মনি, তোমাকে অভিবাদন

মে মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় তার সঙ্গে দেখা। প্রথম দেখা অবশ্য আড়াই বছর আগে আমার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে। তার নাম মণি। আমার বউমা রুবার ছোট ভাই। ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের নবম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র। তার কথা ভুলতে পারি না। ভোলাও যায় না।

সিলেট শহরতলির নূরপুরে রুবাদের বাসা। সন্ধ্যায় আমরা গিয়েছি দাওয়াত খেতে। বেয়াই-বেয়ান প্রায় কুড়ি জন মেহমানের আতিথেয়তায় ব্যস্ত। এ সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এটা নতুন কিছু নয়। প্রতিদিন ঘটেছে। মনে খটকা লাগল। এত উৎপাদনের পরও কেন প্রতিদিন লোডশেডিং। সরকারের কথা ও কাজে এ দেখি বড় গরমিল।

রুবাদের বাসার সামনে বেশ বড় উঠোন। পাশে সবুজ গাছগাছালি। জ্যোৎস্না রাত। উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। আমার স্ত্রীর সম্পর্কে দুই নাতনি রাত্রি ও নেহা। দুজনই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী। ইংরেজি ও পরিসংখ্যানে। বলল, নানা, অধ্যাপক জাফর ইকবালকে চেনেন? বললাম, ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। ১৯৮৯ সালে যখন নিউইয়র্কে যাই, তখন তিনি নিউজার্সিতে। প্রবাসী পত্রিকায় লিখতেন। রাত্রিকে বললাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নাম শুনেছ? বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই। কণ্ঠে শ্রদ্ধা। বললাম, তাঁকে কিছুটা চিনি। তিনি সিলেটের। শুনে বলল, সত্যি? হাঁ, সত্যি! রাত্রি ও নেহা শহুরে মেয়ে নয়। গ্রামের। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে এখন গ্রামের মেয়েরাও ইংরেজি-পরিসংখ্যানে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছে, ভেবে খুব ভালো লাগল।

হঠাৎ রাত্রি ও নেহা জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা নানা, আপনি তো লেখেন, এই লোডশেডিং কি আপনার লেখার বিষয় হবে? সম্পর্কে নাতনি, তাই একটু মজা করার জন্য বললাম, জানি না, তোমরাও তো আমার লেখার বিষয় হতে পার। ওদের নীরবতা দেখে বললাম, অবশ্যই লোডশেডিং নিয়ে লেখা উচিৎ।

এ সময় এগিয়ে এল মণি। আচ্ছা প্রথম আলোতে কী বিষয়ে আপনি লেখেন? বললাম মূলত কমিউনিটি নিয়ে। প্রবাসী বাংলাদেশি-আমেরিকান ইত্যাদি। পলিটিকস? না, বাংলাদেশের দলীয় পলিটিকস এড়িয়ে চলি। বলল, ভালোই হলো। নিরাপদে থাকবেন! পলিটিকস নিয়ে লিখলে একটা না একটা পক্ষ আপনাকে নিতেই হতো। বিতর্ক এড়াতে পারতেন না। মণির কথায় আমার আগ্রহ বাড়ল। স্কুলের ছাত্র। অথচ কথায় কী গভীরতা। আমাদের আলাপ জমে উঠল। বইপড়া মণির প্রধান নেশা। বই আর বই। সমসাময়িক পৃথিবীর সব খবরাখবরই মণির জানা। দেশ থেকে মহাদেশ, ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অনেক আলাপ হলো। ফুটবল? ব্রাজিলের সমর্থক। বললাম, আমি সেই ১৯৭০ থেকে ব্রাজিলকে সমর্থন করি। বলল, জানেন, আমার বাসার সবাই আর্জেন্টিনার সমর্থক। আমি একা পড়ে আছি। ভালোই হলো, আপনাকে পেলাম। মণি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আপনি এটিএন বাংলার মাহফুজুর রহমানের গান শুনেছেন? এর উত্তর না দিয়ে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি কর। বলল, খানিকটা। এ সময় বিদ্যুৎ চলে এল। বেয়াইকে বললাম, মণির সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে। মাশাআল্লাহ, ওর অনেক পড়াশোনা ও জ্ঞান। বেয়াই বললেন, আমার একটা অনুরোধ, আপনি তাকে বলবেন, ক্লাসের পড়াটা যেন ঠিক থাকে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মণি, আমাকে বলতে হলো না, মণিই কথা পাড়ল।

প্রধান যে কারণে মণিকে ভালো লাগল সে কথা বলছি। বউমা রুবার কাছে শোনা। বড়বোন আমেরিকায়। এটা খুব স্বাভাবিক, বড়ভাই বোন বিদেশে থাকলে ছোটদের অনেক আবদারই থাকতে পারে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক সামগ্রীর প্রতিই ঝোঁক থাককে বেশি। ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, মিউজিকপ্লেয়োর ইত্যাদি। আমেরিকায় বসবাসরত বড়বোনের কাছে মণির আবদারের তালিকায় এ সবের কিছুই নেই। তার আবদার তাকে কিছু বই দিতে হবে। সে বই পড়বে। সম্ভব হলে এক শটা। মণি, তোমাকে অভিবাদন।


লেখক: নিউ ইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক