মানবতাই জগতের মহাশক্তি

কয়েক দিন আগের সকালটি ছিল অষ্টাদশী যুবতীর মতন আর দুপুর ছিল সদ্য একুশ পেরোনো যুবকের মতন। অষ্টাদশী যুবতীর চোখ পুড়ে যাওয়া তীব্র আলোর মতো সূর্যের প্রখরতার কাছে সকাল নামের স্নিগ্ধ সরলতা হারিয়ে গিয়েছিল। আর সদ্য একুশ পেরোনো যুবকের অপ্রতিরোধ্য গতির মতো তীক্ষ্ণতা ছিল গনগনে দুপুরের সূর্যে। যে গতির কাছে হার মানে পাহাড়, সাগর, আকাশ, জমিন সর্বোপরি পৃথিবী।
ঘড়ির কাটায় তখন সকাল সাড়ে ১০টা। বৃহত্তর লাকসাম ফাউন্ডেশন ইউএস ইনক আয়োজিত বার্ষিক বনভোজনে যোগ দিতে শহরের কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সপরিবারে আমি তখন নিউজার্সির ‘এসেক্স কাউন্টি প্যাডেল বোটিং হাউসে।’ ভয়াবহ গরমে মাথা ঘুরছে দেখে স্থানীয় তাপমাত্রা দেখে নিলাম। ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কিন্তু বসে থাকার কোনো ফুরসত নেই। কারণ, বনভোজনে সবাই আমার আমন্ত্রিত অতিথি। সকালের নাশতা তৈরি এবং আগত অতিথিদের সেবায় নিয়োজিত হওয়ার আগেই আমার ছেলেমেয়েদের মোটামুটি ছায়াযুক্ত একটা টেবিলে বসিয়ে তাপমাত্রার ভয়াবহতা সম্পর্কে জানিয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছি, যেন এই টেবিল ছেড়ে বাইরে কোথাও না যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিথিদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে বনভোজন এলাকা। কাজের চাপে প্রচণ্ড ব্যস্ত আমার হঠাৎ কানে ভেসে এল আমার মেয়ের উচ্চস্বর। তাকিয়ে দেখি, মেয়েটা তার টেবিলের পাশে দাঁড়ানো বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন মানুষের সঙ্গে কথা বলছে। কাছে গিয়ে জানলাম ম্যাক্সিকান এই বয়োজ্যেষ্ঠ দম্পতি তাঁদের নাতির জন্মদিন পালন করতে সকাল ৯টায় এসে লেকের পাশের এই টেবিলে বসেছিলেন। এখন তাঁরা আমার মেয়েকে টেবিলটি ছেড়ে দিতে বলছে। জায়গাটি যেহেতু আগেই আমাদের রিজার্ভ করা ছিল, তাই তাঁদের চলে যেতে বলা হলে যাচ্ছে না বলে মেয়েটা সিকিউরিটি গার্ডের সাহায্যে তাঁদের বিদায় দিল। সমস্যার সমাধান হয়েছে দেখে আমি ছেলেমেয়েদের পুনরায় তাপমাত্রার বিষয়ে সতর্ক করে কাজে মনোনিবেশ করি।
কিছু সময় পর ওই বৃদ্ধ দম্পতি নাকি আবার ফিরে এসেছে আমার মেয়ের কাছে। বিমর্ষ চিত্তে জানালেন, তাঁদের নাতির জন্য কেনা জন্মদিনের উপহার সামগ্রী খুঁজে পাচ্ছেন না। টেবিল ক্লথটিও লাগবে তাদের। মিম (আমার মেয়ের নাম) টেবিলের নিচ থেকে খুঁজে তাঁদের উপহার সামগ্রী, জুস, পানি, সোডা সব বের করে তাঁদের হাতে তুলে দিল। ভারী এতগুলো জিনিস তাঁরা একা বহন করতে পারছেন না বলে মিম তাদের সাহায্য করে জায়গামতন পৌঁছেও দিল। আসার সময় বৃদ্ধ লোকটি জানাল, ভুলে সে তার হাতের লাঠি ফেলে এসেছে। অসহনীয় এই রোদের মধ্যে ভদ্রলোক সাহস পাচ্ছে না এত দূর পথ হেঁটে এসে তাঁর হাতের লাঠিটি নিয়ে যেতে। মিম তাঁকে আশ্বস্ত করে এসে হাতের লাঠিটি নিয়ে আবারও তাঁর হাতে দিয়ে এল। সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে কথা বলার সময় মিম তাঁদের অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছে। গার্ড স্প্যানিশ বোঝেন না, ওই দম্পতি ভালোভাবে ইংরেজি বলতে পারেন না। স্কুলে মিম দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্প্যানিশ শিখছে বলে প্রয়োজনীয় কথা চালিয়ে নিতে পারে।
প্রায় চার শ মানুষের বনভোজনের কাজে ব্যস্ত আমি এসবের কিছুই জানতাম না।
ক্লান্ত আমি দুপুরের বারান্দায় গা এলিয়ে বিশ্রামের জন্য একটু বসা মাত্রই মেয়েটির মুখে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। জগতের সব মা সন্তানের মুখের দিকে তাকালেই তার শরীরের, মনের সব অবস্থা বুঝে ফেলে। দৌড়ে কাছে যাওয়া মাত্রই মেয়েটা আমার বুকের ওপরে পড়ে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল, আম্মু আমাকে বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রথমে বকাঝকা দিলেও পরে মেয়ের অসুস্থ অবস্থা দেখে মাথায় ঠান্ডা পানি ঢেলে, হাতমুখ মুছে অনেকটা মুমূর্ষু অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে মেয়েটাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।
মেয়ের অসুস্থ অবস্থা দেখে ক্ষোভ কিছুটা সামলালেও মনে ভীষণ রাগ পুষে রেখেছিলাম বাসায় এসে আচ্ছামত শাস্তি দেব বলে। বনভোজন শেষে ক্লান্ত আমি বাসায় ফেরার পথে দেখি, সত্তরোর্ধ্ব ওই দম্পতি আমার পথ আগলে দাঁড়িয়েছেন মিমের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মিম নেই বলে আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমি যেন দয়া করে এটি মিমের হাতে পৌঁছে দিই। চিরকুটে লেখা ছিল,
প্রিয় মিম, মানবতাই জগতের মহাশক্তি। তুমি একজন মানবিক মানুষ। তোমার মানবিক আলো ছড়িয়ে পড়ুক জগতের সর্বত্র। জীবনে কোনো দিন হয়তো তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না, কিন্তু তোমার কথা আমাদের মনে থাকবে। দোয়া ও ভালোবাসা নিয়ো।
বনভোজনে আগত সম্মানিত সব অতিথিদের বিদায় দিয়ে গাড়িতে বসে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোতে চিরকুটটি পড়ছিলাম আর গরমে অসুস্থ হয়ে পড়া মেয়েকে দুপুরে যে বকাঝকা করেছিলাম, সে কষ্টে অশ্রুজলে ভেসে যাচ্ছিলাম। রাত দশটায় বাসায় ফিরে মেয়েকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, কেন আমার কথা অমান্য করে দুপুরের কড়া রোদে বাইরে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছ? এত দূর থেকে তোমাকে বাসায় পাঠাতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। উত্তরে মেয়েটি বলল, আম্মু তাঁরা বয়স্ক মানুষ। হাঁটতে পারছিল না। নাতির জন্মদিন পালন করতে না পারার যন্ত্রণা তাঁদের চোখে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি সাহায্য করার পর তাঁদের চোখে যে চকচকে আনন্দের দৃশ্য দেখেছি, পৃথিবীর কোথাও এত আনন্দ আগে দেখিনি আম্মু। তোমাকে অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমাকে তুমি এখন মারো, বকো।
মেয়েকে ঘুমিয়ে পড়ার কথা বলে দ্রুত প্রস্থান করি।
মাঝরাত। মেয়েটি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমার চোখে ঘুম নেই। বিবেকের দংশনে পুড়ে যাচ্ছি। নিজের জীবনের অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মেয়েটিকে যখন কারণে-অকারণে বলি স্বার্থপর এবং আরও কঠোর হও। তখন দেখছি, তার বুক থেকে বিন্দুমাত্র মানবিক গুণাবলি সরাতে পারিনি এবং দিন শেষে পৃথিবী মানবিক মানুষদের মনে রাখে। মানবতা এমন এক শক্তি অন্য কোনো শক্তি দিয়েই একে শেষ করা যায় না। মেয়েটির মাথার কাছে চিরকুট হাতে বসে আছি, আর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে মনে মনে বলছি, ‘মা আজীবন তোমার কাছে এভাবেই হেরে যেতে চাই আমি!’