মনহরিনী নিউইয়র্কের গ্রীষ্ম

আমার শহরে দিন এখন বর্ণিল হেমন্তের প্রতীক্ষায়। তপ্ত ক্লান্ত গ্রীষ্ম সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে আবির রঙের ছটায় উচ্ছল হেমন্তের দিকে। দিনপঞ্জির হিসাব মতে, খুব অল্পদিন পরেই এই শহর হেসে উঠবে হেমন্ত লক্ষ্মীর আলপনায়। গ্রীষ্মের পান্না সবুজ প্রকৃতি কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ার সেজে উঠবে জাফরানি হলুদে বা আগুনে লালে। চোখের কার্নিশ পেরিয়ে সে রং ঠিক খুঁজে নেয় মনের অলিগলি। ঝরে যাওয়া পাতার মর্মরধ্বনি মনের কুঠুরিতে বন্দী হওয়ার আগে মনকে রাঙিয়ে নেয় জলরঙে।
নিউইয়র্কের প্রতিটি ঋতুই নিজ নিজ সৌন্দর্যের ভিন্নতার সঙ্গে বৈশিষ্ট্য আর অনুষঙ্গেও প্রবলভাবে স্বকীয়। এ জন্যই বুঝি এই শহর এক অনন্য শহর। জীবনের হরেক রকম পসরা সাজিয়ে অনবদ্য আখ্যান লিখে চলে অবিরত। আজ বলি প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া গ্রীষ্মঋতু নিয়ে। নিউইয়র্কের গ্রীষ্ম মানেই পথ ভুলে দূরের পাহাড়ের হাতছানিতে হারিয়ে যাওয়া মেঘহীন ঝকঝকে এক নীল আকাশ। প্রকৃতিজুড়ে পান্না সবুজের এক নিরবিচ্ছিন্ন সাতকাহন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় এই শহরের মানুষগুলোর উচ্ছ্বাস। দীর্ঘ শীতের পর আড়মোড়া দিয়ে যেন জাগে এই শহরের মানুষগুলো। স্ট্রিট থেকে ব্লক, শহর ছাড়িয়ে উপশহর—সব জায়গায় এ সময় এক অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য খেলে যায়। দুমাস স্কুলগুলোর লম্বা গ্রীষ্মকালীন ছুটি যেন সে আনন্দে রাজটিকা হয়ে ওঠে। সপ্তাহান্তের দিনগুলো বা লম্বা সপ্তাহান্তে ভিড় জমে শহরের উপকণ্ঠে। পরিবার-পরিজন নিয়ে নাগরিক ব্যস্ততা পেছনে ফেলে সবাই বসত গড়ে প্রকৃতির কোলে বা কোন দর্শনীয় স্থানে। হতে পারে তা সবুজ প্রাচীরঘেরা কোন জলাধার বা সুউচ্চ পাহাড়ের শিখরে সুসজ্জিত কোন ফার্ম হাউস। আবার কখনো লোকালয় থেকে অনেক দূরে সবুজ অরণ্যে এই শহরের মানুষ খুঁজতে যায় অরণ্যের দিন-রাত্রি। আর এ সবই শুধু গ্রীষ্মের রূপকথা। পথে পথে এই যে গল্পের সমারোহ, তা শুধুই গ্রীষ্মের এক স্বকীয় গাঁথা।
এই শহরের গ্রীষ্মে পথে যেতে যেতে জমা হয় কত গল্পই। আমারও জমেছে কিছু গল্প—যাওয়ার পথে নুড়ি কুড়ানোর বা একটি নিস্তব্ধ দুপুরের।
সেদিন সপ্তাহান্তে সব নাগরিক ছুটি নিয়েছিল। মেঘেরাও ঘুরতে গিয়েছিল পাহাড়ে। একচ্ছত্র নীল আকাশ মাথার ওপর শামিয়ানা হয়ে ঝুলে ছিল। যখন তাতানো রোদের দিন ঘর ছাড়ার অবিরত হাতছানি দেয়, তখন তাকে উপেক্ষা করার সাধ্যি অন্তত আমার হয় না। উদ্দেশ্যহীন পথে বের হই, পথিক হয়ে। যেতে যেতে শহর ছাড়িয়ে চলে যাই উপশহরের প্রান্তে। আটলান্টিকের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এই নীরব জনপদ; যার নাম নর্থ ব্যাবিলন লং আইল্যান্ড। আমার পথ থমকে গেল বেলমন্ট লেকের এই নিস্তব্ধ পাড়ে। নীরবতার আধ্যাত্মিক সুর ততক্ষণে মনের মধ্যে ঢেউ তুলেছে। লেকের পাড় ধরে কাশফুলের মতো বন্য গাছগুলো বাতাসে দুলে দুলে যে লয় তুলছিল, তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল গাছের পাতার তিরতিরানির সুর।

আমি যেন তখন পথ ভুলে পৌঁছে গেছি কোন জাদুর রাজ্যে। যেখানে কোন জাদুকর তার জাদুর ছড়ি ঘুরিয়ে রাজপুত্রকে মৌন প্রকৃতি বানিয়ে দিয়েছে। আর ঝিরঝির বাতাস হয়ে গেছে কোন ঘুঁটে কুড়ানি, যে অবিরাম বাতাসের তানপুরায় সেধে চলেছে সপ্তক; রাজপুত্রের মৌনতা ভাঙতে।
বাতাসের সেই সুর আমার সময় থমকে দিলেও চোখ মেলে দিয়ে রেখেছিলাম লেকের নীল জলরাশিতে। মনের অন্তঃপুরে ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল ‘সে নদীর জল, তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল’। আমার সামনের জলরাশি তখন আকাশের রং মেখে নীলোত্তম হয়ে উঠেছে। নীল জলাধার পেরিয়ে চোখ পড়ল ওপারের সবুজ প্রাচীরে। আমি বহুদূরের কোন দ্বীপের বাসিনী হয়ে গেলাম যেন তৎক্ষণাৎ। সেই দুর্ভেদ্য সবুজের আড়ালে কোন অজানা কল্পরাজ্যের ছবি চোখের পাতায় এসে ভর করল। আর ঠিক তখনই ঝিরিঝিরি বাতাসের ফিসফিসানি যেন আরও বেগবান হয়ে উঠল। জ্যৈষ্ঠের তপ্ত দুপুর ততক্ষণে ব্যসে ছোট হতে শুরু করেছে। সূর্য তখন মাঝ আকাশ ছেড়ে আস্তে আস্তে পশ্চিমে জায়গা করে নিয়েছে। আমি অদ্ভুতভাবে আকাশের রং পালটে যাওয়া দেখলাম। আচ্ছা, আকাশ কি জীবনের গল্প চুরি করে এমন রং পালটায় নাকি জীবন ধার করে আকাশের গল্প! আমার ক্লোবাল্ট ব্লু আকাশ তখন গোধূলির সাজে সেজে ওঠার প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে।
আকাশ সলজ্জ লাল পরিধানে যখন লাস্যময়ী হয়ে একটি দিনের সমাপ্তিগাথা শোনাতে যাবে তখন সেই ঝিরিঝিরি বাতাসের ফিসফিসানি যেন রুদ্র হয়ে ওঠে। গাছের পাতার লয়ে লয় মেলানো বন্য কাশফুলের সেই সুর যেন হঠাৎ করেই যেন লয়হীন হয়ে পড়ে। সারা দিন সপ্তক সেধে চলা সেই ঘুঁটে কুড়ানি তখন আশাহত আরেকটি দিন ব্যর্থ হওয়ার ব্যথায়। রাজপুত্রের সেই মৌনব্রত আজও যে অটুট রইল!
ওপারের সবুজ প্রাচীরে বাতাস ধাক্কা খেয়ে ডমরু বাজিয়ে চলছিল, তখন পথিককে ঘরে ফেরার তাগিদ দিয়ে আকাশে উড়ে যায় এক ঝাঁক বক পাখি। আকাশ তখন নিজের বুকে সূর্যকে লুকিয়ে এই জাদুর রাজ্যে আঁধার নামাতে বদ্ধ পরিকর। আকাশের বুকে সূর্যটাকে ডুবে যেতে দেখে কবির কথা মনে পড়ে , ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হলো তার সাধ।’
তবে আমি এমন নিস্তব্ধ দুপুর, বাতাসের তানপুরা, নীল জলরাশি আর সবুজ জাদুর রাজ্য পেলে বেঁচে থাকতে চাই অনন্তকাল; আমার পৃথিবীর জন্য। নিউইয়র্কের প্রতিটি ঋতুর আছে এমন অসংখ্য কাহিনি। নিয়ম করে আমি শুনিয়ে যাব সে সব পেস্তারঙা দিন বা শুভ্রকান্তি প্রহরের গল্প।