আজও দৃষ্টির অন্তরালে

হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

প্রয়াত লেখক ও কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ লিখে গেছেন দু-হাতে। কাজ করেছেন বাংলা সাহিত্যের সব কটি শাখায়, অবিরাম। গল্প উপন্যাস নাটক গান সিনেমা কিছুই বাদ দেননি। সবকিছুতে তাঁর আন্তরিক ও মরমি ছোঁয়া ছিল। লেখককে সরাসরি দেখা বা জানার সুযোগ আমাদের ছিল না। কারণ তিনি থাকতেন রাজধানী ঢাকায় আর পড়াতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময়ে দুটোই ছিল অনেক উচ্চমার্গের বিষয়। তখন আমার বাস ছিল ছোট্ট একটি মফস্বল শহরে যে শহরকে কিছু পাকা সড়ক ও আর দু চারখানা মোটর গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত একটি উন্নত গ্রামই বলা চলে।
তবে মজার বিষয়, এই শহরে দৈবক্রমে দু চারটি উন্নত মানের আশীর্বাদের বিষয় ছিল যার একটি মরমি কবি হাসন রাজার জন্মস্থান। প্রচুর দামি মানুষ আর দামি গাড়ির শহর ঢাকা থেকে পণ্ডিতজনেরা কালেভদ্রে এই শহরে এসে ভিড় করতেন। তাঁরা কিন্তু নিজের তাগিদে কিংবা নিজ পকেটের পয়সা খরচ করে আসতেন না। সরকারি টাকায় কেনা বিমানের আসনে বসে ডিসি সাহেবের আরামদায়ক জিপে চড়ে ছোট্ট মফস্বল শহরে এসে আমাদের কৃতার্থ করতেন। সেই কালে যেমন তাঁদের পাশে খানিক দাঁড়াতে পেরে নিজেকে লেখার জগতের বাদশাহ শাহজাহান মনে করতাম আজও সেই সমান মাপেই আছি।
তাঁরা আসতেন মরমি কবি ও সাধক বলে খ্যাত হাসন রাজাকে নিয়ে আয়োজিত স্মৃতি উৎসবে। আমরা সাহিত্যকর্মীরা সবকিছু ফেলে রেখে ঢাকা থেকে আসা কবি লেখকদের পদবি প্রাপ্ত দেবদূত জ্ঞানে তাঁদের সেবায় নেমে যেতাম। অতিথিদের অনেকের বিশেষ নজর থাকত সার্কিট হাউসের রুমের এসি কাজ করছে কিনা, মফস্বল শহরের সার্কিট হাউসের বাথরুমে গরম পানি পাওয়া যাবে কিনা, অনুষ্ঠান স্থলে যাওয়া-আসার জিপটি নতুন না পুরোনো এসবের দিকে। কেউ কেউ আবার আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতেন কেন সুনামগঞ্জে এসেছেন। রাজধানীর সকল আরাম আয়েশ ছেড়ে কোথাকার কোন মরমি কবির কথা বলতে আসা মুখ্য নয়। আসল কারণ হলো শুনেছেন সুনামগঞ্জে নাকি সব সময় তাজা ও বড় সাইজের পাবদা মাছ পাওয়া যায়। কোনো সুযোগে ভালো সাইজের পাবদা পাতে পেলে ‘মুখবন্ধ’ লেখা নাকি সহজ হয়। কাউকে আবার দেখেছি অনুষ্ঠানে যাবেন বলে সুট পরে সার্কিট হাউসের নিচতলায় এসে বসে গাড়ির সঙ্গে আয়োজকের অপেক্ষা করছেন সাদা খামের জন্য। বারবার তাগাদা দিচ্ছেন, তাঁকে বলে দেন লেনদেনের ঝামেলা আগেই সেরে ফেলতে।
তারপরও তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার কোনো কমতি হতো না। কেননা তাঁরা তো ঢাকা থেকে আসা সব জাননেওয়ালা সুসাহিত্যিক। উঠতে বসতে তো নানা মূল্যবান উপদেশ বাণী অবিরাম চলছেই চলছে। আর আমরাও সঙ্গে সঙ্গে মফস্বল স্টাইলে এই গুণীদের সব কথায় বুঝে অথবা না বুঝে হাঁ হাঁ করে যাচ্ছি।
তো সেই সব বিখ্যাত জ্ঞানীদের ভিড়ে একজনকে পেয়েছিলাম আলাদা ব্যক্তিত্বের। প্রয়াত হুমায়ূন আহমদ ছিলেন তাঁদেরই একজন। উৎসবে যোগ দিলেন উৎসবের মেজাজ নিয়ে। দল বেঁধে চলতেন। দলে ছিলেন সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, অভিনেতাসহ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোতে বিশেষজ্ঞ টাইপের অর্ধ বেকার কিছু ভক্ত।
লেখক যেখানেই যান পুরো দল তাঁর পিছু পিছু। মধ্য রাতে গেলেন স্থানীয় একজন সাধকের মাজারে। উদ্দেশ্য সাধকের সান্নিধ্যে রাতের নির্জনতা উপভোগ করবেন। তা আর হলো কই? মাজারে গিয়ে আবিষ্কার হলো আগে থেকেই প্রচুর ভক্ত আশেকানরা জায়গা দখল করে বসে আছেন। গানবাজনা চলছে। সঙ্গে ধোঁয়া ফকিরের জিকির আসকার। কারও কোনো দিকে হুঁশ নেই। সবাই ব্যস্ত একটি মাত্র মহান কর্মে। লেখক বললেন, ‘আমরা বোধকরি কাবাব মে হাড্ডি হয়ে গেলাম।’ দ্রুত স্থান ত্যাগ করা সমীচীন হবে বলে আমার মনে হলো। পরে যদি ওরা বিরক্ত হয়ে আমাদের ওপর চড়াও হয় তা হলে বেইজ্জতির সীমা থাকবে না। পরবর্তী গন্তব্য নির্ধারণ হলো শহরের বিখ্যাত আরও একটি আড্ডার স্থান, সুরমার পাড়ে একমাত্র লঞ্চঘাট। বসা হলো মোল্লার দোকানে। মোল্লার দোকানটি আবার বিখ্যাত কড়া লিকারের মালাই চায়ের জন্য। বিশেষ চা পরিবেশিত হলো। আড্ডার একমাত্র বক্তা লেখক হুমায়ূন আহমেদ। স্বভাবতই বাকি সবাই শ্রোতা। আজ এত দিন পর সব বিষয় স্মরণ না করতে পারলেও একটি বিষয় আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। প্রয়াত লেখক কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, লঞ্চঘাট ও খেয়াঘাটের ভূমিকা বাংলা সাহিত্যে বিরাট। এই দুটো স্থানে যেমন রচিত হয়েছে অনেক জনপ্রিয় গান ও কবিতা, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য গল্প আর উপন্যাস। একটু সময় নিয়ে বসলে তুমি দেখতে পাবে নানা চরিত্র কিংবা শুনবে নানা গল্প। ফিরে আসার পথে শুনলাম লেখক বলছেন, মাজারে বেশিক্ষণ থাকলে লঞ্চঘাটে এতক্ষণ বসে কথা বলতে পারতাম না, আমরাও ফকিরদের মতো লম্ফ নৃত্য শুরু করে দিতাম।
আবার শেষ দেখা নিউইয়র্কের উডসাইডে বেষ্ট বাই দোকানে। সঙ্গে লেখক পত্নী অভিনেত্রী শাওন ও তাঁদের পুত্রদ্বয়। স্বল্প সময়ের আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে লেখকের শেষ কথাটি ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এক পর্যায়ে আমি বললাম, স্যার আমি বেশি দিন আমেরিকায় থাকব না। দু একটি দায়িত্ব আছে, সেগুলো সম্পন্ন করতে পারলে অচিরেই দেশে ফিরে যাব! দোকান থেকে বের হওয়ার সময় দরজার মুখে থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেশে যেতে চাও? তা আর পারবে না, প্রতিনিয়ত দেশে না থাকবার অনেক কষ্ট নিয়ে হুট করে একদিন জগতের সফর সংক্ষিপ্ত করে লং আইল্যান্ডের ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালের স্থায়ী আবাসে চলে যাবে। কঠিন কথাটি অনেক সহজে বলে ধীরে ধীরে হেঁটে লেখক সেই যে দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলেন আজও তেমনি লেখক লক্ষ কোটি ভক্ত আর অনুরাগীদের দৃষ্টির অন্তরালে চিরদিনের জন্য বয়ে গেলেন।