বিমানবালা ও পেশার মর্যাদা

বাংলা অভিধানে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট শব্দের বাংলা হচ্ছে বিমানবালা, কেন এই পেশার এমন নামকরণ করা হয়েছে, আমি ঠিক জানি না। ‘বালা’ শব্দটিতে যেমন একটা তাচ্ছিল্য ভাব আছে, তেমনি পেশাটিকে ছোট করে দেখার একটা প্রবণতা আছে। একে মানসিক অসুস্থতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। অথচ এটি সাহসী, স্মার্ট চ্যালেঞ্জিং চাকরি হিসেবে বেশি প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল। এমন নয় যে, যোগ্যতা না থাকলেও এই চাকরি পাওয়া যায়। সুন্দরের সঙ্গে শিক্ষা, জ্ঞানগরিমা, বুদ্ধিমত্তার ছাপ মিললে তবেই এমন চাকরি ভাগ্যে জোটে। তুলনামূলক ইংরেজি শব্দটাকে মার্জিত মনে হয় এবং আমি এই শব্দ ব্যবহার করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এক ধরনের শ্রদ্ধা আপনা থেকেই কাজ করে। তাই বোধ করি, এই পেশাকে ছোট করে দেখার মানসিকতাও কাজ করে না।
আমার দেখা আমেরিকার এই শহরে এটা একটা মানসম্মত চাকরি। এর জন্য যথেষ্ট যোগ্যতা রাখতে হয়। প্রথমত এসব চাকরিতে জীবন-বৃত্তান্ত জমা দেওয়ার সুযোগ পাওয়াটাই আকাশ ছোঁয়ার মতো। তারপর টিকে থাকার জন্য করতে হয় লড়াই! লিখিত পরীক্ষা, সাক্ষাৎকার, প্রশিক্ষণসহ সব যথাযথভাবে পাস করতে হয়। পৃথিবীজুড়ে সে-ই জানে কত কঠিন এ রকম একটা চাকরি পাওয়া, যাকে একটা ভালো চাকরির জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়; সে হোক ছেলে বা মেয়ে। যোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই পেছনে পড়ে যায়। পাইলট থেকে শুরু করে কেবিন ক্রু, সবাইকে ক্রু সদস্য হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্য দেশ ভ্রমণকালে দূর যাত্রী পাইলট, ক্যাবিন ক্রুদের জন্য খুব ভালো থাকার ব্যবস্থা থাকে। যদিও পাইলট হচ্ছে পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চ মূল্যমানের চাকরি।
অফিসে আসার পর প্রতিদিন সকালে এসব ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের কারও না কারও সঙ্গে দেখা হয় ড্রেসিং রুমে, বলা যায় খুব কাছে থেকে দেখতে পাই তাদের। হয়তো প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবেই আগেই তারা হাই বলেন। মূলত ক্যাপ্টেন, ক্রু-রুম সংলগ্ন বাথরুমটিতে ড্রেসিংরুমের বাড়তি সংযোজন মহিলা পাইলট, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের জন্য। বেশি সুন্দর হওয়ায় আমরা কেউ কেউ এখান থেকে পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে ভেতরে যাই। কথা প্রসঙ্গে এক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে আমাকে খুব উৎসাহ দিচ্ছে, কেন আবেদন করি না! ওরা অনেক বেশি বেনিফিট পায়। উদাহরণ দিয়ে সে বলল, পৃথিবীর অনেক দেশে যাওয়া যায়, আন্তর্জাতিক এক ফ্লাইটে আসা-যাওয়া থাকলে এক দিনেই পনেরো ঘণ্টা উঠে যায়। অনেক সময় ৩/৪ দিনে চল্লিশ ঘণ্টা হয়ে যায়। যেমন লন্ডন বা প্যারিস আসা-যাওয়া মিলিয়ে একই সময় লাগে। কোনো কারণে যদি আসা না হয়, তবে সে সব দেশের পাঁচ তারকা হোটেলে রিজার্ভেশন থাকে। তার কথা শুনে বেশ আকর্ষণীয় মনে হলো। বললাম, ‘কিছুদিন আগে ওপেন পজিশন মেইল পেয়েছি, কিন্তু আবেদন করিনি। কারণ আমার মেয়ে আছে, চাকরি হলেও তাকে একা রেখে ভ্রমণ অসম্ভব।’ বলল, তারও সাত বছর বয়সের মেয়ে আছে, তার মা রাখেন। এটি ঠিক, এ দেশে যে সব বাচ্চার নানি-দাদি আছে তারা এক কথায় ভাগ্যবান, মায়েদের তেমন চিন্তা করতে হয় না।
আরেক সকাল বেলা দুজন বয়স্কা শ্বেতাঙ্গী মহিলা অ্যাটেনডেন্টের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁরা মাত্র ফিরেছেন কোনো ফ্লাইট শেষ করে। দুজনে বেশ হাসিখুশি, থাইল্যান্ডে ছিলেন—এসব গল্প করছেন। আমি তখন বললাম, ‘আপনাদের কী মজা, কত নতুন দেশ ভ্রমণ করেন’! হাসি দিয়ে বললেন, ‘হানি সব সময় তো বাইরে যাওয়া যায় না, আমরা শুধু হোটেল রুমই দেখি। গোসল করি তারপর ঘুম, এভাবেই চলে যায়।’ আমি বললাম, ‘তারপরও তো দামি হোটেল, খাবার-দাবার এবং সুন্দর বিমানবন্দর—এসব তো উপভোগ করো।’ হাসি দিয়ে দুজনই সম্মতি দিল।
আমাদের মধ্যে মেয়েদের বাইরে রাত যাপনের বিষয়টা, নেতিবাচকভাবে দেখে অনেকে। কমবেশি অনেককে ভাবনায় ফেলে দেয়। এসব পেশার সুযোগ-সুবিধার কথা ভেবে অনেকে নিজের মনেই কাহিনি বানান এবং বদনাম করতেও ছাড়েন না। তবে কথা কী, অনেক সময় গির্জা, মন্দির, মসজিদে যেমন খারাপ মানুষ অবস্থান করে, এসব পেশায় যে খারাপ দু-একজন নেই, তা কিন্তু নয়। তাই বলে এ পেশার মানুষকে ছোট বা সস্তা ভাবা উন্নত মানসিকতা নয়। ‘অন ডিউটি’ আমার দেখা অনুযায়ী সবাই নিজস্ব অবস্থানে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব ধরে রাখেন। টার্মিনাল বি’তে আমেরিকান অফিস সংলগ্ন একটা রুম আছে ‘ক্যাপটেনস স্লিপিং রুম, ডোন্ট ডিস্টার্ব’। এই এলাকা দিয়ে সবাই নিঃশব্দে চলাফেরা করেন। একজন পাইলটের যথার্থ বিশ্রামের ওপর একটা ফ্লাইটের অনেক যাত্রীর নিরাপদ ভ্রমণ নির্ভর করে। তাই এ ব্যবস্থা, সুতরাং এসব ইতিবাচক হিসেবে দেখলেই ভালো। বাইরের দিকে ভবনের ওপরে দীর্ঘ সময় অবস্থানকারী ক্যাপ্টেনসহ অন্য ক্রুদের থাকার ব্যবস্থা আছে, অনেকটা পাঁচ তারকা হোটেলের মতো। সেখানেও কেউ কারও সীমা ভোলেন না। ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো তারা কর্তব্যকর্মের বাইরে ব্যবহার করেন। তাই একটা চাকরির পদবি বা মানুষকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
বোহিমিয়ান এই চাকরি জীবনে পয়সার চেয়ে বেশি ভ্রমণ চাঞ্চল্য, আকাশে ঘুড়ির মতো ঘুরে বেড়ানোর আনন্দবাজার করে। পক্ষান্তরে খারাপ দিক আমার মনে হয়, তিনটি ব্যাগেজ নিয়ে সদা ভ্রমণ আর কিছু না। চলতি-ফিরতি জীবনে ঘটন-অঘটন কোথায় কার কখন কী হয়, কেউ জানে না। হাত ব্যাগ ছাড়া বাকি দুটি ব্যাগেজে কী থাকে একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলছিলেন, একটার মধ্যে প্রয়োজনীয় অনেক কাগজপত্র রাখতে হয়, সঙ্গে খাবারদাবার। বড়টিতে কাপড়চোপড় থাকে। এগুলো সঙ্গে নিয়ে তারা প্রতিদিন দৌড়ান। আজ সকালবেলা আমি যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রসাধন নিচ্ছি, দেখি অল্প বয়সী ফরসা সুন্দর একটা মেয়ে পোশাক পরে বড় লাগেজের চেইনটা লাগাতে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। তার বাম হাতে জোরে চাপ দিলে, ডান হাতে চেইনটা লাগানোর মতো শক্তি কাজ করছে না। পরে আমি তাঁর সহায়তা এগিয়ে গেলাম। এই বাক্সপেট্রা সংক্রান্ত জটিলতা ছাড়া আমার মনে হয় চাকরিটা সত্যিই আনন্দের এবং সম্মানজনক। সত্যি কথা বলতে, সম্মানটা রক্ষা করা হচ্ছে একজন ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। মহৎ পেশায় ভণ্ডদের অভাব নাই, তাই আসুন আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গিটা বদলাই।
আমি পাখি নই তবু পাখির মতো আকাশেই উড়ি
সুখে হাসি দুঃখে কাঁদি তারপরও জীবন এক রঙিন ঘুড়ি।