ভালো-মন্দ দুই খবরই আপাদের জানা উচিত

‘যে খবরে আপা খুশি হবেন, সে খবরই আপাকে শোনাব। সত্যটা বলে না।’ বাংলাদেশের একটি চ্যানেলে নাটক দেখছিলাম, ‘কাগজের ফুল’। গ্রামীণ পটভূমির সিরিজ নাটক। পাঁচবারের চেয়ারম্যান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর মেয়ে জবা চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তরুণ ডিম ব্যবসায়ী হাসনাত। জবার সামনেই দুই সমর্থকদের ঝগড়া শুরু হয়।
সুবিধাভোগী এক সমর্থক বলছে, চারদিকে জবার জয়জয়কার। দিনে দিনে বাড়ছে তাঁর জনপ্রিয়তা। ভোটে জবার জয় নিশ্চিত। আরেক সমর্থক এর প্রতিবাদ করে বলছে, আপা, এই চামচার কথা শুনবেন না। ও সব মিথ্যে বলছে। জবা জানতে চাইলেন, তাহলে সত্যটা কি? জবাবে ওই সমর্থক বললেন, আমি আপার বাবার সহকর্মী। তাঁর সঙ্গে নির্বাচন করেছি। যে খবরে আপা খুশী হবেন, এই চামচা সে খবরই শুনিয়ে যাচ্ছে। সে আপার ক্ষতি করছে। জবা আবারও জানতে চাইলেন, সত্যটা কি? সেই সমর্থক এবার বললেন, সত্য হলো হাসনাতের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। জবার প্রশ্ন, কি করে হাসনাত এত জনপ্রিয় হলো?
যাই হোক, নাটকের নির্বাচন এখনো হয়নি। নির্বাচনে কে জিতবে? জবা না হাসনাত? সে খবর নাট্যকারই জানেন।
এবার নাটক থেকে আসি বাস্তবে। আমাদের যে আপারা দেশটা চালান, তাঁরা কি তৃণমূলের খবর জানেন? জনমনে সন্তোষ-অসন্তোষের খবর রাখেন? হয়তো রাখেন। অথবা শুধু সুখের খবর তাঁদের কাছে পৌঁছে, অসন্তোষ চাপা পড়ে যায় মাঝ পথে। ভালো-মন্দ দুই খবরই আপাদের জানা উচিত। এতে লাভ হবে আপাদের, দেশ হবে উপকৃত।
সিলেটে আমার ১০ দিনের সফরে তৃণমূলের চার-পাঁচটি ঘটনার কথা বলব। এসব কারও উপকারে আসতে পারে।
সিলেট শহরে এখন হাজার হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা। আড়াই বছর আগেও এতটা দেখিনি। শুনলাম, মহাসড়কে অটোরিকশা নিষিদ্ধ হওয়ার পর শহরে এসে ঠাঁই নিয়েছে। আমি প্রতিদিন অটোরিকশায় যাতায়াত করতাম। সুযোগ পেলে চালকের সঙ্গে গল্প করতাম। এক চালক জীবনের গল্প শোনালেন। ভাড়া ৫০০, জ্বালানি ৩০০ এবং ‘মামুদের’ জন্য ১০০ বা ২০০ টাকা—এই হলো তাঁর প্রতিদিনের খরচ। এরপর যা পাওয়া যায় তাই রোজগার। ‘মামু’ আবার কে? না বোঝার ভান করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পাশে এসে দাঁড়ানো আরেক চালকের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ও ভাই উনাকে বলুন তো ‘মামু’ কে? সেই চালক রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে চলে গেলেন।
নবীগঞ্জের আউশকান্দির এক অটোরিকশা চালক। সিলেট, ঢাকাসহ নানা জায়গায় তিনি যাত্রী নিয়ে যান। তার জীবন কাহিনি আমি জানতে চাইনি। কুশলাদির পর সেই বলতে থাকল—ট্যাক্সি চালিয়ে আমার দৈনিক আয় পাঁচ শ টাকা। তবে হাইওয়ে প্যাট্রলের সাক্ষাৎ ঘটলে এদিন রোজগার নেমে আসে তিন শ। বললাম, ‘ওদের দিতে হয় দু শ। কেন দিতে হয়? তুমি কোন অন্যায় করেছ?’ বললেন, না দিলেতো পরে ১২ হাজার দিয়ে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। বলবে, তোমার গাড়িতে অবৈধ জিনিস পাওয়া গেছে।’ বললাম, অবৈধ জিনিস? কি সেটা? বললেন, ‘অস্ত্র, ইয়াবা, ফেনসিডিল—যেকোনো একটা। সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানানো কেস। এত সব ঝামেলায় কে যায়। তাই দু শ টাকা দিলেই খালাস।’
একজন মুক্তিযোদ্ধা। সরকারি মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। পেনশনের টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে সব খুইয়েছেন। সরকারের মুক্তিযোদ্ধা ভাতার ওপর এখন নির্ভরশীল। তার স্ত্রী বললেন, অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে, একটি সিএনজি অটোরিকশা কিনে ভাড়া দিয়েছিলেন। ভালোই চলছিল। একদিন শোনা গেল, সিএনজি অটোরিকশাসহ চালককে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। কি অভিযোগ? গাড়িতে অবৈধ অস্ত্র পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলে, সম্পূর্ণ মিথ্যা। কি আর করা। আইন আদালত করে সিএনজি ছাড়িয়ে আনলেন। ততক্ষণে এ বাবদ খরচ হয়ে গেলে ১২ হাজার টাকা।
আইনে মাস্টার্স করছেন এক ছাত্রী। ছোট ভাইকে নিয়ে রিকশায় বাসায় ফিরছেন। টিলাগড় এমসি কলেজের সামনের রাস্তায় দুর্বৃত্তরা তার হাত ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। ব্যাগে স্মার্ট ফোন, আইডি, অর্থকড়িসহ জরুরি কাগজপত্র ছিল। যথারীতি থানায় গিয়ে এজাহার করলেন। তদন্ত কর্মকর্তা বললেন, মামলার তদন্তে খরচাপাতি লাগবে। সেটা দিতে হবে বাদীকে। ছাত্রীর মাথায় হাত। বলেন কি? আমার ফোন, টাকা-পয়সা সব ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আমি ক্ষতিগ্রস্ত, ভিকটিম। রাষ্ট্র আমার পক্ষে এসে দাঁড়াবে। উল্টো আমাকে কেন দিতে হবে অর্থদণ্ড? তিনি কিছুই দেননি। তার মামলাটিও আর এগোয়নি।’
না, আর কোনো ঘটনার কথা বলব না। ভোটের রাজনীতিতে এসব ঘটনার প্রভাব থাক বা না থাক, সুশাসনের জন্য এ সবের প্রতিকার হোক—আপনাদের কাছে এসব খবর গিয়ে পৌঁছাক, এটি শুধু আমার কামনা।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।