ইরানের বিপ্লবের পটভূমিতে অনবদ্য উপন্যাস

তীর্থযাত্রী তিনজন তার্কিক ও এক জীবনের কাহিনির যশস্বী লেখক, কবি, রুচিশীল পাঠকের সাহিত্যপত্র ঘুংঘুর সম্পাদক হুমায়ূন কবির এবারের বইমেলাকে এবং সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ভ্রমণকাহিনির অভিনব আঙ্গিকে লেখা অনবদ্য উপন্যাস পারস্য পরবাসে উপহার দিয়ে।
ইরানের শাহ এবং কমিউনিস্টপন্থীদের বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনির ইসলামি বিপ্লবের গণহত্যার রক্তসমুদ্র শুকানোর আগেই সুন্নি ইরাক আক্রমণ করে বসে শিয়া রাষ্ট্র ইরানকে। এমনই যুদ্ধপরিবেশে চিকিৎসকের চাকরি নিয়ে তেহরান গিয়েছিলেন হুমায়ূন কবির। বাঙালির অহংকার ‘অমর একুশে’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ’র চেতনায় ঋদ্ধ যুবাবয়সী লেখক তেহরানে এসেই আবিষ্কার করলেন আরেক একাত্তর; সন্দেহ, অবিশ্বাস, দেশপ্রেম, বিদ্রোহ, যুদ্ধ, শহীদের লাশের এবং আহতদের নিত্যদিনের মিছিল, স্বজনহারাদের দিগন্ত-কাঁপানো বুকচাপড়ানো বিলাপ, আহতদের আর্তনাদ আর চিকিৎসার জন্য দিগ্বিদিক ছোটাছুটি, ডাক্তার-নার্স সংকট, সত্যিকার অর্থেই সর্বগ্রাসী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। পারস্য পরবাসের প্রচ্ছদের অভ্যন্তর ভাগে উপন্যাসের যথার্থ পটভূমি ব্যক্ত হয়েছে; ‘ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং বিপ্লবোত্তর ইরান-ইরাক যুদ্ধকালের অশান্ত জীবন—যে জীবন ধ্বংস ও মৃত্যুর পাশাপাশি বেঁচে থাকার উপলক্ষ খোঁজে, নিয়ত বেঁচে থাকা মূহূর্তগুলো উদ্‌যাপন করে, অন্ধকারেও সংগীতের সন্ধান করে।’
চিকিৎসা পেশার জন্য মানব চরিত্রের সর্বোত্তম গুণাবলি অপরিহার্য, যা কোমলতা-কঠোরতার এক ঐশ্বরিক মিশ্রণ। ডাক্তার কবিরের আগের কীর্তিগুলোতে আমরা আবিষ্কার করেছি তাঁর লেখায় একজন চিকিৎসকের তীক্ষ্ণ, সূক্ষ্ম ও সার্বিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। এই বইটিতেও বিকশিত হয়েছে তাঁর সৃজনশক্তির প্রকাশ তাড়না। তেহরান তথা ইরান যেন হয়ে উঠেছে সাহিত্য উপকরণের এক অন্তহীন উৎস। সবই ধারণ করেছে পারস্য পরবাসে।
উপন্যাসটিতে গতানুগতিক নায়ক-নায়িকা নেই বললেই চলে, কারণ যুদ্ধের মৃত্যু ও ধ্বংসের ছায়ায় নিছক প্রেম এখানে প্রধান হওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু বইটির শেষভাগে একটি গভীর প্রেমের মৃত্যু দেখে আমরা ব্যথিত হয়ে পড়ি।
পারস্য পরবাসের কাহিনিটি যেন হুমায়ূন কবিরের ইরানে চাকরি করার গল্প। রাজধানী তেহরানের বিমানবন্দরে কাস্টমসের তল্লাশি চলাকালেই এয়ার রেইডের সাইরেন ওই গল্পের পরিবেশ বলে দেয়। ইরান প্রত্যাগত বন্ধু এনাম তাঁকে বলে দিয়েছিল ইরানে কীভাবে চলতে হবে। সে অনুযায়ী যে হোটেলে ওঠেন সেখানে পেয়ে যান তাঁদের বয়োজ্যেষ্ঠ ডাক্তার হাফিজ ভাইকে, যিনি ইরানের অস্থির সময়ের আলোকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি মেয়েদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হওয়ার সতর্কতা জানিয়েছিলেন। কারণ দলে দলে পুরুষদের মৃত্যু হতে থাকায় মেয়েরা সাথিহারা এবং সম্ভবত বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছিল। ইরানি নারীরা অসামান্য সুন্দরী; শাহর আমলে তারা দাপিয়ে বেড়াত, কিন্তু ইমাম খোমিনি তাদের বোরকাবন্দী করে দিয়েছিলেন।
ডাক্তার হুমায়ূন পড়ে থাকা ফারসি পত্রিকার ছবি দেখে সংবাদের আঁচ করছিলেন। বিদেশি একজন ফারসি ভাষা পড়ছে দেখে পাশে বসা অসামান্য সুন্দরী ইরানি ডাক্তার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে নিজের পরিচয় দেয় আনুশেহ সিরাজি বলে। এই আনুশেহকেই সম্ভবত এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বলা যায়। আনুশেহর হাতে ছিল এরিক মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস অল কোয়াইট অন ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। এভাবেই দুই সাহিত্যপ্রেমী ডাক্তারের পরিচয় শুরু হয় একটা অচিন যুদ্ধ-লিপ্ত দেশের অশান্ত পরিবেশে। আনুশেহ ফারসি কবি হাফিজের অনুরক্ত আর তার প্রেমিক গজল গায়ক মাসুদ সিদ্ধান্ত নেয় তারা হুমায়ূনকে সিরাজ, রুমি, সাদির কাব্য আস্বাদনে সাহায্য করবে। তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতে থাকে বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু বিপ্লবী মাসুদ একদিন যুদ্ধে চলে যায় এবং নিহত হয়। হুমায়ূন তাকে কেন বাধা দিল না! আনুশেহ ক্ষুব্ধ হয়। ওদিকে মাসুদ যে সন্দেহ করত আনুশেহ হুমায়ূনকে ভালোবাসে, সে কথা হুমায়ূন চেপে গেলেন।
হুমায়ূনের গল্প বলা বড়ই সহজ ও আন্তরিক। তরতরে অনাড়ম্বর ভাষা। মজার কথা, এই উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক কিছু কথ্য ফারসি ভাষাও শিখে ফেলবেন।
উপন্যাস: পারস্য পরবাসে
প্রকাশক: সময় প্রকাশন। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ।