শোনার ভুল, বোঝার ভুল

আমেরিকায় নতুন এসে ভাষা ও কালচার বোঝার বিপত্তি নিয়ে অনেক কৌতুক আছে। যেমন একজন জিজ্ঞেস করল, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ক্যালিফোর্নিয়া কত দূর? অথবা এই বছর ফোর্থ অফ জুলাইয়ের বন্ধ কত তারিখে? স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে গল্পটাও খুব জনপ্রিয়। এক ভদ্রলোক রেস্টুরেন্টে কাজ নিয়েছেন, কাস্টমার তার কাছে স্ক্রু ড্রাইভার চাইল। সে জানত না স্ক্রু ড্রাইভার একটা মিক্সড ড্রিঙ্কসের নাম। সে অনেক খুঁজে পেতে কিচেন থেকে একটা স্ক্রু ড্রাইভার এনে দিল। বড় একটা হাসির ব্যাপারই ঘটে গেল। এমন আরেকজনের ধারণা ছিল, ‘স্যালভেশন আর্মি’ ইউএস আর্মির একটা দুস্থ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। না হলে ‘আর্মি’ কথাটা থাকবে কেন? অন্যের বোকামিতে হাসতে খুবই মজা লাগে। নিজেরটা ধরা যায় না। কোনো কুক্ষণে যদি ধরা পড়েও তো হাসি আসে না, রাগ হয়।
এ বিষয়ে ফোরকানের যথেষ্টই শিক্ষা হয়েছে, তবে কারও সামনে তিনি স্বীকার করেন না। কিছু কিছু বিষয় অন্যদের জিজ্ঞেস করেও দেখেছে, বহু মানুষ তাঁর মতোই ভুলের মধ্যে বসবাস করছে এবং আনন্দে আছে। সম্প্রতি একটা কৌতুক এসেছে, কেউ মরলে নিজে বুঝতে পারে না যে সে মরেছে, কিন্তু অন্যরা কষ্ট পায়। তেমনি কেউ বোকা হলে নিজে বুঝতে পারে না, অন্যের হাসি–তামাশার শিকার হতে হয়। একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, যে জানে না, সিংহভাগ সময় সে নিজে তাও জানে না। অন্যরা এটি বুঝতে পারে ।
চারকান মানে ফোরকান নিজের নাম নিয়েই অনেক হাসির সম্মুখীন হতেন। কিন্তু অন্যকে নিয়ে হাসতে তিনিও ছাড়েন না। মানুষ ভুক্তভোগী হলে যে অন্যকে ভোগাবে না, এমন ধারণা ঠিক নয়। তারপর আসে অবজ্ঞা। অন্যকে অবজ্ঞা করতে কে–ই বা কম যায়। ঘটনাটি এ রকম—এক ফরাসি ভদ্রলোকের সঙ্গে ফোরকানের যোগাযোগ হলো, এয়ার বিএনবি–এর মাধ্যমে। ওখানে দুদিনের জন্য বাসা ভাড়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি, হোটেলের চেয়ে ভাড়া কম। আবার ভদ্রলোক নিজেই ঘুরিয়ে দেখাবেন বলে লেখা আছে, কফি বানিয়ে খাওয়াবেন। তিনি আবার স্বভাব কবি, চাইলে কবিতাও শোনাতে পারেন ফরাসি ভাষায়। কিন্তু গড়িমসি করে দেরি করে ফেলায় রুমটা হাতছাড়া হয়ে গেল। বিষয়টা জানাতে লোকটি তাঁকে লিখলেন, ‘দ্যাট’স এ শেইম’। ফরাসি ভদ্রলোক তো ইংলিশে ভুল করবেই। নিশ্চয়ই ওর ভাষায় এর মানে অন্য রকম, ট্রান্সলেট করাতেই একটা আপত্তিকর কথা এসে গেছে। যেমন, আমি তোমার অফিসে যাচ্ছি, এ কথাটা জামাল সাহেব তাঁর বসকে সহজ অনুবাদে বলতেন, ‘আই এম গোয়িং টু ইওর অফিস’। প্রতিবারই তাঁর বস হাসত। সে বলত, আর ইউ কামিং? জামাল সাহেব মনে মনে বলতেন, আরে ব্যাটা যাচ্ছি তো, মুখে বলতেন, ইয়েস, আই আমি গোয়িং রাইট নাও। ত্রুটিটা কোথায়, সেটা ধরতে তার বেশ সময় লেগেছে। এমন কিছুই হয়তো ফরাসি ভদ্রলোকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। কিন্তু সেদিন মেলিসা তাঁকে সবার সামনে মুখ গম্ভীর করে একই কথা বললেন, ‘দ্যাট’স এ শেইম’। তখন ফোরকানের হুঁশ হলো, ফরাসিকে অবজ্ঞা করা ঠিক হয়নি, এই কথাটার মানে তিনি জানেন না। হুবহু বাংলায় অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘এটা লজ্জার বিষয়’, কিন্তু মেলিসার মতো ভদ্রমহিলা তাঁকে কখনোই এ কথা বলে লজ্জা দেবেন না। শুধু তিনি যে জানেন না তা নয়। সত্যিই এর অর্থ তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখেছে। এ জন্যই মনীষীরা বলে গেছেন, To realize that you do not understand is a virtue; not to realize that you do not understand is a defect.
এমন ঘটনা অনেক আছে। একদিন বড় একটা বচসাই হয়ে গেল কলিন্সের সঙ্গে। অনেকক্ষণ কথা-কাটাকাটি। এই ছেলে একগুঁয়ে ধরনের, বোঝেও একটু কম। বচসার কারণটা ছিল এমন—সে বলেছে ‘লং শট’ অর্থ এটি অনেক দূরের ব্যাপার। অথচ ব্যাপারটা মোটেও দূরের নয়, যেকোনো দিন ঘটে যেতে পারে। পরে কলিন্স বুঝতে পারল কোথাও গোলমাল হচ্ছে। সে জিজ্ঞেসই করে বসল, তুমি কি লং শট কথাটার মানে জানো? ফোরকান বলল, জানব না কেন, অতি সহজ অর্থ। এর অর্থ হচ্ছে, অনেক দূরের ব্যাপার। কলিন্স মাথা ঝাঁকালো, না তা নয়। এ জন্যেই তোমার কথা আর আমার কথা মিলছে না। ‘লং শট’ অর্থ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। অনেক দূর থেকে গুলি করলে লক্ষ্য ভেদের সম্ভাবনা যেমন কমে যায়, তেমনই।
তারপর আছে স্মৃতির ভুল। কথাটা পরিষ্কার শোনা গেছে, মানেও বোঝা গেছে, স্মৃতি তাকে ইংলিশ থেকে বাংলা করে আবার তার বিদ্যানুযায়ী ইংলিশ বানিয়ে সংরক্ষণ করেছে। তাতে ইংলিশ আর ইংলিশ নেই। এমনি একটা ভুল করে ফোরকান বিপদে পড়ে গেলেন। এটা তিনি অনেকবারই শুনেছেন, লাগসই একটা কথা, কিন্তু বলতে গিয়ে ভুল হয়ে গেল কেমন করে? ফ্র্যাঙ্কের মতামতের সঙ্গে সে যার-পরনাই একমত, বিষয়টি সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে গেল ফোরকান-‘আই কান্ট এগ্রি অ্যানি মোর’। শুনে ফ্র্যাঙ্কের মুখ কুঁচকে গেল। সে মানে ধরতে পারছে না, ‘দ্যাট’স এ শেইম’-এর মতো কিছু একটা হয়ে গেল নাকি?
ফ্র্যাঙ্ক ব্যবহারেও খুব ফ্র্যাঙ্ক, স্কুলশিক্ষকের মতো গলায় বলল, তোমার কথার অর্থ হয়েছে, ‘আমি আর তোমার সঙ্গে একমত হতে পারছি না।’ তুমি কি তাই বলতে চেয়েছ? তা যে ফোরকান বলেনি, এ ব্যাটা ভালোভাবেই জানে, সুযোগ বুঝে একটু খোঁচা দিল আর কি। গুগল করতে হলো, সামান্যই ভুল হয়েছিল। কান্ট–এর জায়গায় ‘কুডনট’, আর ‘অ্যানি মোর’ এর জায়গায় শুধু ‘মোর’ বলতে হতো। তাতেই মানের কি ব্যবধান! কথাটা এতবার শুনে এসেছে সে, কিন্তু ওভাবে ভুলটা মনের মধ্যে গেঁথে রইল কেন?
দেখলেই দেখা হয় না, শুনলেই নিরপেক্ষভাবে শোনা হয় না। আমাদের মস্তিষ্ক একভাবে তৈরি হয়ে আছে, সেটা অ-নিরপেক্ষ। সে নিজের মতো করে শোনে, অর্থ দাঁড় করায়, তারপর বাক্যটিকে তার সুবিধামতো পরিবর্তন করে সযত্নে রেখে দেয়, আমাদের বলে এই তোমার স্মৃতি। অবিকল যা শুনেছ ঠিক তাই। আমরা তাকেই বের করে এনে বলি, এই দেখো আসল সত্য। টাটকা মেমোরি, নিজের কানে শোনা। ঝগড়া মারামারিও বাঁধিয়ে ফেলি। হায় কান!
ফোরকানের এ বিষয়ে নতুন করে যে খুব কিছু শেখা হবে, সে সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। এভাবে ভুল ভ্রান্তির মধ্যে দিন চলতে থাকবে আর কি, অথবা ইংরেজি বাৎচিৎ বন্ধই করে দিতে হবে।
A fear of weakness only strengthens weakness—কথাটা মনে হতেই বুকে বল পেল ফোরকান। ভুল হয় হোক, কুচ পরোয়া নেহি।