সংসারের 'ব্যবস্থাপক'

পরিচয়ের প্রাথমিক অবস্থায় একটা ছেলে একটা মেয়ে, রেস্তোরাঁয় বসে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কথা বলছে। মেয়েটা একটা নাম করা কোম্পানির ব্যবস্থাপক, তার স্বপ্ন একদিন কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হবে, পরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হবে। সংসার তাকে তেমন একটা টানে না। সে এসবে যেতেও চায় না। সে এটাই ভাবে, বিয়ে মানেই আরেকজনের খাম্বা বা সাপোর্ট সিস্টেম হওয়া। ছেলেটার পেশাগত কোনো টার্গেট বা লক্ষ্য নেই। বাবা অর্ধেক দিল্লির মালিক। বাবার ব্যবসায়ও যোগ দেবে না। সে ভালো রেজাল্ট নিয়ে এমবিএ করেছে। তারপর সিদ্ধান্তে নিয়েছে, বাবার ব্যবসা সে দেখবে না, বাবার পয়সায় বিলাসিতাও করবে না। তার কোনো উচ্চাশাও নেই। সে বলল, মায়ের মতো সে ঘরের কাজ করতে চায়। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল যে, ‘ও, ঘর ম্যা বেঠে বেঠে খাওগি?’ ‘মা ঘরমে বেটতি নেহী হে’—ছেলেটা চিৎকার দিয়ে ওঠে। তাঁর কথার অর্থ হলো, মা ঘরে বসে থাকতো না।’ এটা হচ্ছে হিন্দি সিনেমা ‘কী এন্ড কা’-এর নায়ক অর্জুন কাপুরের ডায়লগ। একজন মাকে নিয়ে এমন ভাবনা, হয়তো আমরা কেউই ভাবি না।
তারপর সে উত্তেজিত সুরে যা বলতে থাকে তার সারমর্ম হচ্ছে, ‘মাকে প্রতিদিন চিন্তা করতে হয় অন্যকে কীভাবে খুশি রাখা যায়? সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই তাকে আগে অন্যের খাবার তৈরি করে দিতে হয়, আবার দুপুরে কী হবে সেটা ভাবতে হয়? রাতের খাবারের চিন্তা করতে হয়। ঘরের সব কিছু পরিপাটি রাখাসহ সব কিছুতে লক্ষ রাখতে হয়। একই খাবার প্রতিদিন দেওয়া যায় না, যার জন্য তাকে প্রতিদিন প্রতি বেলার খাবারের তালিকা নতুন নতুন ভিন্নতার কথা ভাবতে হয়। প্রতি মুহূর্তে খুঁজতে হয়, ঘরের মানুষ কিসে খুশি হবে? অন্যের খুশি খুঁজতে খুঁজতে একদিন তার জীবনই শেষ হয়ে যায়।
জীবনের দৈনন্দিন উদ্ভাবনী ভাবনায় মায়ের বেতন বাড়ে না, কিন্তু তার ভাবনায় একটু উনিশ-বিশ হলেই সবকিছু কেঁপে ওঠে। শুনতে হয়, ‘সারা দিন ঘরে বসে বসে কী কর?’ তার বাবা মাকে এভাবেই বলতেন, যিনি সারা দিন বাইরে কাজ করে ঘরে আসেন। খাবার সময় মতো না পেলে তাঁর সাপোর্ট সিস্টেম ভেঙে পড়ে। এই সাপোর্ট না থাকলে, তার কাজ কত কঠিন এটা কেউ ভাবেন না, সাফল্যের কাঠি নিচে নেমে যেতে বাধ্য।’ সত্যি কথা হচ্ছে, একজন মা বা গৃহিণী কতটা বোঝা বহন করেন তা নিয়ে কেউ ভাবার প্রয়োজন বোধ করে না। কারণ যুগ যুগ ধরে তাকে এক জন্মগত দায়িত্বের ফ্রেমে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেটাকে মমতা দিয়ে উপলব্ধি, কোনো মহান সন্তান, স্বামী কেউই করেন না।
যাই হোক, আমি সিনেমা নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না, যদিও এর বিষয়টা খুব সুন্দর। লেখার মূল কারণ, ওই একটা সংলাপ মনুষ্যত্ব নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! সময় পাল্টেছে। আজকাল অনেক ছেলে সংসারের টুকটাক কাজ সামলে নেন। কিন্তু তার সংখ্যা এখনো নগণ্য। যেখানে শতকরা মাত্র আটজন দম্পতি সুখী সেখানে এমন সুখী রমণীর হিসাব আপনা-আপনি বের হয়ে আসে। এখনো সিংহভাগ নারী সংসারের কাজ সামলানোর জন্যই জন্ম নেন এবং তা করছেন। স্বামী যদি বেকার হন তবুও আশা করেন, স্ত্রী বাইরের কাজ সেরে এসে রান্না করে দেবেন, তবেই খাবেন। সেই কাজে চুন থেকে পান খসলে তাদের শুনতে হয় অনেক কথা। মনে কষ্ট নিয়েও টেবিল সাজিয়ে খাবার পরিবেশন করেন। খাবারে সামান্য অসাবধানতা বসত চুল পড়ে যাওয়ার অপরাধে তালাকের মতো ঘটনাও ঘটেছে অতীতে। ভাত পোড়া গন্ধে খাবারের প্লেট ছুড়ে মারেন—এমন পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। লবণ বা ঝালের পরিমাণে কমবেশের অপরাধ সবারই কখনো না কখনো হয়। সেটাকে মমতা দিয়ে দেখেছেন, এমন প্রেমিক পুরুষের সংখ্যা ফিল্টার করলে মিলবে কিনা সন্দেহ। নির্ধারিত বাজার কেন শেষ হয়ে গেল, মাস শেষ হওয়ার আগে? এই প্রশ্নের সম্মুখীন হোন না, এমন রমণীর সংখ্যাও কম। একজন গৃহিণীর জন্য এগুলো কম নির্যাতন নয়।
সিনেমার ভাষ্য অনুযায়ী, এ সব অত্যাচারেই তার মা তাড়াতাড়ি মারা গেছেন। যদিও এ বিষয়ে বাস্তব হিসাবটা সমাজ কল্যাণের শিক্ষানবিশ বা বিশেষজ্ঞরা জানার কথা। তবে মানুষের জিহ্বা যে তরবারির চেয়ে ধারালো, তা সবাই জানেন। অনেক সময় শারীরিক নির্যাতনে মানুষ মারা না গেলেও অন্যের কথার আঘাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধের মতো ঘটনাও ঘটে।
তারপর বর্তমান সময়ে আরেকটা যোগ হয়েছে। সবারই দৃষ্টিতে একটা তাচ্ছিল্য, ‘আরে সারা দিন ঘরে বসে সিরিয়াল দেখে, চারটা রান্না করে এই তো কাজ! এ আর এমন কি?’ প্রত্যেকেরই জীবনে ভিন্নতর এবং কিছু বিনোদনের প্রয়োজন আছে। আমরা যা শেখার ছোটবেলায় পরিবার থেকে শিখি। যে সব ছেলেমেয়ে ছোটবেলা তর্ক পরিবার থেকে শেখে, তারা বড় হয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সেভাবেই ক্রিয়া করে। এখানে একজন মানুষের সামান্য বিনোদনের কোনো ভূমিকা নেই। কারণ বিনোদনের অনুসর্গ হিসেবে মানুষ অনেক কিছু দেখে, তা কি আর জীবনে নিয়ে আসে? তাই এমনতর ভুলের মাপকাঠিতে গৃহিণীদের মাপা ঠিক নয়।
আমি যেখানে আমার একমাত্র মেয়ের খাবার নিয়ে বিচলিত এবং বিভিন্ন সময় ভাবতে হয়, তাকে কী দেব আজ! সে তো একটা খাবার দুবেলা খেতেই চায় না। সেখানে একটা পরিপূর্ণ বড় পরিবারে একজন মা বা স্ত্রীকে অনেকের পছন্দের ওপর নজর রাখতে হয়। স্বামী যা খেতে পছন্দ করেন, তা হয়তো বাচ্চারা খায় না, আবার বাচ্চাদের জন্য যা করলেন, তা হয় তো নিজেদের উপযুক্ত নয়। এ রকম অনেক কিছু বাড়তি তাকে ভাবতে হয়। বৈচিত্র্য তাকে আনতে হয়। একটা অফিসে একজন মানুষ একটি টেবিলে বসে তার জন্য নির্ধারিত একটা পদের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। একজন ব্যবস্থাপকের নিচে অনেকেই কাজ করেন কিন্তু একটা সংসারের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা এবং কর্মীর দায়িত্ব একজন রমণী একাই করেন। একজন শিক্ষিত অধীনস্থকে চালানো আর মুর্খ অশিক্ষিত বুয়াদের চালানোর মাঝেও বিস্তর তফাৎ। এদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই হয়তো একজন মানুষ একটা পর্যায়ে মানসিক রোগী হয়ে যায়। কথায় আছে, ‘বাদশাহর রাগ বিবির ওপর, বিবির রাগ বাঁদির ওপর, বাঁদির রাগ বিলাইয়ের ওপর।’ এমনটাই ঘটে এবং তা থেকে নানা অঘটনের জন্ম।
তাই সব দিক বিবেচনা করলে একজন গৃহিণী বা মায়ের ভূমিকা অনেক বড়। গভীরভাবে যদি অনুভব করতে পারেন, তবে বুঝবেন তারা কতটা মহান দায়িত্ব পালন করেন। তার শূন্যতা তৈরি হওয়ার আগেই তাঁকে উপলব্ধি করুন। তাঁদের সামান্য কাজের জন্য জীবনে তাঁরা রসাস্বাদন বা appreciation জিনিসটারই পরিবর্তে পান তাচ্ছিল্য, অত্যাচার। ভুলত্রুটি সবার হয়, আমারও হয়। প্রায় সময় আমি চা বসিয়ে ভুলে যাই, পাতিল পুড়ে ছাই। আমাকে বকা দেওয়ার কেউ নাই, কিন্তু আমি লজ্জিত হই বিবেকের কাছে। সবারই হয় এমন ভুল। তার জন্য ভৎর্সনা না করে বললে হয়, ‘সমস্যা না, এটা সবারই হতে পারে’। আপনার এই ছোট্ট কথা একজন মানুষের আত্মগ্লানি দূর করে দেবে নিশ্চিত।