মানবতার শেষকৃত্য

বর্তমানে আমেরিকার বিভিন্ন সীমান্তে মানবিক দুর্দশার ভয়াবহ চিত্র ও পাশাপাশি ঘটে চলা অবর্ণনীয় অমানবিক কাহিনি নিয়ে সাবেক বর্ডার এজেন্ট ফ্রান্সিসকো ক্যানতুর লেখা ভয়ংকর জবানবন্দি ‘দ্য লাইন বিকাম্‌স অ্যা রিভার ডিসপ্যাচেস ফ্রম দ্য বর্ডার’ (The Line Becomes a River Dispatches from the Border) বইটি।
অ্যারিজোনা রাজ্যের টুসান শহরের সীমান্তে ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ইমিগ্রেশন এনফোর্সমেন্টে কাজ করছিলেন ফ্রান্সিসকো ক্যানতু। তাঁর ভাষায়, দুর্গম এই সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের না আছে কোনো রাজনৈতিক মূল্য, না সামাজিক। চার বছরে নিজের চোখে দেখা মানবিক মূল্যবোধের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের ‘জিরো টলারেন্সে’ নীতির নামে সব কর্মকাণ্ডই বর্বরতার সভ্য রূপ। এ সবই বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের ভুল সিদ্ধান্তের নির্মম বলি। সীমান্তে কর্মরত সব ধরনের কর্তার কাছে সীমান্ত পেরিয়ে যেকোনো উপায়ে আমেরিকায় আসতে চাওয়া সব অভিবাসীকে দুষ্কৃতকারী, অবৈধ অথবা অন্য আরও নানা বিকৃত নামে ডাকা হয়।
সীমান্ত রক্ষা কর্তৃপক্ষ ১৯৯০ সাল থেকে প্রতিরোধের মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির নীতিতে অভিবাসীদের সীমান্ত পারাপারে ব্যবহৃত সুনির্দিষ্ট কিছু শহরে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। এল পাসোর মতো শহরে নেওয়া হয় দেয়াল তৈরিসহ নানা ধরনের শক্ত পদক্ষেপ। নতুন নতুন বর্ডার এজেন্ট নিয়োগ দেওয়াসহ সীমান্ত শহরগুলোকে একপ্রকার সিল-গালা করার প্রক্রিয়া চলছে। এ সবই চলছে আমেরিকান জনগণের চোখের অন্তরালে।
ক্যানতু বলেন, ২০০৮ ও ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে সীমান্ত পাহারা দেওয়ার সময় একজন মহিলাকে দেখতে পাই। সে আমার কাছে তাঁর একমাত্র সন্তানের খবর জানতে চায়, যে দুর্গম বন-জঙ্গলসহ রুক্ষ ও বিপজ্জনক মরুভূমি পার হয়ে আমেরিকায় আসতে চেয়েছিল। ছেলেটি আগে অনেকবার সাঁতরে নদী পার হলে বর্ডার এজেন্টদের হাতে ধরা পড়ে আবার নিজ দেশে ফেরত যায়। তবে এবার হাঁটা পথে অন্য দিকে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে ছোট একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি বারবার আমাকে দেখাতে থাকে। কিন্তু আমি তাকে বলি, আমি এ ধরনের মুখাবয়বের কাউকে মনে করতে পারছি না। সরকারের শত শত আটক কেন্দ্রে সীমান্ত পার হয়ে আসা লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে হয়তো ওই নারীর হতভাগা সন্তান মিশে আছে নয়তো ক্যালিফোর্নিয়ার হল্টভিল শহরের বাইরে জনমানবহীন এলাকার গোরস্থানের কোনো একটি লাইনে পরিচয়বিহীন হয়ে চিরদিনের জন্য শুয়ে আছে।
কী আশ্চর্য! মানবতার নামে দুনিয়াজুড়ে আমাদের যে প্রচেষ্টা, তা কি আজ উঁচু দেয়ালের এক প্রান্তে অপেক্ষারত মা আর অন্য প্রান্তে নিখোঁজ সন্তানের আহাজারিতে আটকে যাবে? ফ্রান্সিসকো ক্যানতুর জিজ্ঞাসা ছিল এরকম।
অথচ আশ্চর্যের বিষয়, ট্রাম্প সরকার যাকে ‘মানবিক সেবা’ বলছে তা আজ কম বয়সী সন্তানসহ বিপদসংকুল দুর্গম পথে যাত্রা করতে অভিবাসীদের বাধ্য করছে। প্রকৃত কী ঘটনা চলছে আমেরিকার সীমান্ত ঘেঁষা শহর ও জনপদে, অধিকাংশ আমেরিকাবাসীর তা এখনো সম্পূর্ণ অজানা।
অভিবাসন সেবা কর্তৃপক্ষের কমিশনার হিসাবে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কর্মরত ডরিস মেইসনার বলেন, সঠিক ভৌগোলিক ধারণা থাকা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে শত শত অবৈধ অভিবাসী ক্ষেত্র বিশেষে ভয়াবহ ঝুঁকি নিতে দ্বিধা বোধ করে না, সেখানে বর্ডার এজেন্টদের কঠোর থেকে কঠোরতর হতে কখনো কখনো বাধ্য করে ফেলে। দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার সময় নিরপরাধ অভিবাসীদের এ ধরনের করুণ মৃত্যু আমেরিকার ভুল নীতিরই প্রতিফলন।
সিএনএনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ১৬ বছরে প্রায় ৫০০ সীমান্ত রক্ষীসহ ৬ হাজার অবৈধ অভিবাসীর করুণ মৃত্যু দৃশ্যত যে বার্তা দেয়, তাকে এক কথায় বলতে গেলে মর্মান্তিক ও অমানবিক বলতে হবে।
নীতি নির্ধারকেরা অনেক বিষয়ের সঙ্গে একটি বিষয়কে ক্রমশ এড়িয়ে চলছেন। সেটি হলো, সীমান্তে বর্ডার এজেন্টদের কড়াকড়ি আরোপের ফলে মানবপাচারের ক্ষেত্রে সব ধরনের খরচ বেড়ে যাওয়া। সে জন্যই হয়তো অভিবাসীরা আরও বেশি বিপদসংকুল পথে পা বাড়ায়। এভাবে অধিকাংশই কোনো একসময় চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। সীমান্ত পাহারার মতো দুরূহ কাজে থাকাকালে দেখা অনেক নির্মম ও অমানবিক অভিজ্ঞতা শুধু নিজের মধ্যে রেখে দেওয়া যে কি কঠিন কাজ, তা অনেকেই হয়তো জানবেন না। অ্যারিজোনা রাজ্যের পাথুরে পাহাড়িয়া সীমান্তে অসমতল পথ ধরে জিপগাড়িসহ রাতের টহলে সদা সতর্ক থাকা ছিল প্রথম শর্ত। প্রশিক্ষিত অ্যারাবিয়ান ঘোড়ায় করে টহলকালে প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট বিপদের চ্যালেঞ্জ নেওয়া ছিল নিত্য দিনের রুটিন কাজ।
শেষ করব নিজ চোখে দেখা অবিশ্বাস্য একটি চিত্রের অগোছালো বক্তব্যের মাধ্যমে। ২০১০ সালে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি একটি দিন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়। টুসান শহর থেকে শত মাইল দূরে দুর্গম গিরিপথের ওপর দিয়ে আসা টহল হেলিকপ্টার কিছু মানুষের অবস্থান নির্ধারণ করে তোলা ছবি পাঠাল স্থান চিহ্নিত করে। কমান্ড অফিসে জরুরি মিটিংয়ে বসে উদ্ধারকারী দল গঠিত হলো। টহল হেলিকপ্টারের পাঠানো ছবিসহ আরও স্ট্র্যাটেজিক তথ্য উপাত্তকে বারবার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে অভিযানের শুরু। যাত্রা শুরু দ্রুতগামী হাম্বি ট্রাক জিপে চড়ে। মাঝপথে কিছু দূর হেঁটে চলে পাহাড় ডিঙিয়ে চপারে আরোহণ।
তিনটি চপারে আটজন করে মোট ২৪ জন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুধু চপারের গোঁ গোঁ আওয়াজ। কমান্ডারের ফিস ফিস করে পাইলটের সঙ্গে কথা বলার রহস্যময় শব্দ। আমাদের সবার দৃষ্টি সামনের দিকে যেখানে সরাসরি চোখে পড়ে রৌদ্রোজ্জ্বল চক চকে নীল আকাশ। আনুমানিক ৩০ মিনিট ওড়ার পর সংকেত দেওয়া হলো চপার ধীরে ধীরে নিচে নামছে। সঙ্গের চপারকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। এই প্রথমবারের মতো অসমতল ভূমি চোখ পড়ল। নানা আকারের নানা ভঙ্গিমায় ছড়ানো-ছিটানো বিরাট আকারের ক্যাকটাস। কোনটি গাঢ় সবুজ, কোনটি আবার অস্বাভাবিক তাপমাত্রায় পুড়ে যাওয়া গাঢ় বাদামি রং নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে।
চপার ডানে বামে কসরতের কায়দায় ধীরে ধীরে অপেক্ষাকৃত সমতল এবং সামান্য পরিমাণের খোলা জায়গায় নামল। চপারের ব্লেড পুরো থামার আগেই নেমে গেল কমান্ডার। পরে একে একে নামলাম আমরা বর্ডার এজেন্ট বলে কথিত প্রহরীরা। চপারের দরজায় দাঁড়িয়ে মুখ বাড়াতেই তীব্র আগুনের হলকার অনুভব। ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা। মনে হচ্ছে খোলা মুখ পুড়ে যাচ্ছে। প্রথমে পুড়ে প্রায় মরে যাওয়া উঁচু ক্যাকটাসের ছায়ায় যেতে চাইলেও ওদের গায়ের লম্বা কাটার জন্য বেশি কাছে যাওয়া গেল না। কমান্ডারসহ সবাই ডান পাশের ঢালুর মতো জায়াগাটিতে যেতে চাইছে।
তথ্য অনুযায়ী মার্ক স্পটার মেশিন ওখানে বারবার যেতে বলছে। পরের কাহিনি নিয়ে আর বেশি এগোনো যাবে না। নিয়োগকালে অনেক ফরমে স্বাক্ষর দিতে গিয়ে হালকা নীল রঙের যে ফরমে স্বাক্ষর দিয়েছিলাম, তাতে অনেক শর্তের একটি শর্ত ছিল কমান্ডার যদি কোনো বিষয়কে শুধু উচ্চ পর্যায়ের জন্য ঘোষণা করেন তা হলে সে বিষয় নিয়ে কিছুই বলা যাবে না।
দেখা গেল, নানা বর্ণের, নানা আকারের, নানা বয়সের নারী-পুরুষ উন্মুক্ত আকাশের নিচে তীব্র গরম ও অসহনীয় পরিবেশের সঙ্গে রাতদিন যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে লাশের সারি। একজনের গলিত লাশের ওপর ছিল লাল সবুজের ডোরাকাটা স্কারফের মতো মাঝারি আকারের লম্বা কাপড়খণ্ড। তারই পাশে ভিন্ন ভাষায় লেখা একটি ডায়েরি আকারের বই। প্রচ্ছদে অস্পষ্টভাবে ছাপা একটি চৌকোণা ঘরের ছবি। কমান্ডারের তোলা ছবি দেখে আমাদের এক এশীয় এজেন্ট বললেন, হতভাগা হয়তো কোনো মানব পাচারকারী দলের প্রলোভনের শিকার যার নিবাস এশিয়ার কোনো দেশে আর মুসলিম ধর্মের অনুসারী। ডায়েরি আকারের বইটির প্রচ্ছদের ছবিটি ছিল মক্কার পবিত্র কাবা ঘর।