যেভাবে 'আংকেল' হলাম

কল্পনাকে হার মানায়? অথচ বাস্তব! দিন যায়, মাস বছর যায়-কখনো কি দেখেছি নিজের পরিবর্তন? আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও বুঝিনি, অলক্ষ্যে বদলে যাচ্ছি আমি। কিন্তু মন তো রয়ে গেল সেই শৈশবের। ইচ্ছে হয় গাছে চড়ি, জলে ঝাঁপ দিই। কিন্তু শরীর?
১০ বছর আগেও কেউ বলেনি, আপনি বদলে যাচ্ছেন। এই হয়ে যাচ্ছেন, তেমন হয়ে যাচ্ছেন। প্রথম জানালেন মোটর ভেহিকলের অফিসের কাউন্টারে মধ্যবয়সী এক নারী। ৭/৮ বছর আগে। কি এক কাজে গিয়েছিলাম। ফরমটা হাতে নিয়ে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। একসময় বললেন, মি. রহমান, তুমি লিখেছ চুলের রং কালো। কিন্তু তোমার চুলের রংতো গ্রে মানে ধূসর। বললাম, হবে হয়তো। কালো লিখে আসছি বরাবর। ঠিক আছে, কেটে লিখে দিন গ্রে। কাজ শেষে অফিস থেকে বের হয়ে আসছি, মনে মনে ভাবছি—চুল পেকে গেছে, তাহলে কি বুড়ো হয়ে গেলাম। আজই মিলল বুড়ো হওয়ার অফিশিয়াল স্বীকৃতি।
এরপরই যা ঘটতে থাকল—সবকিছু জানান দিচ্ছে, আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। প্রথম দু-একবার হোঁচট খেলেও পরে সবই সয়ে যায়।
মনে পড়ে, নিউইয়র্কের এক সংবাদপত্রে আমার এক সহকর্মীর কথা। জ্যেষ্ঠ নামকরা সাংবাদিক। এখন মরহুম। অফিসের এক তরুণী সহকর্মী সবাইকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করলেও তাঁকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করেন। তিনি একদিন ভীষণ রেগে গেলেন। ওই তরুণীকে ডেকে এনে বললেন, তুমি আমাকে ‘চাচা’ বলে ডাকো কেন? উত্তরে ওই তরুণী বললেন, আপনি অফিসের মুরব্বি, তাই চাচা বলে ডাকি। এতে তিনি আরও রেগে গেলেন। বললেন, আমি তোমার কোন কালের চাচা?
আমি ‘চাচা’র প্রথম স্বাদ পাই হাসপাতাল বা কোনো এক মেডিকেল ক্লিনিকে। এক তরুণী নার্স এসে বললেন, আংকেল আপনার প্রেশার চেক করব। ওইতো শুরু। এরপর হাসপাতালে থেকেছি, আংকেলই শুনতে হয়েছে।
নর্দার্ন ব্লুবার্ডে এক রেস্তোরাঁয় আমি ২০ বছরের খদ্দর। দুজন পুরোনো কর্মী এখনো সেখানে কাজ করেন। তারা আগের মতোই ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। নতুন সব কর্মীরা ডাকেন ‘আংকেল’। কি দেব আংকেল, আংকেল আপনার কফি—এই সব কথাবার্তা আর কি।
শুধু এই রেস্তোরাঁ কেন, এখন সব জায়গায়ই শুনি ‘আংকেল’ ডাক। কয়েক মাস আগে সিলেটে পুরোনো কর্মস্থলে একজন বললেন, মাহবুব ভাই, আপনিতো বুড়ো হয়ে গেছেন। বললাম, আর কত জোয়ান থাকব?
হাসপাতালে গেলে আমার হাতে একটি লাল ফিতা বেঁধে দেয়। ওই প্রথমবার যে দিয়েছিল—তারপর রেকর্ড দেখে দেখে সব হাসপাতালে একই ফিতা লাগিয়ে দেয়। এর মানে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো আশঙ্কা আছে আমার। যদিও কখনো পড়িনি। ভাগ্যিস, হাতে লাঠি ধরিয়ে দেয়নি। এক হাসপাতালের লম্বা করিডরে আধ ঘণ্টা হেঁটে প্রমাণ করেছিলাম—আমি পড়ে যাই না। যাই ভাবি না কেন আমি, ওদের খাতায় তো আমার মনের কথা
লেখা নেই।
সেদিন পুরোনো একটি নথিপত্র খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, আমার পুরোনো বাংলাদেশি পাসপোর্ট। ওই পাসপোর্টের ছবি আর বর্তমান আমেরিকান পাসপোর্টের ছবি পাশাপাশি রাখলাম। ছবিই বলে দিচ্ছে, আসলেই তো বদলে গেছি। আগের আমি আর নেই। কপালে ভাঁজ পড়েছে, কুচকে গেছে।
এখন কোনো অনুষ্ঠানে আমার পরিচয় দেওয়ার সময় ‘প্রবীণ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। একসময় আমরা যাদের ‘প্রবীণ’ বলে শ্রদ্ধা জানাতাম সেই প্রবীণদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারা তো সবাই বৃদ্ধ। আমিও কি তাই? হবে হয়তো।
বাস্তবতা বড়ই কঠিন। সবই মেনে নিয়েছি।
এক জায়গায় এখনো আমি মুক্ত স্বাধীন খুব বেশি। সেটা আমার মন। পরিবর্তন নেই। যে মন আমার সঙ্গী ছিল। সেই একই মনের গহিনে এখনো আমার বসবাস। শরীরের সঙ্গে মনের কেন পরিবর্তন হয় না—এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা যেতে পারে।
শেষ করব একটি অজানার কথা জানিয়ে। এক মেডিকেল ক্লিনিকের কাউন্টারে বাঙালি তরুণীরা আমাকে বারবার ‘আংকেল’ বলে সম্বোধন করছিল। এমনকি নার্সিং স্টাফরাও। সেদিন কাউন্টারে বসা প্রায় ৩০ বছর বয়সী এক নারী। অভ্যাসবশত আমি তাঁকে ‘আংকেল’ সম্বোধন করতেই বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন—হ্যাঁ, বলুন। তার বিস্ফোরিত চোখ কি রাগের নাকি অবাক কিছু শোনার—এর উত্তর আমার কখনো জানা হবে না।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।