বিশ্বাসের বীজ বপন হয় কৈশোরে

মানুষের ভেতর একটি শুদ্ধতম বিশ্বাসের বীজ বপন হতে থাকে কৈশোর থেকে। বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্বাসের রকমফের হতে থাকে সময়ের আবর্তনে বা জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে কিংবা পড়াশোনার মাধ্যমে। তারপরও বিশ্বাসের বীজ, বিশ্বাসের সেই শেকড় কোথাও না-কোথাও একইরকম থেকে যায়।
জীবনজীবিকার জন্য আমরা আমাদের রূপ বদলাই ঠিকই, কিন্তু মনের গূঢ়তম বিশ্বাস কি বদলাতে পারি! পারি না বলেই কখনো-সখনো নিজের অজান্তে সেই বিশ্বাসের ছিটেফোঁটা বের হয়ে যায়। আমরা নিজেকে কখনো শতভাগ বদলাতে পারি না। বদলাতে পারি না মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও!
তাই সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার মানুষ যতই চিৎকার করে বলুক, সে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার মানুষ; তা কিন্তু কখনোই সত্য হয়ে ধরা দেয় না। কারণ, সাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ কখনো প্রগতিকে স্বাগত জানাতে পারে না। শুরুতেই তারা বাঁধা দিতে শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে জীবনের প্রয়োজনে একসময় তা মেনেও নেয়। এসব মানুষ নিয়েই যত সমস্যা! এরা না ঘরকা, না ঘটকা হয়ে থাকে।
যেকোনো বিশ্বাসে শান দেওয়া উচিত। সেটা যে বিশ্বাসই হোক না কেন! নিজের ওপর যদি আস্থা, বিশ্বাস থাকে; তাহলে ওই বিশ্বাস লালন করেই জীবনের পথ পাড়ি দেওয়া উচিত। এতে অন্তত নিজের কাছে নিজেকে প্রতারিত হতে হয় না। আত্মতৃপ্তি বা শান্তির জন্য আর কারও মুখাপেক্ষী হতে হয় না। নিজ বিশ্বাসের ভাইরাস নিজেকে কুরে কুরে খেলেও; শেষাবধি কোনো গ্লানি থাকে না। অথচ, মানুষ কোনো এক নির্দিষ্ট বিশ্বাসে অনড় থাকতে পারে না। অবশ্যই তা বাস্তবতার কারণে। এর জন্য দৃঢ় মানসিকতার প্রয়োজন, যা আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া ভার।
লোভী, স্বার্থপর, হীন মানসিকতার মানুষ নিজের আখের গোছাতে পারলেও এমন মানুষ গোটা সমাজ বা দেশের কোনো অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারে না। এই শ্রেণির মানুষই দোটানা মনোভাব নিয়ে চলে। যখন যেভাবে যে সুবিধা পায়, তার পুরোটাই নিতে উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকে। এরা মূলত সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার মানুষ। এরা যতই উচ্চবাচ্য করুক, সমাজ, মানুষ কিংবা দেশ নিয়ে যতই কথা বলুক; দিন শেষে এদের স্বরূপ ঠিকই প্রকাশ পেয়ে যায়। কারণ, তাদের ভেতরের সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের বীজ বা শেকড় তো তারা একেবারে উপড়ে ফেলতে পারে না। কৈশোরের বিশ্বাস একেবারে বদ্ধমূল হয়ে গেড়ে থাকে কী না! যতই শান দিয়ে একে পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রকাশ করুক না কেন; বদ্ধমূল বিশ্বাসের রহস্য ঠিকই বের হয়ে যায়।
আজকাল মানুষের সঠিক স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ মানুষের মৌলিক চরিত্র বোঝা বড়ই মুশকিল। মানুষ বেশ রহস্য নিয়ে চলতে পছন্দ করে। এটাও একটা ট্রেন্ড এখন। এতে কী হচ্ছে! এতে সমাজের ক্ষয়িষ্ণু ভাবটাই বেশি ফুটে উঠছে। কারণ, মানুষ দিগ্ভ্রান্ত। ছোটরা যেমন বড়দের বোঝে না, এবং বোঝে না বলেই অনুসরণ করতেও পারে না; তেমনই ছোটদেরও আজকাল আর বড়রা বুঝতে পারছে না। মূলে একটাই সমস্যা, বিশ্বাসের জায়গাটা পোক্ত নয়, যার ফোকাস অন্যরা বুঝতে পারবে বা সত্যটি গ্রহণ করবে!
এমন দোদুল্যমান অবস্থায় আজ গোটা বিশ্ব টলমল। শুধু বাংলাদেশ কেন বলি! তবে বাংলাদেশকে এই ব্যাপারে একটু বেশিই চিহ্নিত করতে হয়। সততার জায়গাটা পরিষ্কার নয়, বিশ্বস্ততার কোনো মাপকাঠি নেই। তাই বোঝাও যায় না, বিশ্বাসের ভিত্‌ কার কোথায় গেঁড়ে আছে। কাজকর্মে অবচেতন মনে অনেকের অনেক কিছু প্রকাশ হয়ে যায় বলে আমরা ধরে নিই, কে বা কারা সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার মানুষ। আসলে সবাই কঠিন বাস্তবতার শিকার। এর মধ্যে নিজেকে ঠিক রেখে যারা নিজ বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা!
কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সুবিধাবাদী মানুষেরা মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক—যা তাদের কৈশোরের বদ্ধমূলে জুড়ে দিয়েছে অভিভাবকেরা। কৈশোরের বদ্ধবিশ্বাস থেকে এরা কখনোই উঠে আসতে পারেনি। তাই তারা বিশ্বাসের বরখেলাপ করে প্রতি পদে পদে। কৈশোরের বিশ্বাসই আসলে মানুষকে আগামীর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়; তা সে যতই নিজেকে শান দিয়ে প্রকাশ করুক না কেন! তাই বলতেই হয়, কৈশোরের বিশ্বাসই বদ্ধবিশ্বাস।