বাংলাদেশ সোসাইটি নিয়ে কিছু কথা

নিউইয়র্কের আকাশভরা সোনালি রোদ বাংলাদেশ সোসাইটির আঙিনা কতটুকু ছেয়েছে! আকাশের কালো মেঘে যদি রংধনুর সাত রং মুগ্ধতা ছড়াতে পারে, বাংলাদেশ সোসাইটির মানুষের হৃদয়ে কেন স্থান করে নিতে পারে না। নিউইয়র্কে চার দশক আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সোসাইটি ইন্‌ক মানুষের আস্থা, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ঠিকানা হয়ে উঠতে আর কত সময় লাগবে!
সোসাইটি সাংগঠনিকভাবে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ওপর দিয়ে কতটা পথ অগ্রসর হয়েছে! সোসাইটি প্রবাসীদের কল্যাণে কী কী কাজ করে তা অনেকেই জানেন না। বর্তমান সময়ে নিউইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটিতে বাংলাদেশ সোসাইটি ও সোসাইটির নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই সব বিষয় সবখানে আলোচিত হচ্ছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাঙালি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক প্রবাসীদের মধ্যে সামাজিক সাংস্কৃতিক বন্ধন ও ইতিহাস ঐতিহ্যের লালন-পালনের উদ্দেশ্য নিয়েই বাংলাদেশ সোসাইটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। প্রবাসীদের মৌলিক মানবিক চাহিদা, প্রত্যাশা, সংকট, দুর্যোগ ও সমস্যা কতটুকু মোকাবিলা করতে পেরেছে বাংলাদেশ সোসাইটি? সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অঙ্গীকারের ওপর এখনো দাঁড়িয়ে আছে? নাকি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়েছে। চার দশকের দৃশ্যমান প্রাপ্তি ও সংগঠনের গভীরতা এবং মানুষের মধ্যে কতটুকু বিস্তৃতি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনেকেই জানতে চান, মানুষের মানবিক মৌলিক সমস্যা সংকটে ও চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ সোসাইটির সফলতা ব্যর্থতার পরিমাণ কত? যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় চার দশক সময়ে সোসাইটি কতটা প্রভাব ফেলেছে? নাকি নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, সন্দেহ ও বিশ্বাসের সংকটে পড়ে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন পথ চলছে! যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, চার দশকের পাড়ি দেওয়া পথে, সোনালি রোদে কতটুকু ছেয়েছে সোসাইটির আঙিনা।
বাংলাদেশ সোসাইটি গত চার দশকে প্রবাসীদের জাতীয় সংগঠন হিসেবে কেন গড়ে উঠতে পারেনি। এর ব্যর্থতার দায়ভার কাদের। যারা দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁদের নাকি যারা তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের। বাংলাদেশ সোসাইটির একটি ভবন ও কয়েকটি কবর কিনে গর্ব করার কোনো কারণ নেই। প্রবাসের অনেক আঞ্চলিক সংগঠনও এসব কাজ করতে পেরেছে। বাংলাদেশের সব জাতীয় দিবস পালনে আপত্তি নেই। কিন্তু শুধু দিবস পালন, পিকনিক পার্টি, মিলাদ মাহফিল, ইফতার মাহফিলের আয়োজন সোসাইটির মৌলিক ও গণমুখী কার্যক্রমের আওতায় পড়ে না। সোসাইটিকে নিয়ে যেতে হবে মানুষের কাছাকাছি। এ জন্য প্রয়োজন উদ্যোগ পরিকল্পনার পাশাপাশি মানবিক মনের। যুগের চাহিদা, প্রবাসীদের প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার আলোকে সোসাইটিকে গড়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়। অনেকেই বলেছেন, এক সময় প্রবাসে আঞ্চলিক সংগঠন ছিল না বলে সোসাইটির ছোট ছোট কাজগুলো বড় করে দেখা হয়েছে। এখন সময় বদলে গেছে, প্রবাসে অনেক আঞ্চলিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের নিজ এলাকার মানুষের জন্য ছোট বড় দৃশ্যমান অনেক কাজ করছে। বাংলাদেশ সোসাইটিকে এখন স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে প্রবাসীদের অধিকার আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হতে হবে। একটি স্বতন্ত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠানে রূপদানের পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।
বাংলাদেশ সোসাইটির আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বাঙালি কমিউনিটিতে সোসাইটির কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন এলে টাকা দিয়ে হাজারো সদস্যকে প্যাকেজ ভোটার করা করা হয়। নির্বাচনের পরে নির্বাচিত কমিটি তাঁদের সদস্য ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণে কী কাজ করে তা সদস্যদের জানানো হয় না। টাকা দিয়ে প্যাকেজ ভোটার সদস্য করে সোসাইটি আর্থিকভাবে যতটা লাভবান হচ্ছে তার চেয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি জনসম্পৃক্ততা থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। গত নির্বাচনের আগে অনেকেই সদস্য হয়ে ভোট দিয়েছিলেন পছন্দের প্রার্থীকে। এই ভোটের পরে তাঁদের আর কেউ খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করেননি।
বিগত কয়েক বছর ধরে এমনই চলে আসছে জানিয়ে অনেকে বলেন, সদস্যরা ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বছরে অনেকগুলো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও কোনো অনুষ্ঠানেই সাধারণ সদস্যদের দাওয়াত করা হয়নি। অনেকের অভিযোগ, পদ-পদবি লোভীরা টাকা দিয়ে নিজেদের লোকজনদের স্বল্প মেয়াদি সদস্য ও ভোটার করাতে সোসাইটিকে জনসম্পৃক্ততা থেকে বিরত করে রেখেছেন। সোসাইটির জন্য দাতা সদস্য, আজীবন সদস্য, ট্রাস্টি সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সফলতা ব্যর্থতা নিয়েও আলোচনা সমালোচনা বাদ পড়েনি কোনো কোনো মহলে।
বাংলাদেশ সোসাইটিকে প্রবাসীদের মৌলিক মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে একটি সমীক্ষার প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম ও পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। ব্রিটেনবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ সেন্টার লন্ডন’ এর আদলে এখানেও বাংলাদেশ সোসাইটিকে গড়ে তোলা জরুরি বলে অনেকে মনে করেন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার জায়গা থেকে বাংলাদেশ সোসাইটি প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে মনোযোগী ও উদ্যোগ নিতে হবে। যারা প্রবাসীদের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করেন, প্রবাসীদের মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, সমস্যা ও সম্ভাবনার জায়গাটি যারা চিহ্নিত করেন, তাঁদের মতামতকে বিবেচনায় রেখে কর্মমুখী ও গণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সোসাইটির নেতারা উদ্যোগের বাস্তবায়ন করতে না পারলে সামনের পরিণতির কথা একবার চিন্তা করতে পারেন। একটা কথা প্রায়ই শুনি। বাংলাদেশ সোসাইটি নাকি এক সময় কেবল ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা শীর্ষ পেশাজীবীদের নেতৃত্বে ছিল। এখন নাকি বাংলাদেশ সোসাইটি সাধারণ প্রবাসীদের সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর পাল্টা জবাবও অনেকের আছে। সোসাইটি নাকি এখন পুঁজিবাদের আরেক স্বরূপ। ভোটের সময় টাকা দিয়ে ভোটার সদস্য করে মাথা কিনে নেওয়া হয়। মুফতে টাকায় সদস্য হওয়ার বিনিময়ে অনেকেই নিজের বিবেক বিক্রি করে দেন। ভালো মন্দ, যোগ্যতা অভিজ্ঞতা যাচাই-বাছাই না করে সঠিক নেতৃত্বকে সমর্থন করা সমাজের জন্য বুমেরাং হয়।
বর্তমানে চিন্তার বিষয়গুলো সাধারণ মানুষকে জানানোর ক্ষেত্র উন্মুক্ত রয়েছে। তেমনই একটি ক্ষেত্র বাংলাদেশ সোসাইটি ওয়েবসাইট এখনো সংকুচিত রয়েছে। সোসাইটিকে জানার আগ্রহ থেকে বাংলাদেশ সোসাইটি ইন্‌ক নামের ওয়েবসাইটে আপডেট কোনো তথ্য নেই। বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশের মাটিতে প্রবাসীদের ছাতা সংগঠন হিসেবে দাবি করা বাংলাদেশ সোসাইটির ওয়েবসাইটে প্রবাসীদের তথ্য নেই কেন? তথ্য যদি না থাকে তবে কার জন্য এই ওয়েবসাইট খোলা হলো? ওয়েবসাইটে সোসাইটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের একটি বিবরণী আছে। ওখানের ১৯ দফার অনেকগুলো এখন বর্তমান সময়ের জন্য অনুপযোগী। বাংলাদেশ সোসাইটিকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে, মানুষের দৈনন্দিন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ভাষা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। কর্মসংস্থানের জন্য জব সেন্টার স্থাপন করা। প্রবাসীদের সব তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। সার্বক্ষণিক তথ্যসেবা চালু করা। সোসাইটির সব কার্যক্রমে সর্বস্তরের প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজ অনুশীলক, নিউইয়র্ক।