সম্পর্ক রক্ষায় শ্রদ্ধাশীল হোন

প্রতিযোগিতা বা হিংসা নয়- সবাই মিলেমিশে থাকতে হয়
প্রতিযোগিতা বা হিংসা নয়- সবাই মিলেমিশে থাকতে হয়

সম্পর্ক বহু রকম। রক্তের সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক, আত্মীয় সম্পর্ক, অনাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রেমের সম্পর্ক, সৌজন্যমূলক সম্পর্ক ইত্যাদি। এখন আবার মুখ বই বন্ধু। ফ্যামিলি ট্রি বা রক্তের সম্পর্কের মধ্যে মা-বাবা, ভাই-বোন—এই সম্পর্ক সবচেয়ে খাঁটি নির্ভেজাল। একই মায়ের জঠর থেকে জন্ম নেওয়া ভাইবোন একই বাবা-মায়ের দেওয়া শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও সব সময় আর এক থাকে না। বড় হতে হতে আলাদা সত্তায় স্বতন্ত্র মানুষ হয় একেকজন। সব পিতামাতার স্বপ্ন থাকে সন্তানেরা মিলেমিশে পৃথিবীতে স্বর্গ গড়ে তুলবে। বাবা-মাকে আপন ভুবনে পরম যত্নে রাখবে। আর সন্তানেরা সবাই একে অন্যকে আদরে ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখবে। কিন্তু বাস্তবতা হয়ে উঠছে ভিন্ন। এক মায়ের পেটের ভাইবোনের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল বেশি, হিংসা-বিদ্বেষ অলিখিত এক প্রতিযোগিতা দেখা যায়।
এই প্রতিযোগিতা বা হিংসা কিসের জন্য? ক্ষমতা? সামাজিক মর্যাদা? নাকি সম্পত্তি? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। সম্পর্কের টানাপোড়েনে জীবন হয়ে ওঠে জটিল। দিন দিন জীবন থেকে মায়া-মমতা হারিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রের ব্যবহার যত বাড়ছে ততই মানুষ যন্ত্রের মতো হয়ে উঠছে। আগে আমরা এক সঙ্গে বসে সবাই মিলে টিভি দেখতাম। সেদিন পাল্টে গেছে। বাচ্চাদের জন্য আলাদা টিভিকক্ষ থাকে। বাচ্চারা কার্টুন বা ওদের পছন্দের চ্যানেল দেখে। একটু বড় হলে তাদের থাকে নিজের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফোন। নিজের মতো যখন যা ইচ্ছে দেখে। আস্তে আস্তে দূরে সরে যায়। সবকিছু নির্ভর করছে টাকার ওপর। বৈবাহিক সম্পর্ক আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন।

দুই আত্মায় মিল হলে দাম্পত্য জীবনে সুখ মেলে
দুই আত্মায় মিল হলে দাম্পত্য জীবনে সুখ মেলে

এই সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। প্রেমের বা পারিবারিকভাবে বিয়ে—যেটাই হোক না কেন স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের সুখ নির্ভর করে দুই আত্মার মিল হওয়ার ওপর। সুখী স্বামী-স্ত্রীর সন্তানেরা সাধারণত সুখী হয়। পক্ষান্তরে ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোর সন্তানেরা মানসিকভাবে হয় বিষাদগ্রস্ত হয়। আরও কিছু সম্পর্ক আছে। যেমন বন্ধু। এর কোনো সীমারেখা নাই। কেউ এক সঙ্গে পড়তে পড়তে বন্ধু হয়। কেউ এক সঙ্গে খেলতে খেলতে বন্ধু হয়। কেউ সমবয়সী, কেউ অসম বয়সী। কেউ তুখোড় খেলোয়াড়, তার বন্ধু হয়তো সাদামাটা খেলোয়াড়। কেউ খুব ভালো ছাত্র, তার বন্ধু হয়তো ব্যাক বেঞ্চার। কেউ অপূর্ব সুন্দরী, কেউ সাধারণ, তবু বন্ধু হতে কোনো বাধা নেই। কেউ মূর্তিপূজা করে, কেউ নিরাকারের সাধনা। তবু বন্ধু হতে কোনো অসুবিধা হয় না।
বন্ধু শব্দের ব্যাপ্তি অনেক। মুখবই জগতে বন্ধুর ছড়াছড়ি। এখন কেউ আর বয়স নিয়ে ভাবে না। বয়সের বেড়া ডিঙিয়ে, দেশের সীমারেখা পেরিয়ে মানুষ একে অন্যর বন্ধু হচ্ছে। এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক কখনো কখনো অনেক নিবিড় অনেক গভীর। আর এ জগৎ সংসারে সবচেয়ে সুন্দর আর স্বর্গীয় সম্পর্ক হলো প্রেমের সম্পর্ক। রাধা কৃষ্ণের প্রেম, শিরি ফরহাদের প্রেম, রোমিও জুলিয়েটের প্রেম যুগে যুগে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কত প্রেম কত ইতিহাস তৈরি করেছে। নৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ঠেলে এগিয়ে যায় মিলনের পথে। জীবন তবু চলমান। বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে প্রেম সার্থকতা পায়। কখনো পায় না। কিন্তু বড় প্রেম নাকি শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। দেবদাস পার্বতীর প্রেম দেখেছি আমরা, দূরে ঠেলে দিলেও এক মুহূর্তের জন্য ভুলতেই পারে না কেউ কাউকে। তারপর আরও কত সম্পর্ক আছে। যেমন সহকর্মী, প্রতিবেশী, সহযাত্রী, সহকারী বা সাহায্যকারী।
দেশে থাকতে সব সময় আলোচনা করতাম যে রিকশায় চড়ার আগে রিকশাওয়ালাকে সালাম দিই না কেন? আর গন্তব্যে পৌঁছানোর পর ধন্যবাদ বলি না কেন। আজ যখন উত্তর আমেরিকায় থাকি, দেখি ভাড়ার গাড়ি কল দিয়ে গাড়ি আসলে চালককে বলি-হাই। হাও আর ইউ ডুয়িং? পয়সা দিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় দিই-হ্যাভ এ গুড ওয়ান বা ড্রাইভ সেইফ বলে। সহকারী শব্দটি বাংলাদেশে বেশি প্রযোজ্য। বাংলাদেশে কাজের বুয়া, কাজের লোক বা বাবুর্চি, চালক ছাড়া চলে না। কোনো কোনো কাজের বুয়া পরিবারের সদস্য হয়ে যায়। পরিবারের অনিবার্য এই সদস্য অবহেলা পেলেও তাকে ছাড়া দিন চলে না।
প্রতিবেশীরা একসময় আমাদের বেড়ে ওঠার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। পাড়ার মুরব্বিরা সন্ধ্যার পর উঠতি বয়সী ছেলেকে রাস্তার মোড়ে দেখলে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। এখন পাশের বাড়ির ছেলে সিগারেট টানছে দেখলেও আমরা না দেখার ভান করে চলে আসি কিছু না বলে।
সহকর্মীদের কেউ কেউ এতটাই কাছের মানুষ হয়ে ওঠে যে একদিন না দেখলে মনে কষ্ট হয়। এভাবে ক্রমাগত দীর্ঘ সময় এক সঙ্গে কাজ করতে করতে কী এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্ক শুধু সহকর্মী বা বন্ধুত্ব পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না। এ যেন তার চেয়েও বেশি কিছু, যার কোনো নাম নেই। সুচিত্রা মিত্রের কাছের মানুষ-এ এর বর্ণনা পাই আমরা। নামে সহকর্মী কিন্তু ভেতরে-ভেতরে অনেকটাই অন্তর জুড়ে থাকে এরা।
কেউ কেউ আবার সীমা লঙ্ঘন করে অনৈতিক সম্পর্ক পর্যায়ে চলে যায়। যার পরিণতিতে সংসারে অশান্তি শুরু হয়, ভেঙে যায় সংসার। সময় বদলে দেয় জীবনকে। আধুনিক যন্ত্র নির্ভর যুগে দ্রুত বদলে যাচ্ছে সব। মানুষ এখন দূরত্বকে জয় করেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর অন্তর্জালের নানা মাধ্যমে কল, ভিডিও কলের মাধ্যমে সম্পর্কগুলো কাছ থেকে চলে যাচ্ছে দূরে, আর দূরকে টেনে আনছে কাছে। যন্ত্র নির্ভর এই সময়ে প্রত্যেকটি মানুষকে পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। ভালোবাসা বন্ধন টিকিয়ে রাখতে হবে। একপক্ষ ভুল করলে অন্য পক্ষের সহনশীল হতে হবে। একার চেষ্টায় হবে না, দুপক্ষের যত্নশীল হতে হবে। ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে সম্পর্কগুলোকে।