ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ বৈঠক: 'লজ্জাজনক, অপমানজনক, রাষ্ট্রদ্রোহের সঙ্গে তুলনীয়'

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

তোপের মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হেলসিঙ্কিতে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ শেষে সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ বাতিল করে তিনি জানিয়েছেন, পুতিন তাঁকে জানিয়েছেন, রাশিয়া মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেনি। নিজের গোয়েন্দা দপ্তর ও পুতিনের মধ্যে তিনি কাকে অধিক বিশ্বাস করেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প জানান, রুশ প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত জোরালো ভাষায় কোনো রকম হস্তক্ষেপের কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁর এ কথায় বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। তিনি বুঝতে পারেন না, রাশিয়া কেন ডেমোক্রেটিক পার্টির কম্পিউটার ব্যবস্থা থেকে তথ্য চুরি করতে যাবে। 

তাঁর এই বক্তব্য মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরগুলোর সিদ্ধান্তের ঠিক বিপরীত। সিআইএও মার্কিন বিচার বিভাগসহ মার্কিন সরকারের বিভিন্ন শাখা গত নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের ব্যাপারে নিশ্চিত বলে জানিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের আগে জাতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান ড্যান কোটস ট্রাম্পের সঙ্গে এক মুখোমুখি সাক্ষাতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ প্রদান করেন। প্রায় একই সময় রুশ হস্তক্ষেপ প্রশ্নে তদন্তরত বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলার তথ্য-প্রমাণসহ মোট ১২ জন রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র উত্থাপন করেছেন। তা সত্ত্বেও সেসব তথ্য-প্রমাণ উপেক্ষা করে ট্রাম্প পুতিনের বক্তব্যকেই অধিক বিশ্বাসযোগ্য বলে রায় দিলেন।

বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই, তাঁর নিজের রিপাবলিকান পার্টির নেতারাও ট্রাম্পের এই বক্তব্য তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। আমেরিকার ইতিহাসে এর আগে অন্য কোনো প্রেসিডেন্ট নিজ সরকারের বদলে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে অধিক বিশ্বাস করেন, এমন কথা বলেননি। সিআইএর সাবেক প্রধান জন ব্রেনন ট্রাম্পের এই বক্তব্যকে বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর অভিশংসনের দাবি তুলেছেন। ব্রেনন বলেন, হেলসিঙ্কিতে পুতিনের ব্যবহারের প্রতিবাদ করার বদলে ট্রাম্প পুরোপুরি তাঁর পকেটে সেঁধে ছিলেন। তিনি এই ব্যবহারকে রাষ্ট্রদ্রোহের সঙ্গে তুলনীয় বলে উল্লেখ করেন।

বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা সিনেটর জন ম্যাককেইন রোগশয্যা থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের বক্তব্যকে কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্টের জন্য ইতিহাসে সবচেয়ে ‘জঘন্য’ বলে মন্তব্য করেন। এর আগে আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট একজন একনায়কের সামনে এমন নতজানু ব্যবহার করেনি।

এমনকি ট্রাম্পের প্রতি নমনীয় বলে পরিচিত স্পিকার পল রায়ান ও সাবেক স্পিকার ন্যুট গ্রিনগ্রিচও ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। খ্যাতনামা ভাষ্যকার টমাস ফ্রিডম্যান সন্দেহ প্রকাশ করেন, ট্রাম্প সম্ভবত একজন ‘রুশ স্পাই’, এ ছাড়া তাঁর ব্যবহারের অন্য কোনো ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।

নিজের গোয়েন্দা দপ্তরের সিদ্ধান্তের বিপরীতে ট্রাম্পের অবস্থান এতটা উদ্বেগজনক ছিল যে জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ড্যান কোটস সংবাদ সম্মেলনের অব্যবহিত পরে হোয়াইট হাউসের সম্মতি ছাড়াই এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরগুলো এই বিষয়ে একমত যে রাশিয়া ২০১৬ সালের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে। রাশিয়া এখনো সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই সংবাদ সম্মেলনের আগে ট্রাম্প ও পুতিন প্রথমে প্রায় সোয়া ঘণ্টা স্থায়ী এক মুখোমুখি বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের সময় যাঁর যাঁর নিজের দোভাষী ছাড়া অন্য কোনো সহকারী উপস্থিত ছিলেন না। এই বৈঠকে তাঁরা দুজন কী বিষয়ে কথা বলেন, তার কোনো লিখিত রেকর্ড নেই, যা কূটনৈতিক নিয়মবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। পরে ট্রাম্প ও পুতিন তাঁদের সহকারীদের অংশগ্রহণে আরেক দফা বৈঠকে মিলিত হন।

হোয়াইট হাউস সূত্রে বলা হয়েছে, পুতিনের সঙ্গে আলোচনার সময় যাতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা হয়, সে জন্য ট্রাম্পকে প্রায় ১০০ পাতার একটি ব্রিফিং বুক প্রদান করা হয়। এতে ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ ও সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পক্ষে তাঁর ভূমিকার বিস্তারিত তথ্য ছিল। কিন্তু এসবের কোনো কিছু ট্রাম্প পুতিনকে বলেছেন, তার প্রমাণ নেই।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির জন্য তাঁর পূর্বতন মার্কিন প্রশাসন দায়ী। ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের ব্যবহার নির্বোধের মতো ছিল। আমি ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই আমাদের দুই দেশের মধ্যে সংলাপ শুরু হওয়া উচিত ছিল।’ ট্রাম্প দাবি করেন, পুতিনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ফলে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী।

এক প্রশ্নের জবাবে পুতিন নিজেও মার্কিন নির্বাচনে কোনো রকম হস্তক্ষেপের কথা অস্বীকার করেন। তিনি স্বীকার করেন, গত নির্বাচনে ট্রাম্প বিজয়ী হোক, তা তিনি চেয়েছিলেন, তার কারণ ট্রাম্প আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেছিলেন। ‘হ্যাঁ, নির্বাচনে তিনি জিতুন, আমি তা চেয়েছি,’ পুতিন বলেন।

নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ব্যাপারে যাবতীয় প্রমাণপত্র থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প এই ব্যাপারে টুঁ শব্দটি কেন করলেন না, বিভিন্ন মার্কিন ভাষ্যকার এ বিষয় একটি বড় ধরনের ধাঁধা বলে উল্লেখ করেছেন। জার্মানির ম্যার্কেল বা কানাডার ট্রুডোর প্রতি ট্রাম্প যে রকম কঠোর সমালোচনা করেছেন, পুতিনের ব্যাপারে তেমন সমালোচনার সুযোগ পেয়েও পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। কেউ কেউ সন্দেহ করেছেন, ২০১৩ সালে মস্কোতে রাত্রিবাসের সময় ট্রাম্প রুশ পতিতাদের কাজে লাগান বলে যে অভিযোগ রয়েছে, পুতিনের হাতে সম্ভবত সেই ঘটনার প্রমাণ রয়েছে। আর সে কারণেই ট্রাম্প পুতিনের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে রয়েছেন।

সিনেটে ডেমোক্রেটিক নেতা সিনেটর চাক শুমার পর্যন্ত এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। এক বিবৃতিতে তিনি জানান, ট্রাম্পের ব্যবহারের একমাত্র ব্যাখ্যা হলো এই যে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে তাঁর ব্যাপারে কোনো ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। অন্যথায় মার্কিন স্বার্থ রক্ষা না করে তিনি কেন রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করবেন?