সফল বইমেলায় আরও কিছু চাওয়া

২৭তম বই মেলায় সবার মধ্যে যে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ ছিল তা নিশ্চয় আশার আলো হয়েই থাকবে
২৭তম বই মেলায় সবার মধ্যে যে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ ছিল তা নিশ্চয় আশার আলো হয়েই থাকবে

এই দূর পরবাসেও বিভেদ থাকার কারণে আমাদের মধ্যে খুব কম ক্ষেত্রেই এক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। অথচ ২৪ জুন মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত নিউইয়র্ক বইমেলার সমাপ্তি দিনে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বেরোবার সময় মনে হলো এসব মন্দ ধারণা বুঝি আমাদের মধ্য থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। এবারের এই সফল মেলায় অংশগ্রহণকারী সবার মধ্যে যে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ দেখেছি, তা নিশ্চয় আমাদের জন্য আশার আলো হয়েই থাকবে। সম্মিলিত এই ভাবনার আরও প্রসার ঘটুক। আরও নতুন নতুন প্রয়োগ ঘটুক, তা যেন নিউইয়র্কের প্রতিটি বাঙালির চলমান আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয় সেই আশা করি।
সর্বক্ষেত্রে আমাদের জয়জয়কার হোক, এই ভাবনায় আজ আমরা যেন হতে চাই একই পথের যাত্রী, জয়ের পথের যাত্রী। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যদি এমন হতো? হতেও তো পারে! নিশ্চয় হবে। ২০১৮ সালের সফল বইমেলা যেন তাই দেখিয়ে গেল।
মনে বাজছিল সেই গানটির কথা...‘এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে, এই দিনেরে নিবা তোমরা সেই দিনেরও কাছে’। আমার দেশে অথবা দূর পরবাসে, যেখানেই হোক না কেন, নিজেদের উন্নতির জন্য সব সময় থাকব এক জোট, এক আত্মা, একজাতি, বাঙালি জাতি।
নিউইয়র্কের বইমেলা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ২৭ বছর আগে বলতে গেলে সম্পূর্ণ এক ব্যক্তির উদ্যোগে। আমার এক পরিচিত ব্যক্তি জানালেন, নিউইয়র্কের একমাত্র বাংলা বইয়ের দোকান মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিত সাহার কাছ থেকে বই সংগ্রহ করছেন তাঁর রান্নাঘর থেকে। মানে তাঁর বসতবাড়িই ছিল পুরোদস্তুর একটি বইয়ের দোকান। পুরো পারিবারিক পরিবেশে শুরু করা পাঠকের কাছে বই তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় অবশ্যই ছিল অনেক ঝুঁকি। ওই সময় সিডির দোকান বা গ্রোসারি দোকান না খুলে বইয়ের দোকান খোলার চিন্তা করতে অনেক সাহসের প্রয়োজন ছিল বৈকি। আর্থিক টানাপোড়েনসহ বড় ধরনের আর্থিক লোকসান হবে জেনেও সেই পথে পা মাড়ানো কোন ছেলেখেলা ছিল না। অথচ বিশ্বজিত সাহা নামের বই প্রেমিক তা নিজে করে দেখালেন।
বইমেলার ইতিহাস, স্বাধীন বাংলাদেশের মতো অনেক প্রাচীন। ১৯৭২ সনের ৮ ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরা চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। বইগুলো ছিল স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে বাংলাদেশের মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই) দিয়ে শুরু হয়েছিল সেই বইমেলা। ওই মেলা একাকী তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যান। পরে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র যুক্ত হয়।
সেই সময়ে শুরু করা মেলা আজ বাংলাদেশে সাহিত্যপ্রেমীদের বৃহৎ মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এর পৃষ্ঠপোষকতায় আজ রয়েছেন লাখ লাখ বই প্রেমিকসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
তিন দিনব্যাপী হয়ে যাওয়া মেলায় দল বেঁধে হাজারো নিউইয়র্কবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে মনে হয়ে হয়েছে, মেলায় আসা কিশোর আর তরুণেরা এই বইমেলাকে ভবিষ্যতে আরও উজ্জ্বল সোনালি দিনের কাছে নিয়ে যাবেন। তবে এর জন্য প্রয়োজন আধুনিক ভাবনার সফল প্রয়োগ। যেকোনো নতুন উদ্যোগের ত্রুটি থাকতেই পারে, তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা পোষণ করা খুবই জরুরি বলে আমার ধারণা।
একটি অভিজ্ঞতার উদাহরণ আমার উল্লিখিত বিষয়কে আরও পরিষ্কার করবে বলে ধারণা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম গানের সিডির কভারের ডিজাইন করলেন দেশের নামকরা একজন প্রচ্ছদ শিল্পী। কভারে ছিল আমার একখানা ঢাউস হাস্যরত ছবি। পাশে নামকরা সব শিল্পীসহ সুরকারের ছবি। ঘটা করে সিডির মোড়ক উন্মোচন হলো। প্রচারের সব কটি মাধ্যমে নিয়মিত প্রচার করে তেমন সাড়া পাচ্ছিলাম না।
মুক্তধারায়াও বেশ কয়েকখানা সিডি দিলাম বিক্রির উদ্দেশ্যে। তা ছাড়া প্রায়ই মুক্তধারায় নতুন বই কিংবা ভালো সাময়িকীর খোঁজে যাই। দোকানের কর্ণধার বিশ্বজিত সাহার সঙ্গে নানা বিষয় আলাপের পাশাপাশি আমার সিডি কম বিক্রি হওয়ার কারণ জানতে চাই। তিনি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, আমি জানি কেন? তবে এর উত্তর আপনাকে দিতে হলে আপনার অনুমতি লাগবে। আমি বললাম, আপনি নির্ভয়ে সত্য বলুন! উত্তরে তিনি বললেন, আপনার সিডির কভারের ডিজাইন দেখলে মনে হয় যেন, মহিলাদের পরনের শাড়ির চেয়ে শাড়ির নিচে পরা পেটিকোট লম্বা হয়ে গেছে। কারণ আপনি নিজেকে বড় করে তুলে ধরছেন। অথচ যাদের কম সমাদর করে সিডির কভারে ছোট ছবি দিলেন, তাঁরা বাংলাদেশের সংগীত জগতে অনেক আগে থেকে উজ্জ্বল তারকা। তাই আপনার নিজের বেশি বেশি প্রচার না করে আসল গুণীজনের কদর-সমাদর বেশি করে করুন। ভালো ফল পেতে পারেন। যে যেখানে থাকার কথা, তাকে সেখানে বসিয়ে যথাযথ সম্মান দিন।
সদ্য শেষ হওয়া বই মেলার নানা পর্বে অনেক নামীদামি সাহিত্য ব্যক্তিত্বসহ কবি-লেখকদের সরব উপস্থিতি বইমেলাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। নিউইয়র্কের সংস্কৃতিপিপাসু পাঠক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা ছিলেন ক্ষেত্র বিশেষে রোমাঞ্চিত। বড় বড় সাহিত্যিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় নানা বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য অনেককে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে দেখা গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য দেখা গেছে, কিছু কিছু পরিবেশনায় কেউ কেউ জোর জবরদস্তি করে কর্তৃত্ব কব্জা করার চেষ্টায় ছিলেন। অনেককে মনে হয়েছে, তাঁরা যে সম্মানীয় টাইটেল স্কন্ধে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, তা যেন শাড়ির মাপের চেয়ে পেটিকোটের মাপ বড়—এমন ডিজাইনের, যা একদা আমি নিজেও পরেছিলাম।
আমার এই বক্তব্য সবাই হয়তো মেনে নেবেন না। বিশেষত মেলার আয়োজকেরা তো নয়ই। কারণ তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ব্যস্ত ছিলেন সাইজিং, পালিশিং ও মালিশিংয়ের মত মহান কর্মে। তবে আশার কথা, অনেক তরুণ সাহিত্যকর্মী কিন্তু এই তালিকায় ছিলেন না। একদম নিজের চোখে দেখা। সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি একমাত্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারা সৌভাগ্যবানদের একজন হিসেবে বলছি, কারও কারও প্রচেষ্টা ছিল প্রশ্নাতীত। অভিনন্দন জানাই সেই তরুণ সাহিত্য-কর্মীদের।
সবকিছুর পরও আমরা স্বীকার করতে বাধ্য, নিউইয়র্কের সব স্তরের সাহিত্য প্রেমীদের উচ্ছ্বাস আর বাঁধ ভাঙা আনন্দে নিউইয়র্ক বইমেলা ছিল সারাক্ষণ মুখরিত। ঢাকা থেকে আসা প্রকাশক এবং স্থানীয় বইপ্রেমীদের ভাষ্য মতে, মেলায় বই ও সাময়িকীর বিক্রি ছিল আশাতীত। পরিশেষে আমার কলেজজীবনের অভিজ্ঞতা সংযোজন করে নিউইয়র্ক বইমেলাকে স্বচক্ষে দেখার অনুভূতি প্রকাশের ইতি টানতে চাই। চিটাগাং কমার্স কলেজে পড়াকালে কলেজের পাশে হোস্টেলে থাকতাম। সুপার ছিলেন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ডাকসাইটে শিক্ষক আবদুর রহিম চৌধুরী।
হোস্টেলের চারতলায় থাকতেন। এইচ অক্ষরের ডিজাইনের ভবনের দ্বিতীয় তালার উত্তর সাইডের দোতলায় প্রথম বর্ষের ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা।
প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহের কোন একদিন উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক বিভাগসহ স্নাতকোত্তর শাখায় অধ্যয়নরত ছাত্রদের একজন করে মাসিক সভায় ডাকা হতো। সভা চলতো কমপক্ষে চার ঘণ্টা। চট্টগ্রামের বিখ্যাত বেলা বিস্কুটের সঙ্গে মিষ্টি চাঁপা কলা দিয়ে কমপক্ষে দুবার চা পরিবেশিত হতো। প্রতি শাখার একজন করে সহকারী সুপার অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিতেন। নানা ধরনের সাজেশন ও চমকে দেওয়া মতামত সংবলিত প্রস্তাব রাখা হতো। কিন্তু প্রতি মাসেই দেখতাম, একমাত্র হোস্টেল সুপার প্রয়াত আবদুর রহিম চৌধুরীর একক সিদ্ধান্তে ছাত্রাবাসের যাবতীয় কাজকর্ম সারা মাসব্যাপী চলতো। বই মেলায় সংখ্যাটা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত, একের বদলে মাত্র তিন থেকে চারজন।
এত কিছুর পরও আগামী বইমেলা নিয়ে চূড়ান্ত আশাবাদী হয়েই থাকতে চাই, ‘এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে, এই দিনেরে নিবা তোমরা সেই দিনেরও কাছে’। এ আমার আগামী প্রজন্মের প্রতি আহ্বান। কারণ সেই দিন তো একবারে খুব কাছে এসে বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছে, যেদিন এই নগরীর সব আয়োজনের ভার নিজ স্কন্ধে তুলে নেবে কয়েকজন স্বপ্নচারী তুর্কি তরুণ!