ল্যাবের ভয়ংকর স্মৃতি

সকালের নাশতা করার সময় খাবার টেবিলের দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিজেই মনে মনে হাসছিলাম। মেয়ে বলল, ‘আব্বা খেতে এসে তুমি অমন অন্যমনস্ক হয়ে আছ কেন, আর নিজের মনে যে হাসছ? কি হলো?’ সংবিৎ ফিরে আসতে বললাম, ‘কিছু না রে মা, এমনি’। সে নাছোড় বান্দা। ‘না বলো, বলতেই হবে’। বললাম, ‘ওই আর কী। আমার কলেজজীবনের একটা ঘটনা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে’। সে বলল, ‘এক্ষুনি বলে ফেল, আমি শুনতে চাই’। বলি ‘আচ্ছা তাহলে শোন’।
‘আমরা যখন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম বর্ষে পড়ি, তখন আমাদের সপ্তাহে একদিন মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপের ক্লাস করতে হতো। এই হ্যামারিং, গ্রাইন্ডিং, ওয়েল্ডিং, মোল্ডিং—এসব আবোল-তাবোল আর কি। একদিন সাহস করে আমাদের ডেমোনেস্ট্রেটর স্যারকে বললাম, ‘স্যার আমরা তো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। ওই সব ওয়েল্ডিং, গ্রাইন্ডিং ফাইন্ডিং শিখে আমরা কি করব’? স্যার বললেন, ‘হুঁ হুঁ, ঠেলা তো জানো না বাছা। তোমরা যখন ফিল্ডে কাজ করবে, তখন যদি কোনো অপারেটর বা মেকানিক এসে বলে ‘স্যার, এটা তো কিছুতেই হচ্ছে না, একটু দেখিয়ে দিন না’। তখন কি তুমি বলবে, আমি তো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার না? যদি শিফটে তোমার ডিউটি পড়ে, সেখানে তো একজনই মাত্র ইঞ্জিনিয়ার, তারা কি জানবে তুমি কোনো বিষয়ের ইঞ্জিনিয়ার? সবাই জানে প্রবলেম হলে সমাধানের জন্য ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যেতে হয়। তখন যদি বিদ্যাটা জানা না থাকে, তাহলে তোমার বিড়ম্বনার শেষ থাকবে? সর্দারি ছেড়ে এখন যাও তো, কাজ করো’। বললাম, ‘স্যার পারছি না বলেই তো আপনার কাছে আসা। একটু দেখিয়ে দিন না, কাইন্ডলি’। উনি বললেন, ‘আমি কেন দেখাতে যাব, যাও ফোরম্যানকে ডাকো’। বললাম, ‘বলরাম দাকে পাচ্ছি না বলেই না আপনাকে বিরক্ত করছি। উনি কোথায়’? তখন স্যার ভীষণ খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘হোয়াট ডু ইউ থিংক অফ মি? অ্যাম আই এ ম্যান টু কল হিম? দেখ, দেখ, চারদিকে একটু ঘুরে ফিরে দেখ। কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোথাও সে আছে’।
আসলে এটা যে একটা ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটল ফিল্ড ওই বয়সে ব্যাপারটা আমরা জানতাম না। পরবর্তী জীবনে চাকরি পেয়ে প্রথম কাজ করতে গিয়ে সেটা টের পেয়েছি। মিল, কারখানার যেখানেই কাজ হোক না কেন, সেখানে অপারেশন চালানোর জন্য থাকে প্ল্যান্ট অপারেটর, মেনটেনেন্সের জন্য থাকে মেকানিক, পাইপ ফিটার, ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার ইত্যাদি। বয়সে তরুণ হলেও চাকরি পাওয়ার প্রথম দিন থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয় সেই প্ল্যান্ট বা সেকশনের বস। সবাইকে তার কাছে আসতে হয়, সালাম দিতে হয়, জবাবদিহি করতে হয়। এটাই রুটিন এবং সব্বাই এটা জানে। কিন্তু এটা মেনে নিতে পারে না একমাত্র ফোরম্যানরা। তাদের না-উচ্চারণ করা কথাটা হলো, ‘ব্যাটা তুই কালকের পুঁচকে। তুই এই প্ল্যান্টের কী জানিস? তুই তো কেবল একটা বই পড়া ছোকরা। বইতে এ সবের দু-একটা ছবি-টবি হয়তো দেখে থাকবি। আর আমি এখানে আজ ২০-২২ বছর ধরে আছি। এখানকার প্রতিটি স্ক্রু, নাট, বল্টু, সব আমি জানি। যেকোনো মেশিন পুরো খুলে ফেলে আবার রি-অ্যাসেম্বল করতে পারি। তো ব্যাটা এখন দেখ, কত ধানে কত চাল’। এই প্ল্যান করে, নতুন ইঞ্জিনিয়ার বসকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ইচ্ছে করে তারা গা ঢাকা দেয়। আমাদের স্যারের মনে হয় তাই হয়েছিল। উনি সে বছর মাত্র চাকরিতে ঢুকেছেন। তার ওপর ওনাকে বস হিসেবে একটুও মানাচ্ছিল না। বেঁটে, রোগা, খ্যাংরা কাঠি মার্কা চেহারা। দুটো হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ওয়ার্কশপের এপার-ওপার পায়চারি করে বেড়াতেন। আর সুপারি খেতেন। দুই পকেট ভর্তি থাকত সুপারি। ওয়ার্কশপের ব্যাপার-স্যাপার তেমন না জানলে কি হবে? বসগিরিটা ছাড়বেন কেন? তিনি ডাকবেন ফোরম্যানকে? সে জন্য বাংলায় কথা বলতে বলতে রেগে হঠাৎ ইংরেজি, ‘হোয়াট ডু ইউ থিংক অফ মি? অ্যাম আই এ ম্যান টু কল হিম?” বলে ফেটে পড়ে তারপর স্বাভাবিক হয়ে বললেন, ‘দেখো, দেখো.........”।
যাই হোক, মজার এই ঘটনার দু/চারটা কষ্টের দিকও আছে।

১.
সে সময় চোখ বাঁচানোর জন্য ছাত্রদের কোনো প্রোটেকটিভ সেফটি গ্লাস দেওয়া হতো না। তাই গ্রাইন্ডিং করতে করতে এক সময় একটা লোহার টুকরো ধাঁ করে এসে পড়ল আমার চোখে। তখন আর ক্লাস কি? এই বয়সে আমার একটা চোখ চলে যাবে? কী করে চোখটা বাঁচানো যায়, তাই নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছি। স্যার বললেন, ‘বাড়ি যাও। মনে হয় হাসপাতালে যেতে হবে’। এক চোখ ঢেকে আধ কানা আমি কলেজ থেকে কোনরকমে বেরিয়ে দুপুরের ফাঁকা হোস্টেলে ফিরে এলাম। আমাদের হোস্টেলে কয়েকজন বন্ধু ছিল যারা তখন ডাক্তারি পড়ত। সন্ধ্যায় ফিরে এসে এক বন্ধু আমাকে তার আর জি কর মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেল, যেখানে একদা আমারই পড়ার কথা ছিল। আমাকে নিয়ে ওর বন্ধুরা মিলে অনেক ফাজলামি টিটকারি করল। একজন বলল, ‘ব্যাটার চোখে চিমটি ঢুকিয়ে কানা করে দাও। ভালো মেয়ে ভাগানোর কঠিন প্রতিযোগিতা থেকে অন্তত একজন কমবে’। পাশের জনকে বলল, ‘সাঁড়াশি নিয়ে দে ব্যাটার চোখটা ঘুলিয়ে’। ভয় পেয়ে আমি প্রাণপণে চোখটা বন্ধ করে রাখলাম। কিছুতেই খুলছি না দেখে দুটো নার্স চলে আসল। একজন চোখের ওপর দিক ও অন্যজন নিচের দিকটা টেনে ধরে চোখটা খুলে রাখল। তারপর দেখি ডাক্তার ভারি কি একটা চোখের ওপর আনল। আর কিছু জানতে পারলাম না। একটু পরেই কে একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘দেখো, এখনো কিছু চোখের মধ্যে পড়ে থেকে খচখচ করছে কি না’? চোখটা ডাইনে বাঁয়ে, ওপর নিচ ঘুরিয়ে অনেকবার ঝাপটা মেরেও কিছুই ঢুকে আছে বলে বোধ হলো না। ডাক্তারি পড়া বন্ধুকে বললাম, ‘অত বড় একটা জিনিস চোখের ওপর আনল, অথচ কোনো ভার বা যন্ত্রণা কিছুই তো টের পেলাম না’। সে বলল, ’বুঝবে কী করে? ও তো তোমার শরীরে কিছু টাচই করেনি। শুধু চুম্বকটা চোখের ওপরে এনে লোহার চুর্ণটাকে উঠিয়ে ফেলেছে’।
‘ও তাই? যাক বাবা”। সেই থেকে উপরওয়ালার কৃপায় দুটো চোখই এখনো বহাল আছে। কানার বদলে আমি আজও পদ্মলোচন।

২.
যাই হোক, সেই থেকে বিপদ-আপদ কেমন যেন একান্ত আপনজন হয়ে গেল। একদিন ফিজিক্‌স ল্যাবে কাজ করছি। ওই ল্যাবটা তখন আমাদের কলেজের সবচেয়ে সুন্দর সেই লাইব্রেরি ভবনের দোতলার ওপর ছিল। ওখানে যেতে পেরে খুব এক্সসাইটেড লাগল। লাইব্রেরিতে বহু বার গিয়েছি। কিন্তু ওপরে ওঠার চান্স হয়নি। বিরাট হলজুড়ে ল্যাবরেটরি। বাইরে ঝকঝকে রোদ। তার ওপর সিলিংয়ের সব লাইট জ্বালানো পুরো ফ্লোরটা আলোয় ঝলমল করছিল। সব কটা খোলা জানালা থেকে মৃদু মন্দ দখিনা বাতাস আসছে। আমরা মনের সুখে গান করতে করতে আমাদের এক্সপেরিমেন্টের কাজ শুরু করেছি। একটা অনেক লম্বা গ্রাজুয়েটেড সিলিন্ডারের মধ্যে অ্যাসিড ঢালতে গেলাম স্টুলের ওপর দাঁড়িয়ে, জানলার দিকে মুখ করে। আর কী বলব? আমার হাতের পাত্র থেকে যে পাত্রে উঁচু করে অ্যাসিড ঢালছি, দুটো পাত্রের মাঝখানের সেই ফাঁকা জায়গার কিছু অ্যাসিডের ধোঁয়া (অ্যাসিড মিস্ট) ওই জানালার হাওয়ার উড়ে এসে আমার চোখের মধ্যে ঢুকে ছ্যাঁক। বাপরে, মা-রে করতে থাকলে ল্যাবের টিচার (ডেমোনেস্ট্রেটর ) এসে অবস্থা দেখে বললেন, ‘ট্যাপের জলে চোখ ধুতে থাক, ধুতে থাক, পনেরো মিনিট, না না আধ ঘণ্টা ধরে’। যখন ধোয়া শেষ হলো, দেখলাম, চোখটা শুধু টকটকে লাল হয়ে যায়নি, রীতিমতো বেশ ফুলে গাব্দা হয়ে গেছে।

৩.
সবচেয়ে দুঃখ ও একাধারে লজ্জাকর ঘটনা ঘটেছিল আর একদিন। আমাদের কেমিস্ট্রি ল্যাবে একদিন কাজ করছিলাম। আমার দুপাশে কাজ করছিল দুই জিনিয়াস। বামপাশে ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় শিবাজি। আর ডানপাশে ছিল এক ‘ছুপা রুস্তম’ আফসার আলী, যে রোজ ক্লাসে লেকচার না শুনে নোটবুকের নিচে লুকিয়ে রাখা আগাথা ক্রিস্টি পড়ত। ল্যাবে এসেও দেখি সে ড্রয়ারটা সেভাবেই আধখোলা রেখে গল্পের বই পড়ছে আর কাজ করছে। এর মধ্যে আগের রাতে দেখা হিন্দি সিনেমার একটা দৃশ্য নিয়ে আমাদের মধ্যে হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল। কথার মধ্যে আমাদের ফার্স্ট বয় টেস্ট টিউবের মধ্যে অ্যাকোয়া রিজিয়া (নাইট্রিক ও সালফিউরিক অ্যাসিডের মিশ্রণ) নিয়ে বুনসেন বার্নারের ওপর ধরে সেটাকে গরম করছিল। গল্পের মধ্যে উত্তেজিত হয়ে হঠাৎ সে ওই ফুটন্ত অ্যাসিডওয়ালা টেস্ট টিউবটা ট্যাপের পানির নিচে ধরে। আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ জোরে ফুটন্ত অ্যাসিড ছিটকে আমার পুরো শরীরে বৃষ্টির মতো এসে পড়ল। ল্যাব ক্লাসে অ্যাসিড বিশেষ করে সালফিউরিক অ্যাসিড হ্যান্ডল সম্পর্কে বারবার সাবধান করে দেওয়া হয়েছে, ডাইলিউট করতে হলে জলে অ্যাসিড খুব আস্তে আস্তে ঢালতে হবে, কারণ এটি জলের সংস্পর্শে আসলে ভীষণ গরম হয়ে যায়। কিন্তু অ্যাসিডে কখনো জল ঢালা চলবে না। করাটা খুবই ডেঞ্জারাস। এক্সপ্লোড করার সম্ভাবনা থাকে। তা সত্ত্বেও ফার্স্ট বয় হয়ে, সে কী করে যে এ ভুলটি করতে পারল, তা ভেবে তখন অবাক হওয়ার আর সময় ছিল না। শরীরসহ জামা প্যান্টের ওপর অ্যাসিডের ছিটে। আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পরনের কাপড়চোপড় পুরো ঝাঁজরা হয়ে যাবে। এ অবস্থায় এখানেই বা থাকব কীভাবে আর বাড়িই বা ফিরব কেমন করে? কিন্তু করার তো কিছু ছিল না। মুখে হাতে যেখানে যেখানে অ্যাসিড লেগেছিল, সেগুলো ভালোভাবে ধুয়ে কোমরের সামনের অংশে লম্বা একটা ফাইল চাপা দিয়ে, কোনোরকম ঝাঁকি না পড়ে, শরীরটাকে প্রায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো স্থির অবস্থায় রেখে, আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করলাম। মাঝে ট্রেন যাত্রাও ছিল। যদি ট্রেনের মধ্যে অত লোকের সামনে প্যান্ট জামা সব খুলে পড়ে যায়...আর ভাবতেও পারছিলাম না। হোস্টেলে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে কাপড়চোপড় ঝেড়ে ফেলে অনেকক্ষণ ধরে সাবান দিয়ে গোসল করে, শরীর থেকে পুরো অ্যাসিড সাফ হয়ে গেছে নিশ্চিত হয়ে তবে শান্তি। ট্রেনে বিপদটা হয়নি। আর রাস্তার ফুটপাতে দিয়ে তো কেবল পুরুষেরা হাঁটছিল না। তাহলে আর সবাই হয়তো মজা পেয়ে মুচকি হাসত। কিন্তু ভাবুন তো, আমার বেইজ্জতির কি আর কোনো সীমা থাকত?
(শিকাগো)