আমেরিকাকে বেসেছি ভালো

ইংল্যান্ডের বেডফোর্ড থেকে সপরিবারে আমেরিকা ভ্রমণে এসেছেন লোকমান। সঙ্গে স্ত্রী ও তিন সন্তান। এখানে এই প্রথম। আমার স্ত্রীর নিকটাত্মীয়। জেএফকেতে যাব তাদের রিসিভ করতে। কোন এয়ারলাইনস—স্ত্রী নামটি মনে রাখতে পারেননি। ম্যানচেস্টার টু নিউইয়র্ক ফ্লাইট। ‘থমাস কুক’ এয়ারলাইনস। মনে না থাকারই কথা। তাদের ভ্রমণ তালিকায় নিউইয়র্কের ঐতিহাসিক প্রায় সবই আছে। স্ট্যাচু অব লিবার্টি, লিবার্টি টাওয়ার, ওয়াল স্ট্রিট, এনওয়াইইউ, কলম্বিয়া, সেন্ট্রাল পার্ক, মিউজিয়াম, ম্যানহাটন ইত্যাদি। এরপর ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউস, ক্যাপিটাল হিল, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, লস অ্যাঞ্জেলেসে হলিউড, লেগুনা বিচ, সান ডিয়াগো-ইত্যাদি। আলাস্কা এয়ারলাইনে যাবেন লস অ্যাঞ্জেলেস। একই উড়োজাহাজে ফিরবেন নিউইয়র্ক। নিউইয়র্ক থেকে ফের ম্যানচেস্টারে থমাস কুক এয়ারলাইনসে করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাদের সফর খুব সুন্দর নির্ঝঞ্ঝাট হয়েছে। এ জন্য বারবার ধন্যবাদ দিলেন আমেরিকার নিকটাত্মীয়দের। বিলাতের আতিথেয়তা আমি উপভোগ করেছি, অতুলনীয়। আমেরিকায়ও যে তা পাওয়া যায় লোকমানের প্রশংসার তা অনুভূত হলো।
মধ্যবয়সী লোকমান সিলেটের। কিন্তু জন্ম তাঁর ইংল্যান্ডে। ওখানে বড় হওয়া, লেখাপড়া, ব্যবসা। পুরো পরিবার ধর্মানুরাগী, ইতিমধ্যে স্বামী-স্ত্রী হজ করেছেন। বড় মেয়ে ‘এ’ লেভেল শেষ করে যাচ্ছে লিডস ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে। রুচিসম্মত আধুনিক পোশাক-আশাক পরেন সবাই। নামাজ কাজা হয় না। হালাল ছাড়া কিছু খান না। লোকমান ফুটবল খেলেন, চেলসির সমর্থক। ছোট পাঁচ বছরের ছেলে লিভারপুলের মো. সালাহর ভক্ত।
লোকমানের প্রতি আমি আকৃষ্ট হই তাঁর এক মন্তব্যে। কাজিনদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় বলছিলেন, কেউ বলে রেডিক্যালও না, নয় লিবারেলও। ইসলাম ইজ ইসলাম।
সফরের শেষ প্রান্তে লোকমানের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়। আমি স্মরণ করলাম, বেডফোর্ডের গহিন এক গ্রামে ৯৯ সালে তার রেস্টুরেন্ট ডিনার করেছিলাম। সে স্বাদ এখনো ভুলিনি। কি অপূর্ব রান্না। বললেন, সেই শেফ এখনো আছেন। বললাম, মাশাআল্লাহ। আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন।
আমাকে ডাকেন ফুপা। বললেন, ফুপা, কি বলব, গণমাধ্যম যেভাবে আতঙ্ক ছড়ায়, স্বস্তি পাই না। এই আমেরিকায় আসার আগে কতজন কত বলেছে। ট্রাম্পের আমল, এখন যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? এ হতে পারে, সে হতে পারে। ভয়ভীতি মুসলিমদের জন্য, এখন আমেরিকা ভ্রমণ ঠিক হবে না—আরও কত পরামর্শ। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বাস্তবে দেখলাম তার সব উল্টো। হোয়াইট হাউসের সামনে কত লোক, কত ধরনের ব্যানার পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হোয়াইট হাউসের এক তরুণ নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে ওখানে আলাপ হলো। বেশ অন্তরঙ্গ পরিবেশ। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছি শুনে বলল, তোমাদের গণতন্ত্র বেশ ভালো। পার্লামেন্টে সরকারি ও বিরোধী দল সামনা-সামনি বসে মত ও বাক্য বিনিময় করে। আমাদের গণতন্ত্র একটু ভিন্ন।
লোকমান বললেন, কোথায় ভীতি? ওই আতঙ্কের পরিবেশ কোথাও দেখিনি। স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে নিউইয়র্ক। এ রকম আর হয় না। পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এখানে আছে।। মুক্তমনা, উদার। মনপ্রাণ খুলে কথা বলা যায়। একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে। কি সুন্দর সমাজ। এখানে আমি আরও আসব।
লোকমান বললেন, জানেন ফুপা, আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির জন্য অনেকাংশ দায়ী গণমাধ্যম ও এক শ্রেণির রাজনীতিক। ওই বাজে প্রোপাগান্ডা অবশ্যই থামাতে হবে। তার পরামর্শ, আমার যেখানেই থাকি না কেন, সেই মাটি ও মানুষের প্রতি আমাদের কর্তব্য আছে। এটা শুধু মানবতার নয়, ধর্মেরও তাগিদ। এই মাটির ঋণ শোধ করতে হবে। আমেরিকার সংবিধান কত সুন্দর, কত ভালো। সব ধর্মের স্বীকৃতি আছে। আছে বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। সপরিবারে এখানে ইমিগ্রান্ট হওয়া যায়। দেশের মাটি ও জনগণ ভালো, খুবই ভালো। সরকারের দোষ-ত্রুটি থাকতে পারে, সেটা ভিন্ন। কিন্তু যেখানে সংবিধান ভালো, জনগণ ভালো, মাটি ভালো-তার কল্যাণে আমাদেরও সঙ্গী হতে হবে।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।