিকিৎসক সজল আশফাক টিভিতে স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে বিখ্যাত হয়েছিল। পরিবার নিয়ে এখন থাকে নিউইয়র্কে। প্রতিবার অন্তত এক বেলা নিউইয়র্কের কোনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় আমাদের খাওয়া হয়। শেষবার আমাদের খাদ্যসঙ্গী হয়েছিল প্রীতিভাজন শওকত আনোয়ার রিপন। ঢাকায় থাকতে থিয়েটার মঞ্চ নিয়ে মেতে থাকত রিপন। এক বিকেলে বইমেলায় এসে বলল, ওস্তাদ শুধু আপ্নের লগে দেখা হইবো সেই কারণে আইলাম।
প্রবীণ সাংবাদিক আনোয়ারুল হকের ছেলে আরিফ আনোয়ার ওরফে বাবু আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ একজন। বইমেলায় গেলে বাবু আমাদের সঙ্গ দেয়। সে খুবই আমুদে স্বভাবের। ওর উপস্থিতি আমাদের আনন্দ দেয়।
নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে কর্মরত তরুণ মোস্তাফিজ রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল শহীদ কাদরীর বাড়িতে। সঙ্গে ওর আরেক পড়ুয়া বন্ধু শৈবালও ছিল। বইমেলায় মোস্তাফিজের সঙ্গেও আমার দারুণ সময় কাটে। পড়ুয়া মোস্তাফিজের ভাই টিভি উপস্থাপক খালেদ মহিউদ্দিনও আমার বিশেষ প্রীতিভাজন।
দৈনিক বাংলার বিখ্যাত সাংবাদিক মনজুর আহমদ এখন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আজকাল-এর সম্পাদক। মনজুর ভাই সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প/উপন্যাস লিখতেন। তাঁর লেখা ছোটদের একটা বই অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। এবারের বইমেলায় মনজুর ভাইয়ের দুটি বই এসেছে। একটি তাঁর উপন্যাস অমৃতপথযাত্রী, অন্যটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণা অন্য এক শেখ মুজিব। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়াটাও আমার জন্য একটা বিশেষ প্রাপ্তি।
সাংবাদিক হাসানুজ্জামান সাকী আমার আরেক প্রীতিভাজন। যুগান্তরে কাজ করেছে। কাজ করেছে বৈশাখী টিভিতেও। এখন নিউইয়র্ক থাকে। ওর সঙ্গে দেখা হয় বইমেলায়। মধুর উচ্ছ্বাসে ভাসি আমরা।
নিউইয়র্কার তাজুল ইমাম। অনেক গুণের সমাহার একজন ব্যক্তির মধ্যে। ছবি আঁকা গান গাওয়া ছড়া লেখা এ রকম কত গুণ তাঁর! কিছু বিখ্যাত গানের গীতিকারও তিনি। সদা হাস্যোজ্জ্বল তাজুলের উপস্থিতি মানেই হাসি আর আনন্দের দমকা হাওয়া।
জন্মই আমার আজন্ম পাপ লিখে দেশান্তরি হতে বাধ্য হওয়া কবি দাউদ হায়দারকে পেয়েছিলাম মুক্তধারার বইমেলায়। খুব ভালো লেগেছিল তাঁকে। দারুণ ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। জমিয়ে গল্প বলতে পারেন। অবিশ্বাস্য একেকটা গল্প। কিন্তু শুনতে বেশ লাগে। আর কথা বলেন এমন আন্তরিক একটা কণ্ঠস্বরে, মনে হবে দীর্ঘকালের চেনাজানা একজন। অনেক দিন পর দেখা হলো এই যা। দাউদ হায়দারকে দেখে খুব কষ্ট অনুভব করেছিলাম বুকের মধ্যে। একজন মানুষ সেই ১৯৭২ সালে দেশ ছাড়া হলেন। তারপর প্রায় পঞ্চাশটা বছর ধরে নির্বাসিত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন! সাত বছর দেশে যেতে পারিনি তাতেই দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছিলাম। আর কবি দাউদ হায়দার দেশে ফিরতে পারেন না আজ ছেচল্লিশ বছর! এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে একজন মানুষের জীবনে! কবির কাছ থেকে তাঁর দেশ কেড়ে নেওয়া আধুনিক পৃথিবীর ঘৃণ্য এক অপরাধ।
তরুণ সফল ব্যবসায়ী জাকারিয়া মাসুদ জিকোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিনার মাহমুদ। মুঠোফোনের ব্যবসা ছিল তাঁর। সাপ্তাহিক আজকাল পত্রিকার কর্ণধার। পরিপাটি পোশাকে ঝকঝকে জিকোর চকচকে উপস্থিতি বইমেলাকে আরও বর্ণাঢ্য করে তোলে। জিকোর সঙ্গ আমি উপভোগ করি।
শাহবাগের বিখ্যাত রেখায়ন-এর নেপথ্য নায়ক রাগীব আহসানও এখন নিউইয়র্কে থাকছেন পাকাপাকি। শুভ্র চুলের উচ্ছ্বাসে ভরপুর রাগীব ভাইকে পেয়ে যাই বইমেলায়।
আপাদমস্তক বিনম্র ভদ্রতায় ঠাসা এক ভদ্রলোক ফেরদৌস সাজেদিন। তাঁর ছোটবোন মাহফুজা শীলু আমার খুব কাছের বন্ধু, এটা জানার পরেও আমাকে আপনি থেকে তুমিতে আসতে প্রচুর সময় নিয়েছেন। মেধাবী এই মানুষটির সারল্য আমাকে মুগ্ধ করে। সম্প্রতি তাঁর একটা বই বেরিয়েছে, নাম খরা। ইশতিয়াক রূপু একজন গীতিকার। তাঁর লেখা গানের একটি সিডি উপহার দিয়েছিলেন বইমেলায়। সম্প্রতি রূপান্তরের গল্প নামে তাঁরও একটা বই বেরিয়েছে। দুটি বইয়েরই প্রকাশক আমাদের ঢালী। লেখক হুমায়ুন কবির ঢালী। আগে অন্যের সংস্থায় চাকরি করত। এখন নিজেই একটা প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার। লম্বা একটা সময় নিউইয়র্কে কাটিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরে গেছে সে।
আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ নাজমুন নেসা পিয়ারি। কবি শহীদ কাদরীর প্রথম স্ত্রী। জার্মানির বার্লিন থেকে প্রতিবার ছুটে আসেন নিউইয়র্কে। সদা পরিপাটি বর্ণিল শাড়ি অলংকার আর লাল টিপ শোভিত পিয়ারি আপাকে দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়।
লন্ডন থেকে মাসুদা ভাট্টিও এসেছিলেন একবার, বইমেলার একটা সেমিনারে অংশ নিতে। মুক্তধারার বইমেলায় খুব কম সময়ে কঠিন কঠিন সেমিনার হয়। সেমিনারে আলোচক থাকেন একাধিক। কথা বলার সুযোগ থাকে কম। এত এত কৃতি মানুষকে সময় করে দেওয়াটা কষ্টকরই বটে।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে ফাহিম রেজা নূর বইমেলার নেপথ্যে থাকা আরেক যোদ্ধা। তিনি বইমেলার মূল মঞ্চে একটা অনুষ্ঠান করেন প্রকাশকদের নিয়ে। প্রকাশনা শিল্পের বিশাল বিশাল সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় এই পর্বে।

কলকাতা থেকে এসেছিলেন অতিমাত্রায় কমার্শিয়াল লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রগরগে চটি সাহিত্য নির্মাণে বিশেষ পারদর্শী এই লেখক পারলে শরীরে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রক্ত বের করে সস্তায় বিক্রি করে দিতেন। খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁকে লক্ষ্য করেছি। একটিও উজ্জ্বল বাক্য শোনার সৌভাগ্য হয়নি আমার।
কলকাতা পাবলিশার্স গিল্ডের নেতা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ও এসেছিলেন সেবার। সুদর্শন হাসিখুশি মানুষটাকে খুব ভালো লেগেছিল আমার। তাঁর বাবা লেখক ঈষাণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিশোর ভারতী পত্রিকাটির মাধ্যমে আমার কৈশোরকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন। বাবার প্রকাশনা সংস্থা পত্র ভারতী এখন ছেলে ত্রিদিবের হাতে পত্রপল্লব মেলছে।
কানাডা থেকেও লেখক-কণ্ঠশিল্পীরা মুক্তধারার বইমেলায় অংশ নিতে নিউইয়র্ক ছুটে যান। এই তালিকায় সবচেয়ে নিয়মিত লেখকের নাম জসিম মল্লিক। নিউইয়র্ক গিয়েও টের পাই, প্রচুর নারী পাঠক আছে জসিমের।
বইমেলায় দেখা হওয়া আরেকজন উদ্যমী মানুষ এম এ রব। সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার কর্ণধার। গেল বছর বইমেলায় আমাকে পুলি পিঠা খাইয়েছিলেন।
স্বামী সন্তানসহ বইমেলায় আসেন আবৃত্তিশিল্পী রিপা নূর। রিপা আর তাঁর ছেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার ছড়াও আবৃত্তি করেন।
মুক্তধারার এই বইমেলাতেই পঁচিশ বছর পর ছেলেবেলার বন্ধু মোতাহার আলীর দেখা পেয়েছিলাম। বন্ধু মোতাহার এখন হাসপাতালেই কাটায় বেশির ভাগ সময়। বইমেলার পোস্টারে আমার নাম ও ছবি দেখে মোতাহার অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে এসেছিল বইমেলায়।
ফটো সাংবাদিক পাভেল রহমানের তোলা বেশ কিছু স্মরণীয় আলোকচিত্র নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল মুক্তধারা। সেবার বইমেলায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল পাভেলের ছবির প্রদর্শনীটি।
নিউইয়র্কে বসবাস করেন শক্তিমান কথাশিল্পী কুলদা রায়। তাঁর গল্প আমার বিশেষ পছন্দের। জাদুবাস্তবতার এক ধরনের ঘোর লাগা বাক্য ও চিত্রকল্প নির্মাণে সিদ্ধহস্ত কুলদার সঙ্গে একবারই আমার আড্ডার সুযোগ হয়েছে। বইমেলার উল্টোদিকের স্টারবাক্স নামের একটা কফিশপে বসেছিলাম গেলবার। কুলদা আমাকে ঢাকার নালন্দা প্রকাশিত তাঁর গল্পগ্রন্থ বৃষ্টি চিহ্নিত জল এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনোয়ার শাহাদাতের পেলেকার লুঙ্গি নামের চটি একটা গল্প সংকলন উপহার দিয়েছিলেন। দুটি সংকলনই অসাধারণ। খুবই সাদামাটা ক্যাজুয়াল একটা ভঙ্গিতে চমকে দেওয়ার মতো কথা বলেন কুলদা। দুনিয়ার সব মানুষের ওপরই বোধ হয় খানিকটা বিরক্ত মেধাবী এই মানুষটা।
বইমেলায় দেখা হয় বেলাল বেগের সঙ্গে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর নেতৃত্বেই ‘জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা’ নামের অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। অনুষ্ঠানটি ছিল তাঁরই মস্তিস্কপ্রসূত। এই মানুষটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। বিনোদন টিভির পাশাপাশি শিক্ষণ টিভি হিসেবে বিটিভির আলাদা একটা সেল চালু করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বিটিভি তাঁকে দায়িত্বও দিয়েছিল। মেধাবী ও স্বপ্নবান এই মানুষটা ছিলেন চারণ সাংবাদিকও। কিন্তু কোথায় যেন ছিঁড়ে গেল তারটা। সব কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে তিনি একদিন পাড়ি জমালেন মার্কিন মুলুকে। কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ বাবার নামে যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রামে, তার মূল দায়িত্ব তিনি অর্পণ করেছিলেন বেলাল বেগের হাতে। বেলাল ভাই দায়িত্বটা নিয়েও ছিলেন। কিন্তু ওই যে কোথায় যেন ছিঁড়ে গেল তার। জীবনের মোহের কাছে শেষমেশ পরাজিতই হলেন দুর্দান্ত মেধাবী মানুষ বেলাল বেগ।
প্রাণের বন্ধু আহমাদ মাযহারও এখন পারমানেন্ট রেসিডেন্ট মার্কিন মুল্লুকে। কয়দিন পরেই নাগরিকত্ব পাবে। হয়ে উঠবে পুরোপুরি মার্কিন নাগরিক। মুক্তধারার বইমেলা পরিচালনা কমিটির সে-ও একজন সক্রিয় সদস্য। এই রচনাটা লিখছিও আমি মাযহারেরই তাগাদায়। সব লেখা রেডি। আমিই কেবল লেট লতিফ!
টুকরো টুকরো কত স্মৃতি মুক্তধারার বইমেলাকে ঘিরে!
বাংলা গানের হিরণ্ময় কণ্ঠ আমার প্রিয় শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী। একবার বইমেলার মঞ্চে আমরা একে একে উঠে যাচ্ছি উদ্বোধনী পর্বের মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন পর্বে শামিল হতে। একটি মেয়ে আমাদের নাম ঘোষণা করছিল। সৈয়দ আবদুল হাদীর নাম ভুলভাবে উচ্চারণ করল মেয়েটা। হাদী ভাই বসে রইলেন প্রথম সারির আসনেই। আমি ওঠার সময় হাত বাড়িয়ে তাঁকে আহ্বান করতেই তিনি বললেন, আমি তো সাইয়েদ আবদুল হাদী নই! হাদী ভাইয়ের এই রাগ বা অভিমানটা আমি পছন্দ করেছি। সৈয়দ আবদুল হাদীর মাপের একজন সংগীতশিল্পীর নামটা সঠিকভাবেই উচ্চারিত হতে হবে। সৈয়দকে কায়দা করে সাইয়েদ বলার কোনো দরকার নেই। উপস্থাপনা করতে গেলে এই দিকটায় সচেতন থাকাটা অন্যতম প্রাথমিক শর্ত।
সাংবাদিক নিনি আহমেদ বইমেলা উদ্‌যাপনের নেপথ্য এক কান্ডারি। সারাক্ষণ ছুটোছুটি করতে হয় তাঁকে। টেনশন তাঁর পিছু ছাড়ে না। হাসান ফেরদৌসের কথা আলাদা করে কিছু বললাম না। তিনি জ্ঞানী লোক। প্রচুর ধৈর্য আর সহিষ্ণু স্বভাবের কারণে কঠিন বিপর্যয়েও ঠোঁটে একটা অটোমেটিক হাসি ঝুলিয়ে রাখতে সক্ষম তিনি।
মুক্তধারার বইমেলার নেপথ্যে একজন মানুষ আছেন, স্বভাবে যিনি ডিপফ্রিজ ধরনের। সারাক্ষণ কুল থাকেন। সর্বংসহা মানুষটার নাম আলাদা করে উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি বিশ্বজিত সাহা। বিখ্যাত লেখক-প্রকাশক-শিল্পীদের মান-অভিমান-ইগো সামাল দিতে দিতে কাহিল হয়ে পড়ার জায়গায় সারাক্ষণ স্বাভাবিক থাকেন বিশ্বজিত। এটা আমার কাছে একটা বিস্ময়। নিউইয়র্কে সাতাশ বছর ধরে বইমেলা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হওয়ার পেছনে এই মানুষটার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা আর অপরাজেয় উদ্যমই প্রধান নিয়ামক। ধন্যবাদ বিশ্বজিত সাহা। জয় হোক মুক্তধারার বইমেলার।

অটোয়া ১৩ জুন ২০১৮