বাক্সবন্দী মানুষ

ক্রমাগত ঘামছে আলেয়া। ভেতরে-ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনাও বোধ করছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে বারবার ঘাম মুছছে। কেমন যেন ভ্যাপসা গরম। কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাতে গরমতো কিছু কমলই না; কালোমেঘ জমে ধুম করে বৃষ্টি। আবার হঠাৎ করেই রোদ উঠে কটকটে একটা পরিবেশ। সেই রোদের এমনই তীব্রতা যে শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।
কাঁচা রাস্তায় বৃষ্টিতে কাদা জমে গেছে। ভ্যানগাড়ির চাকা বারবার দেবে যাচ্ছে। আলেয়াকে তখন নামতে হচ্ছে। গাড়ি টেনে তুলতে ছেলেটার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোর হাশেম এই গাড়ির চালক। মাঝে মাঝে আলেয়াও হাত লাগাচ্ছে। তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। অথচ দেরি হয়ে যাচ্ছে। আলেয়া আগেও দেখেছে, যখনই তাড়া বেশি থাকে, তখন আরও দেরি হয়ে যায়।
এখনো মাইল দশেকের পথ। এরপরেই জিনতলা গ্রাম। বলেশ্বর নদীর পাড়ে। সেই গ্রামেরই ঘটনা। একটা মানুষকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তার শরীরে নাকি কঠিন অসুখ বাসা বেঁধেছে। লোকজন দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আবার কখনো তেড়ে মারতে আসে। অদ্ভুত ভাষায় কীসব যেন বলে, অভিশাপ দেয়। মানুষটার শরীরে যে অসুখ, তা নাকি একজনের কাছ থেকে আরেকজনের শরীরে চলে যায়! এ জন্যই তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। বাক্সের মতো একটা ঘরে। আলেয়ার কাছে তথ্য বলতে এটুকুই। বাকিটুকু নিজ চোখে দেখতে যাচ্ছে।
মানুষটার খবর তাকে দিয়েছে হরনাথ। বেসরকারি সংগঠন সুখী পরিবারে কাজ করে। ‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট, একটি হলে ভালো হয়’ এমন স্লোগান নিয়ে কাজ করে সুখী পরিবার। হরনাথ মাঠকর্মীদের সুপারভাইজার।
আলেয়া যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তার নাম ‘সেবা’। মানুষকে নানাভাবে সেবা দেওয়াই তাদের কাজ। বিশেষ করে সামাজিক নানা কুসংস্কারের দেয়াল ভাঙতে কঠিন কাজই তাদের করতে হয়। আর এ কারণেই বিষয়টি আলেয়ার নজরে এনেছে হরনাথ।
মানুষটার অবস্থা নাকি খুবই খারাপ। তাই খবরটা শোনার পর আর দেরি করেনি আলেয়া। কিন্তু পথের যা অবস্থা, তাতে দিনে গিয়ে দিনে ফেরা যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে তার মনে। এরই মধ্যে দুপুর হতে চলেছে। আলেয়ার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। পেছন ফিরে ভ্যানচালক হাশেম বলে উঠল, ‘চিন্তা কইরেন না আফা। আর বৃষ্টি না হইলে, সন্ধ্যার আগেই ফিরতে পারমু’।
হাশেমের কথায় আশ্বস্ত হতে পারে না আলেয়া। কারণ আবারও আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে।
**
ঘরটার একটা দরজা। জানালাও একটা। দেখতে অনেকটা চারকোনা বাক্সের মতো। কাঠ আর খড় দিয়ে তৈরি। গ্রামেরই কয়েকজন বানিয়েছে। এরপর মানুষটাকে এই ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে।
ঘরটার চারপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে। আজকাল প্রায় সব সময়ই লোকজনের এমন সমাগম থাকে। বাক্সবন্দী মানুষ দেখতে প্রতিদিনই হাজারো নারী-পুরুষ ভিড় করে। আশপাশের গ্রামেও খবরটা ছড়িয়ে গেছে। দূর-দূরান্ত থেকে দল বেঁধে লোক আসছে। রীতিমতো মেলা বসে গেছে। একদল সুবিধাবাদী লোক আবার এ নিয়ে ব্যবসাও ফেঁদে বসেছে। টিকিটের ব্যবস্থা করেছে তারা। বাক্সবন্দী মানুষ দেখতে হলে দিতে হবে জনপ্রতি দশ টাকা।
ঘরের ভেতরে থাকা মানুষটার কঠিন অসুখ আছে শুনে লোকজন খুব একটা কাছে ঘেঁষতে চায় না, দূর থেকেই দেখে। অপেক্ষা করে, কখন মানুষটা জানালার কাছে এসে একটু ভেংচি কাটবে। আগে সে প্রায়ই জানালার পাশে আসত, ভেংচি কাটতো, গালি-গালাজ করত, উচ্চ স্বরে অভিশাপ দিত। দিন যতই যাচ্ছে, নিজের ভেতরে কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। খুব একটা দেখা দেয় না। তবুও লোকজনের আগ্রহ কমে না। অজ পাড়াগাঁয়ে এ যেন অমানবিকতার অদ্ভুত এক উৎসব।
শুরুর দিকটায় কেউ কেউ ভালোবেসে খাবার দিত। এখন ভয়ে কেউ কাছেই ঘেঁষতে চায় না। তবে যারা টিকিট কেটে বন্দী মানুষ দেখার ব্যবস্থা করেছে, তারাই কলাপাতায় করে তিনবেলা খাবার পাঠায় সেই ঘরে। মাটির কলসিতে পানিও দেওয়া হয়। কখনো মানুষটা সেই খাবার খায়, আবার কখনো ছুঁয়েও দেখে না। মাস দু-এক হয়ে গেল, ঘরটা পরিষ্কার করা হয় না। এখন ঘরটা যেন আস্ত একটা ডাস্টবিন।
সবকিছু দেখে আলেয়া খুব বিচলিত বোধ করে। হচ্ছে কী এসব! একজন জীবন্ত মানুষের সঙ্গে একদল মানুষের এমন আচরণ! তার যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না। ঘরটার দিকে পা বাড়াল সে। বাধা হয়ে দাঁড়াল এক যুবক। টিকিট কিনতে হবে। আলেয়া কঠিন প্রতিবাদ করে বলে উঠল, ‘আপনারা কি মানুষ, নাকি অন্য কিছু? একজন অসুস্থ মানুষকে বন্দী করে রেখে ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। শোনেন, আমি একজন এনজিও কর্মী। আমার পথ আটকাবেন না। মানুষটার কাছে যেতে দিন’।
আলেয়া কথাগুলো এমনভাবে বলল যে, পথ আটকে দাঁড়ানো লোকটা ভড়কে গেল। এত দিন কেউতো মানুষটার কাছেই যেতে চাওয়ার সাহস দেখায়নি। আলেয়ার চোখে এমন কিছু ছিল যে, লোকটা পথ থেকে সরেও দাঁড়াল।

**
বড় একটা মাঠ। পাশে বলেশ্বর নদী। অনেকটা নদীর পাড় ঘেঁষেই ঘরটা। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একটি হিজল গাছ ঘরের ওপর দিয়ে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। হিজলের ডালে ফুল ধরেছে। রাতে ফুল ফুটে সকালে ঝরে পড়েছে। সারা দিনের রোদবৃষ্টিতে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা গোলাপি রঙের ফুলগুলোর একেবারে জীর্ণ অবস্থা।

এখনো বর্ষা আসেনি। তবুও নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। পাড়ও ভাঙতে শুরু করেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ঘরটা সরিয়ে না নিলে নদীতেই হয়তো বিলীন হয়ে যাবে।
দুপুরের সূর্য হেলে পড়েছে। আকাশে মেঘ নেই। বিকেলের রোদ কেমন যেন তীব্র লাগছে। আলেয়া দাঁড়িয়ে আছে ঘরটার সামনে। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। যারা টিকিট করে বন্দী মানুষ দেখার ব্যবস্থা করেছে, চাবি তাদের কারও কাছে। তবে আপাতত চাবির খোঁজ করল না আলেয়া। মনে মনে ভাবল, ঘরের ভেতরের মানুষটার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা গেলে, তখন চাবির খোঁজ করা যাবে।
আলেয়া জানালায় মুখ রেখে ভেতরে তাকাল। আলো-আঁধারিতে ভীতসন্ত্রস্ত একটা মানুষকে দেখা যাচ্ছে। ঘরটার এককোণে বসে আছে। চোখে আলো পড়তেই আরও কুঁকড়ে গেল। হাত দিয়ে সেই আলোর উৎস ঠেকানোর চেষ্টা করছে। সঙ্গে গোঙানির মতো শব্দ। তীব্র দুর্গন্ধ আসছে ভেতর থেকে। সবকিছু উপেক্ষা করে আলেয়া গভীর মমতা মেশানো গলায় ডাকল, এই যে শুনছেন?
কোনো সাড়া দিল না মানুষটা। আলেয়া পেছন ফিরে তাকাল। কৌতূহলী হাজার জোড়া চোখ তাকে দেখছে। অনেকের চোখেমুখে বিস্ময়। কী করছে এই মেয়েটা! এত দিনতো এই সাহস কেউ দেখায়নি। গ্রামের কয়েকজন তরুণের আগ্রহটা মনে হচ্ছে একটু বেশি। আলেয়াকে দেখে ভেতরে সাহস পাচ্ছে তারা। এগিয়ে যেতে চাইল। হাতের ইশারায় তাদের থামতে বলল আলেয়া। থেমে গেল তারা।
আলেয়া আবারও জানালায় মুখ রেখে কথা বলতে শুরু করল, ‘আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি। আপনি আমার কথা শুনুন। জানালার কাছে আর কেউ নেই। আপনি কি এ দিকটায় আসতে পারবেন?’
এরপরও কোনো সাড়া এল না। খুব বেশি নড়াচড়াও দেখা যাচ্ছে না। আলেয়া বলেই চলল, ‘শুনুন, আমার নাম আলেয়া। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। শুনতে পাচ্ছেন? আমি অনেক দূর থেকে এসেছি ভাই। সেই দামুখালি থেকে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই’।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক বলে ওঠে, ‘আপা, হ্যার নাম আনোয়ার। নাম ধইরা ডাক দ্যান। কথা কইতে পারে।’
আলেয়া যুবকটির দিকে তাকিয়ে আবার জানালার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এবার নাম ধরেই ডাকল, ‘আনোয়ার সাহেব, আপনি একটু আসেন। জানালার কাছে আসেন। আমি সবাইকে আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। কেউ আপনার কথা শুনতে পারবে না। আমি আপনার কথা শুনতে চাই। এরপর আপনাকে বাইরে বের করার ব্যবস্থা করব’।
ভেতরে থাকা মানুষটা মনে হলো নড়েচড়ে বসেছে। একটু ঝুঁকে আলেয়াকে দেখারও চেষ্টা করছে। অনেক দিন হয়ে গেল এই বাক্সের মধ্যে বন্দী সে। এর মধ্যে কেউ এভাবে তাঁর খোঁজ নেয়নি। মানুষের হৃদয়হীনতায় তার প্রতিবাদের ভাষাটুকু মরে গেছে অনেক আগেই।
-‘আনোয়ার সাহেব, আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি। আপনি আমার কথা শুনুন। আমি একটা এনজিওতে কাজ করি। আপনার সমস্যার কথা শুনতে চাই। আপনার কী অসুখ হয়েছে, আমি তা বুঝতে চাই। আনোয়ার সাহেব, প্লিজ মরার আগেই মরে যাবেন না।’

এরপরও লোকটার কাছ থেকে কোনো সাড়া নেই। কেবল মাথা বাড়িয়ে দু-একবার আলেয়াকে দেখার চেষ্টা করল। এরপর আবারও কুঁকড়ে গেল। এমন সময় হঠাৎ কেউ একজন গর্জন করে উঠল, ‘এই যে মেয়েলোক, আপনি কী করেন? চান কি এইখানে?

মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আলেয়া। বিশাল গোঁফওয়ালা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। ‘আপনি কে ভাই’? উল্টো আলেয়ার দৃঢ় প্রশ্ন।
-‘আমি এই গ্রামের। আমারে আপনার চেনা লাগব না। সবাই চেনে’। এরপর লোকটা বেশ হম্বিতম্বি শুরু করে দিল।
আলেয়া অল্প সময়ের মধ্যেই গোঁফওয়ালা লোকটার নাম-পরিচয় জেনে গেল। তার নাম হরমুজ ব্যাপারী। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। তার নেতৃত্বেই বাক্সবন্দী মানুষ দেখতে টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ব্যবসার উদ্যোক্তা সে। এভাবে এখানে আলেয়ার আসাটা একদম পছন্দ হয়নি তার। আর কথা বাড়াল না আলেয়া। সেদিনের মতো চলে গেল। তবে যাওয়ার সময় বলে এসেছে, সে আবার আসবে।
**
দুদিন পরে আলেয়া আবারও এসেছে জিনতলা গ্রামে। সঙ্গে আরেকজন। আলেয়া যেখানে কাজ করে, সেই প্রতিষ্ঠানেরই জেলা কো-অর্ডিনেটর। নাম সেলিম হোসেন। এসেই তারা প্রথমে খুঁজেছে হরমুজ ব্যাপারীকে। পেয়েও গেল। এরপর আলেয়া হরমুজ ব্যাপারীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘চাচাজি, আমি আপনার মেয়ের মতো। আপনাকে কিছু কথা বলব, মন দিয়ে শুনবেন। যে মানুষটাকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে, এটা কতটা ঠিক বলে আপনি মনে করেন’?
আলেয়ার চোখের মধ্যেই এমন কিছু ছিল, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না হরমুজ ব্যাপারী। চোখ নামিয়ে নিল। এরপর অন্যদিকে তাকিয়েই বলল, ‘হ্যার তো কঠিন অসুখ হইছে। এইডস রোগ কয়। আমরাতো তারে সমাজের মধ্যে ছাইরা দিতে পারি না।’
-‘চাচাজি, আপনি কি নিশ্চিত লোকটার এইডস হয়েছে? কে পরীক্ষা করে দেখেছে? আর এইডস হলে কেন তাকে সমাজে ছেড়ে দেওয়া যাবে না? চাচাজি এইডস কোনো ছোঁয়াচে রোগ না।’
হরমুজ ব্যাপারী এবার অনেকটা ধমকেই ওঠে। ‘আপনার এত কথা দিয়া কাজ কি। আপনি আবার কেন আসছেন’?
-কারণ, আমার কাজই হচ্ছে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। মানুষের ভেতরের ভুল ধারণাগুলো ভেঙে দেওয়া। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, লোকটাকে বের করে দিলে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। তার অসুখ আছে কি-না পরীক্ষা করাব, অসুখ থাকলে চিকিৎসারও ব্যবস্থা করব। আপনার সমাজের তাতে কোনো সমস্যা হবে না।
-না, তুমি নিতে পারবা না।
-কেন? তাতে আপনার টিকিট কেটে বাক্সবন্দী মানুষ দেখানোর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, এই জন্য?
আলেয়া এমন কঠিনভাবে কথাগুলো বলল, শুনে অনেকটা হকচকিয়ে যায় হরমুজ ব্যাপারী। এবার কোনো উত্তর দেয় না।
‘দ্যাখেন চাচা, প্রশাসন আমাদের সঙ্গে আছে। আপনি যদি ভালোয় ভালোয় আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে আমরা পরের বার পুলিশ নিয়া আসব।’ এবার কথাগুলো যোগ করে আলেয়ার সঙ্গে আসা সেলিম হোসেন। তার কথায় কিছুটা ভড়কে গেলেও বুঝতে দিতে চায় না হরমুজ ব্যাপারী। বরং অনেকটা ধমকে ওঠে, ‘তোমরা এখান থাইকা জ্যান্ত ফিরা যাইতে পারলেই না পুলিশ আনবা’।
-‘দেখুন চাচা। আমরা এখানে আসার সময় পুলিশকে ইনফর্ম করে এসেছি। আপনার নামও তাদের কাছে বলা আছে। আমরা কথা বলে বিষয়টা মিটমাট করতে চাই বলেই সঙ্গে করে পুলিশ আনিনি। আমাদের কোনো ক্ষতি হলে পুলিশ আপনাকে ছাড়বে না’।
এবার কিছুটা দমে যায় হরমুজ। আলেয়া বলে, ‘চাচা, মানবিক হন। সবার আগে আমরা মানুষ। লোকটার সঙ্গে যে আচরণ করছেন, তা কোনো অবস্থাতেই মানবিক না। লোকটা এমনিতেই মরে যাবে। তখনতো আপনার ব্যবসা থাকবে না। আমার মনে হয়, আসুন লোকটাকে সাহায্য করি’। আলেয়ার এমন কথার পরই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণদের একজন আলাউদ্দিন বলে উঠল, ‘তাইতো চাচা। কী লাভ কও এইসব কইরা। দ্যাও, আপারে ঘরের চাবি দিয়া দাও। হ্যরাই দেখুক, তার কী অসুখ। তা ছাড়া কইছেই তো, কঠিন অসুখ হইলে সঙ্গে কইরা নিয়া যাইব। তোমার আর সমাজ নিয়া ভয় কী!
আর কথা বাড়াল না হরমুজ ব্যাপারী। কোমর থেকে ঘরের চাবির গোছা বের করে তুলে দিল আলেয়ার হাতে। আলেয়ার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল, ‘ধন্যবাদ চাচাজি আপনাকে। অনেক বড় একটা কাজ করলেন’।
চুপ করে থাকে হরমুজ।
**
আলেয়া আর সেলিম হোসেন বসে আছে আনোয়ারদের বাড়ির উঠানে। মানুষটা সম্পর্কে যতটা জানা যায়, এ জন্যই এই বাড়িতে আসা। আনোয়ার নিজে বিয়ে করেনি। বিয়ে করেছে তার বড় দুই ভাই। তাদের স্ত্রী আর বৃদ্ধা মা; সংসার বলতে এই। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে।
দূরে দাঁড়িয়ে আছেন আনোয়ারের মা ময়মুনা। ছেলের খোঁজ নিতে কেউ এসেছে শুনে যেন আশার আলো দেখলেন তিনি। সদর দরজার পাশ থেকে লম্বা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছেন। আলেয়াকে তিনি বললেন, মাগো তুমি আমার পোলাডারে বাঁচাও। ওয়তো মইরা যাইবো মা’।
-‘আমরা সে চেষ্টাই করছি মা। আপনি ভাববেন না’। এটুকু বলে আলেয়া তাকায় আনোয়ারের ভাই সোলায়মানের দিকে। ‘বলুন, আপনার ভাইয়ের এই অবস্থা হলো কীভাবে’?
-‘আপা, বিস্তারিত কইতে পারমু না। আনোয়ার থাকত মালয়েশিয়ায়। একটা রাবার বাগানে ভালো চাকরি করত। বেতনও বালা আছিল। মাস ছয়েক আগে কাউরে কিছু না জানাইয়া বাড়ি আইসা হাজির। গায়ে তার অনেক জ্বর। আমরা তারে ধরতে গেলাম, সে বাধা দেয়। কয় তার অনেক কঠিন অসুখ হইছে; আমরা যেন তারে না ধরি। এরপর থাইক্কা সে কেমন জানি আলাদা আলাদা থাকে। আবোলতাবোল কথা কয়। কারও সঙ্গে মিশে না’। এই পর্যন্ত বলে থেমে যায় সোলায়মান।
‘এরপর’? জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায় আলেয়ার।
‘এক সময় আনোয়ার নিজেই কইতে থাকে, তার নাকি এইডস রোগ হইছে। এই পৃথিবীতে সে আর বেশি দিন নাই’।
‘নিজেই বলে তার এইডস হয়েছে’! বিস্ময় প্রকাশ করে আলেয়া। ‘কিন্তু, এর পেছনে কোনো কারণ কী সে বলে’?
‘না, সে তা কয় না। আমগোর লগে তো কথাই কয় না’।
‘আমার প্রশ্ন, কীভাবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল যে আনোয়ারের এইডস হয়েছে’?
‘আমরা কিছুই জানি না আপা’
পাশ থেকে আনোয়ারের মা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। সেই কান্না সংক্রমিত হয় আনোয়ারের দুই ভাইয়ের স্ত্রীর মধ্যে। সোলায়মানের স্ত্রী আম্বিয়া বলে ওঠে, ‘আপা, আমগোরে একরকম একঘরে কইরা রাখছে সবাই। সমাজে আমগো কোনো জায়গা নাই’। হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে আম্বিয়া। সেই কান্না এবার ছুঁয়ে গেল আলেয়াকেও।
**
ঘরের দরজা খুলে আলেয়া ভেতরে ঢুকল। গ্রামের মানুষ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সেদিকে। আলেয়ার সাহস দেখে অনেকে অবাক। করে কি এই মেয়ে! ছোট্ট একটা ঘর। তার এককোণে অনেকটা গুটিসুটি মেরে বসে আছে আনোয়ার। আলেয়াকে দেখে আরও কুঁকড়ে গেল। দরজা দিয়ে আলো ঢুকছে ঘরে। আলোর কারণে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না। তারপরও কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তাকানোর চেষ্টা।
ঘরের আলো-আঁধারিতে এখনো বোঝা যাচ্ছে, একসময় লোকটা দেখতে অনেক সুদর্শন ছিল। এখন কেমন যেন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। শরীর ভেঙে চৌচির। চোখ দুটো একেবারে কোটরের ভেতরে ঢুকে গেছে। মুখের দুপাশে চোয়াল কেমন ঝুলে গেছে।
আলেয়া তার জন্য ভাত আর পানি নিয়ে এসেছে। নিচু হয়ে আলেয়া বলল, আমি আপনার জন্য খাবার এনেছি। আপনি আরাম করে খান। মরার আগেই মরে গিয়ে কী লাভ বলুন?
আনোয়ার এবার ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। তারপরও চোখ ঠিকমতো খুলতে পারছে না। ‘আপনি চোখ মেলুন, পারবেন। আপনার যদি কোনো কঠিন অসুখ হয়ে থাকে, তাহলে চিকিৎসা করাব। যত দিন ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায়। আর এইডস কোনো ছোঁয়াচে রোগও না। তাহলে আর আড়ালে থাকবেন কেন’?
আনোয়ার আলেয়ার দিকে তাকাতে পেরেছে। তাকিয়েও আছে। এত দিন পরে কে এসেছে! কী বলছে এসব? যেন বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু শরীর তার এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে, কথাই বলতে পারছে না।
এরপর আলেয়া অনেক চেষ্টা করেও আনোয়ারকে ভাত খাওয়াতে পারল না। যতবার মুখে নিয়েছে, বমি করে ফেলে দিয়েছে।
আলেয়া বলল, চলুন, আপনি বাইরে বের হবেন।
আঁতকে ওঠে আনোয়ার। ক্ষীণকণ্ঠে বলার চেষ্টা করে, ‘নাহ! ওরা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে’।
‘কেউ মারবে না’। বোঝানোর চেষ্টা করে আলেয়া। তবে তাতে কোনো কাজ হয় না। আনোয়ারের উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তিও নেই। কোনো রকম হেলান দিয়ে বসে আছে।
আলেয়া জানতে চাইল, কেন সে মনে করছে, তার শরীরে এইডস বাসা বেঁধেছে। আর কি ভাবেইবা আনোয়ার তা নিশ্চিত হলো।
অনেক কষ্টে আনোয়ার তাকে যা জানাল তার অর্থ দাঁড়ায় এমন—মালয়েশিয়ায় কাজ করার সময় ফিলিপাইনের এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় আনোয়ারের। দিন গড়ায়। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। অনেকবার তারা কোনো ধরনের নিরোধক ছাড়াই দৈহিক সম্পর্কে মিলিত হয়েছে। একদিন সে টেলিভিশনে একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পায়; কনডম ছাড়া দৈহিক সম্পর্ক নিরাপদ নয়। আর এইডস হওয়ার ক্ষেত্রে এটি বড় একটি কারণ। সেই থেকে আনোয়ারের মনের ভেতর ভয় ঢুকে যায়। সেই ভয় আর কাটতে চায় না। আনোয়ারের ধারণা হয়, তার এইডস হয়েছে! সেই থেকে মনের বাঘই তাকে খেয়ে ফেলতে শুরু করে। ফিলিপাইনের সেই তরুণীকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়, দেশে ফিরে আসার। তবে তার আসলেই এইডস হয়েছে কি-না, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।
আলেয়া তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, অপরিচিত কারও সঙ্গে যৌনমিলনের সময় অবশ্যই কনডম ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কনডম না নিলে এইডস হবেই। যার সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন, তার শরীরে এইডসের জীবাণু এইচআইভি থাকলেই কেবল তা আপনার শরীরে আসতে পারে। এইচআইভি ছড়ানোর আরও কয়েকটি মাধ্যম আছে। তাই এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না আপনার এইডস হয়েছে। আপনি কি নিশ্চিত, ফিলিপাইনের সেই তরুণী এইচআইভি সংক্রমিত ছিল?
ক্ষীণকণ্ঠে আনোয়ার উত্তর দেয়, সে নিশ্চিত না।
তাহলে, আপনার উচিত হবে পরীক্ষা করে দেখা। যদি এইডস হয়, আমি আপনাকে এনজিওর মাধ্যমে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করব। যত দিন বাঁচবেন অধিকার নিয়ে বাঁচুন। আর যদি দেখেন এইডস হয়নি, তাহলে তো কথাই নেই। সব ভুলে জনসম্মুখে বের হয়ে আসুন। নাকি?
আনোয়ার মুখে কিছু বলে না। কেবল হাসার চেষ্টা করে। তার মুখটাকে মলিন দেখায়।
‘আমি আপনার রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করব। আমি নিশ্চিত হতে চাই। আপনাকেও জানাতে চাই। জানিয়ে দিতে চাই গ্রামের মানুষকে; আসলে কী ঘটেছে। সবাই কেন ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করবে! তা ছাড়া যেভাবে পুরো বিষয়টি দেখা হয়েছে, তা কোনোভাবেই মানা যায় না। যেকোনো ধরনের রোগই হোক না কেন, তাতে মানুষ হিসেবে কেউ তার অধিকার হারিয়ে ফেলে না’। আলেয়া যোগ করে।
এবার মনে হচ্ছে আনোয়ার আর বসে থাকতে পারছে না। মাটিতে শুয়ে পড়ল। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে সে।
**
কিছুক্ষণ আগেই সন্ধ্যা নেমেছে। ঢাকায় পাঠানো আনোয়ারের রক্তের স্যাম্পল পরীক্ষার রেজাল্ট আলেয়ার হাতে এসে পৌঁছেছে। অফিসের পিয়ন বিপুল এসে দিয়ে গেছে। দুই জায়গায় পরীক্ষা করা হয়েছে। আলেয়ার চোখমুখ চক চক করছে। কারণ দুই জায়গার পরীক্ষাতেই নেগেটিভ এসেছে। আনোয়ারের শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের কোনো অস্তিত্বই নেই। একজন মানুষকে এবার সে আলোয় নিয়ে আসবে। রাত পেরোলেই আলেয়া যাবে জিনতলা গ্রামে। সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, দিনের পর দিন তারা কত বড় ভুল করেছে। কতটা অন্যায় হয়ে গেছে একজন মানুষের সঙ্গে। আর না বুঝে নিজের প্রতি কতটা অনাচার করেছে আনোয়ার নিজেই। সেই রাতটা আলেয়ার না ঘুমিয়েই কাটল।
**
হিজল গাছের নিচে অজস্র ফুল বিছিয়ে আছে। সকালে এসব ফুল ঝরে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন গোলাপি একটা কার্পেট বিছানো হয়েছে গাছতলায়। ফুল ছড়িয়ে আছে বাক্সের মতো দেখতে ঘরটার ছাদজুড়েও।
ভোরে রওয়ানা দিয়ে অনেকটা সকাল সকালই পৌঁছে গেল আলেয়া। আশপাশে তখন বলতে গেলে লোকজন কেউ নেই। টিকিট কেটে বাক্সবন্দী মানুষ দেখা বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষও ভাবতে শুরু করেছে, কোথাও একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। তাই এদিকটায় আজকাল লোকজন খুব একটা মাড়ায় না।
আলেয়া ঘরটার দিকে এগিয়ে যায়। তার বুক কাঁপছে। কেমন হবে একজন মানুষের মুক্তির আনন্দ! তার চোখেমুখে নিশ্চয়ই খেলে যাবে অদ্ভুত আলোর ঝলকানি! এবার নিশ্চয়ই সব বাধা টপকে আলেয়া মানুষটাকে বের করে আনতে পারবে আলোয়। অনেক দিন ধরে লেগে থেকে কেমন যেন একটা চ্যালেঞ্জের মত হয়ে দাঁড়িয়েছিল আলেয়ার জন্য। সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্য এক মায়া। আর প্রতিজ্ঞা; কিছু একটা করতেই হবে লোকটার জন্য। কাউকে কিচ্ছু দেখানোর জন্য নয়। আলেয়া কেবল প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে, ভুল বুঝে ভুল করতে নেই।
ঘরের চাবি আলেয়ার কাছেই ছিল। তালায় চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই খট করে একটা শব্দ হলো। খুলে গেল তালা। সকালের সোনারোদ ঠিকরে ঢুকল ঘরের ভেতর। বোটকা গন্ধ এসে লাগল নাকে। সেদিকে খেয়াল নেই আলেয়ার। মানুষটাকে খবরটা দিতে হবে। আনোয়ার কাত হয়ে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে আলেয়া আস্তে করে ডাকল, ‘আনোয়ার সাহেব’।
কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেশ কয়েকবার ডাকল। তবুও কোনো সাড়া নেই। ‘আনোয়ার সাহেব শুনুন। আপনার জন্য অনেক খুশির একটা খবর নিয়ে এসেছি আমি। আপনি আজই ঘরের বাইরে বের হবেন’।
এরপরও আনোয়ার নড়ছে না। নিথর হয়ে আছে। এবার আলেয়া একটু নিচু হয়ে লোকটার শরীর ধরে কয়েকবার ধাক্কা দিল, ‘শুনছেন। আপনি মুক্ত। আপনার শরীরে এইচআইভি নেই। আপনার এইডস হয়নি। এই যে দেখুন রক্ত পরীক্ষার ফল এসে গেছে’। বলে কাগজ বের করে সে। ‘দেখুন, দেখুন’। বলে নিচু হয়ে অনেকটা জোরেই ধাক্কা দেয়। কপালের ওপর ভাঁজ করে রাখা আনোয়ারের একটা হাত নিচে পড়ে গেল।
চমকে ওঠে আলেয়া। কপালে হাত রাখে। বরফ শীতল ঠান্ডা। নিশ্বাসের শব্দ নেই। বুকের ওঠানামা বন্ধ। মানুষটা মরে গেছে। নিঃশব্দে আলেয়া ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
হিজল ফুলের কার্পেট মাড়িয়ে আলেয়া এগিয়ে গেল বলেশ্বর নদীর কাছে। নদীর পানি টলটলে। বাতাসে দুলছে গাছের পাতা। তবু বিষণ্ন লাগছে সবকিছু। সে হেরে গেছে! একি; আলেয়া কাঁদছে!