দুই পয়সার জীবন

আমার পুরো নাম শেফালী ইসলাম। স্বামীর নামের শেষ অংশে ’ইসলাম’ আছে বলে আমিও এখন ইসলাম হয়ে গেছি। বাবার নাম ছিল আরিফুর রহমান। বাংলাদেশের একটা মফস্বল শহরের উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। আমরা তিন বোন। সবাই পিঠাপিঠি। ফুলের নামে বাবা আমাদের সব কটা বোনের নাম রেখেছিলেন। বড় বোনের নাম বকুল, সেজ বোনের নাম দোলন আর আমি শেফালী। যে বাড়িটায় আমার জন্ম সেখানেই আমার কৈশোর অতিক্রম হয়েছে। লাউয়ের ডগার মতো সেই বাড়িটায় তর তর করে বেড়ে উঠেছিলাম আমি। আমাদের বাড়িটার ঠিক সামনেই ছিল একটি শেফালী ফুলের গাছ। খুব একটা বড় না। আমার থেকে হয়তো উচ্চতায় এক হাত বেশি লম্বা। সেই শিশিরঝরা ভোর সকালে আমরা তিন বোন ঘুম থেকে উঠে খালি পায়ে এক দৌড়ে শেফালী ফুলের গাছটার নিচে চলে যেতাম। বুড়ো আঙুলের ওপর ভর করে পা টিপে টিপে তখন আমরা হাঁটতাম। যদি আবার পায়ের নিচে নরম শেফালী নিষ্পেষিত হয়ে যায়!
শরৎ মৌসুমে খুব ভোর সকালে খালি পায়ে দুর্বা ঘাসের ওপর হেঁটেছেন কেউ? দুর্বা ঘাসের ওপর পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই চপ চপ করে সেখান থেকে শিশির কণাগুলো আমাদের ছোট ছোট পা ভিজিয়ে দিত। আহা! সেই নিয়ে আমাদের আনন্দের কোনো শেষ ছিল না! শেফালী ফুলের গাছটার নিচে মাটিতে তারার মতো ফুটে থাকত সাদা আর কমলা রঙের হাজারো শেফালী ফুল! মনে হতো, কেউ বুঝি সেখানে সাদার সঙ্গে অল্প কিছু কমলা রং মিশিয়ে একটি বিছানা পেতে রেখেছে। সারা রাত গাছের পাতায় টুপটাপ শিশিরের শব্দ শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পরতাম। আর সেই শব্দের তালে তালে শেফালী ফুলগুলোও মাটিতে পড়তে শুরু করত।
আমাদের বাড়ি থেকে আরও ৫/৬টি বাড়ির পারেই ছিল ঋষি বাড়ি। সেখান থেকে প্রতিদিনই নবিতা দি আসতেন পুজোর জন্য শেফালী ফুল নিতে। নবিতা দি’র ফুল যাতে আবার মাটিতে পড়ে নষ্ট না হয়ে যায়, সে জন্য বাবা খুব যত্ন করে গাছের একটা ডালের নিচে গামছা বেঁধে রাখতেন। ভোর সকালে ঝড়ে পড়া শেফালীগুলো সেই গামছার বুকে স্তূপ হয়ে জমা হতো। প্রতিদিন নিয়ম করে ভোরে নবিতা দি সেই ফুল নিয়ে যেতেন। আমাদের ছিল ছোট তিন চালার একটি টিনের বাড়ি। টিনের বাড়ি তো নয়, যেন সাক্ষাৎ এক চিলতে বেহেশত। বেহেশত এ কারণেই বললাম, বাড়িটার চারপাশে ছিল সুনসান নীরবতা। বাড়ির মাঝখানে ছিল বিরাট একটা উঠোন। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তিন বোন সেই উঠোনে বিভিন্ন রকম খেলাধুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। আমরা তিন বোনই ছিলাম বাবার চোখের মণি। সাত রাজার ধন।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবা বাড়ির কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দিতেন। ‘আমার বকুল, দোলন আর শেফালী মা, তোরা কইরে?’ আমরা বাবার কণ্ঠ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ছোট ঘরটা থেকে পাখির মতো উড়ে বের হয়ে বাবাকে ঘিরে ধরতাম। তারপরের ঘটনাও আমাদের সবার জানা ছিল। বাবা ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকতেন। কাঁধের ছোট ব্যাগটা মার হাতে দিতেন। মা সেটি সযত্নে দরজার পেছনে যে কাঠের একটা আলমারি আছে সেখানে রাখতেন। তারপর বাবার জন্য আগে থেকেই টিউবওয়েল থেকে তোলা ঠান্ডা এক বালতি পানি এনে বাবার দিকে এগিয়ে ধরতেন মা। বাবা সেই পানিতে হাত-পা ধুয়ে ঘরের ভেতর পুরোনো একটা কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেন। চেয়ারে বসার পরই শুরু হতো বাবার দ্বিতীয় পর্ব। ততক্ষণে বাবার চেয়ারকে ঘিরে আমদের তিন বোনের আহ্লাদেপনা চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয়ে যেত। বাবা সবার কথা একে একে জিজ্ঞেস করতেন। ‘শেফালী মা, তোমার আজকের অঙ্ক পরীক্ষাটা ভালো হয়েছিল তো? বকুল মা, তোমার চেহারাটা এত মলিন লাগছে কেন? আমার আরও কাছে এসে বসোতো মা। দোলন মা, এই দেখো, তোমার জন্য আজ ডেনমার্কের একটা ডাক টিকিট জোগাড় করে এনেছি। ইত্যাদি ইত্যাদি।’
দোলন আপার ছিল বিভিন্ন দেশের ডাক টিকিট সংগ্রহের শখ। বাবার সঙ্গে আমাদের যখন এসব আহ্লাদেপনা চলতো তখন মাও আমাদের সঙ্গে চুপ করে পেছন দিকে এসে দাঁড়াতেন। মাকে দেখেই বাবা তাঁর সাদা পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেন। সেখান থেকে এক মুঠ খয়েরি রঙের বকুল ফুল নিয়ে মার হাতে তুলে দিতে দিতে বলতেন, ‘এই নাও। তোমার জন্য খুব সামান্য উপহার’। আমাদের সামনে মা একটু লজ্জা পেতেন বৈকি! কিন্তু মার লাল লজ্জাবনত চেহারা দেখে তাঁর স্বর্গতুল্য সুখটাকে আমরা ঠিক আবিষ্কার করতে পারতাম। আমাদের বাড়ির চারপাশে ছিল নানা রকমের গাছগাছালি। সবই বাবার কাণ্ড। বাবা প্রতিটি গাছের নাম দিয়েছিলেন। যেমন আমাদের ঠিক ঘরের সামনেই বড় যে অশথ গাছটা ছিল, বাবা তার নাম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি বুক উঁচু করে সব গাছ ছাড়িয়ে বিশালতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমাদের ঝাঁকড়া চুলো একটা আম গাছ ছিল। সেটির নাম ছিল নজরুল। এভাবে গান্ধী, লুথার কিং থেকে শুরু করে সব বড় বড় শিল্প সাহিত্যিক, দার্শনিকের নাম অনুসারে আমাদের গাছপালার নাম হয়েছিল। গাছগুলো দেখভালের জন্য আমদের তিন বোনের মধ্যে দায়িত্বও ভাগ করে দেওয়া থাকত। যেমন আমি বেশির ভাগ সময় গান্ধী, লুথার কিং আবার কখনো কখনো রবীন্দ্রনাথের পরিচর্যা করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
আগেই বলেছি, আমার বাবা ছিলেন প্রচণ্ডরকম একজন গাছপ্রেমিক মানুষ। সেই নানা রঙের গাছের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরাও একদিন বড় হয়ে গেলাম। আর বাবা-মা বুড়ো হয়ে গেলেন। একদিন আমরা কলেজ পাশ করলাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর বিয়ে। বড় আপা বকুল বিয়ে করে চলে গেল ঢাকায়। মেজ আপা দোলন বিয়ে করে চলে গেল চিটাগাং। কারণ তার বর সেখানকার ডক ইয়ার্ডের ব্যবসায়ী। আর আমি এই শেফালী ইসলাম বিয়ে করে চলে এলাম সুদূর আমেরিকার ব্যস্ততম শহর নিউইয়র্কে। নিউইয়র্কের চার দেয়ালের মাঝেই আমার জীবন। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কি সেই শেফালী ইসলাম? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমারও কি সুন্দর একটা নদীর মতো জীবন ছিল!
আমাদের তিন বোনকে বিয়ে দিয়ে বাবা-মা এখন বাড়িতেই থাকেন। তবে তাঁরা দুজনই খুব একা। বাবা অবসর নিয়েছেন। আগের মতো শরীরের অবস্থাও আর নেই, মাও বৃদ্ধা। আমরা তিন বোনই প্রতিদিন দূর থেকে ফোন করে তাঁদের কুশলাদি নেই। এইতো প্রবাস জীবন। আমার স্বামী নিউইয়র্কের একজন সরকারি চাকুরে। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, আসে সেই সন্ধ্যায়। আমার দুটো ছেলে। সকালে তাদের জন্য স্বামীর জন্য নাশতা তৈরি করি তারপর তার দুপুরের খাবারটা তৈরি করে ওর টিফিন বক্সে দিয়ে দিই। সকালের খাবার পর্ব শেষ হতে না হতেই শুরু হয় দুই বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া। ওদের স্কুল আমাদের উডসাইডের বাসা থেকে খুব একটা দূরে না। দুজনই একই স্কুলে পড়ে। স্কুলে দিয়ে এসে আমি ঘরবাড়ি গোছানো, রান্না-রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তারপর বিকেলে আবার ছেলে দুটোকে আনতে যাই। ছেলেদের বাসায় নিয়ে আসার পর আবার তাদের খাবার খাইয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিই। বিকেলে শুরু হয় আরেক রুটিন। বাচ্চাদের নিয়ে পাশের কোনো পার্কে যাই। তারা সেখানে খেলাধুলা করে। আমি পাশের একটা বেঞ্চে বসে বসে তাদের দেখি আর অতীতের সব স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়ে পড়ি।
পার্ক থেকে বাসায় আসার একটু পরই আমার স্বামী অফিস থেকে বাসায় আসে। বাসায় এসেই হয় ফেসবুক অথবা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটিয়ে দেয়। কখনো কখনো জ্যাকসন হাইট্‌সেও চলে যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। প্রথম প্রথম আমার খুব রাগ হতো। বাসায় আসার পর আমার সঙ্গে এক ঘণ্টা সময় কি সে দিতে পারে না? তখন মনে মনে বাবার চেহারাটা স্মরণ করতাম। আহা! বাবা প্রতিদিন রুটিন করে আমাদের কীভাবেই না সময় দিতেন। নাহ! এখন আর এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি অনেকটা মেশিনের মতোই এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। রাত হলে বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক করিয়ে রাতের খাবার শেষে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে আমার একটু নিস্তার হয়। রাত দশটা থেকে বারটা। এই দুই ঘণ্টা আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ। কারণ এই সময়টা একান্ত আমার। আমি নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখি (অবশ্য বোবা সিনেমা দেখি। কারণ শব্দসহ দেখলে আবার স্বামী-সন্তান সবাই ঘুম থেকে উঠে যাবে এই ভয়ে), কখনো কখনো রবীন্দ্রনাথ অথবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ি। কখনো কখনো স্রেফ ইউটিউবে শাড়ি গয়নার ছবি দেখি। এইতো আমি! শেফালী ইসলাম!
কয়েক দিন আগে উইকেন্ডে আমাদের বাসায় আমার স্বামী তার কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে এলেন। যথারীতি আমি তাঁদের আসা উপলক্ষে বিশেষ রান্নার আয়োজন করলাম। সবাই আমার রান্নার খুব প্রশংসা করল। তাঁদের একজন খাবার খেতে খেতে বলে উঠলে, ‘ভাবি, আপনি তো চাকরি-বাকরি করেন না, তাই হয়তো এতসব রান্না করার সময় পান। তাঁর কথায় আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। শুধু নয়টা-পাঁচটা অফিস করলেই বুঝি কাজ করা হয়ে গেল? এই যে আমি সকাল বিকেল ঘরের কাজ করি, সংসারের হাল ধরি, ছেলেপেলে মানুষ করি, লন্ড্রি করি, বাজার করি—এসবের বুঝি কোনো মূল্য নেই? হয়তো নেই। পুরুষেরা ধরেই নেয়, কাজকর্ম মানেই ঘরের বাইরে যেয়ে শ্রম দেওয়া। ঘরেও যে একজন নারী প্রতিদিন শ্রম দেয়, তারা সেই হিসাবটা এখনো কষতে শেখেনি। কবে শিখবে কেউ আমাকে বলতে পারেন? অথচ আমার বাবাকে দেখেছি, মাকে কি সম্মানটাই না দিতেন? বাবাতো ছিলেন সেই সেকেলে? তাহলে? আমরা যারা আধুনিক বলে নিজেদের দাবি করছি, আমরা কি ভেবে দেখেছি, আমরা এই তথাকথিত আধুনিক যুগেও কত সেকেলে রয়ে গেছি!
আমাদের বাবারাও যেমন তার সন্তান এবং স্ত্রীকে ভালোবাসতেন আবার আমার মাও তার স্বামীকে ভালোবাসতেন। তারপর আরেকটা বিষয়ের কথাও আপনাদের বলতে চাই। দেখতেই পাচ্ছেন, আর্থিকভাবে আমি কতই না পরনির্ভরশীল! আমার স্বামী জানেন, প্রতিদিনই আমার একটা খরচ আছে। আমার নিজের শখের কথা বাদই দিলাম। ঘরের জন্যও তো আমার কত কিছু কিনতে হয়। লন্ড্রির সাবানটা কিনতে হয়, বিকেলে পার্কে গেলে বাচ্চাদের জন্য আইসক্রিম কিনতে হয়, রান্নার তেল শেষ হয়ে গেছে, সেটিও আমাকেই কিনতে হয়। আমার স্বামী হয়তো গুনে গুনে সেই টাকাটাও আমার হাতে দিয়ে রাখেন। কিন্তু যখন টাকা হাতে আর থাকে না বা খরচ হয়ে যায়, তখন কেন জানি নিজের কাছেই খুব লজ্জা লাগে। স্বামীর কাছে আবার হাত পাতব? আবার চাইব? এক ধরনের অপমান বোধও আমাকে কুরে কুরে খায়।। মনে হয় আমি বুঝি টাকাটা চেয়ে কত অপরাধই না করে ফেলছি!
তারপরও জীবন গড়িয়ে যায়! আমাদের নারীদের জীবনতো এমনই! শত শত বছর ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের নারীদের হয়তো এভাবেই দেখতে চেয়েছে। কিন্তু আমি জানি, ৮/১০টি নারী বা পুরুষ নয়, একজন মানুষ হিসেবে আমার আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য আমাকে একাই লড়তে হবে। এই দুই পয়সার জীবনে এর যেকোনো বিকল্প নেই!

(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)