দুই দম্পতি, দুই রূপ


শুক্রবার। সপ্তাহের শেষ কার্য দিবস। তবে আজ আমার কাজ নেই। ব্যক্তিগত কারণে কাজের জায়গায় যাব বলে ই ট্রেনে চড়েছি জ্যাকসন হাইটস থেকে। কুইন্স প্লাজা স্টেশনে কামরায় উঠলেন বাংলাদেশি এক প্রবীণ যুগল। ভদ্রলোকের রাশভারী চাহনি আর সময় নিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলার ধরন দেখে মনে হলো, বাংলাদেশে আমলা-টামলা ছিলেন হয় তো। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। দাঁড়ি ও চুলে লাল রঙের মেহেদি মাখানো। হাতে শৌখিন লাঠি, যেটির মুখে নকল আইভরি দিয়ে বানানো বাঘের মাথা। সঙ্গের মহিলা যে তাঁর স্ত্রী এতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ হলো না। কারণ তাঁর হাত খালি থাকলেও বেগম সাহেবার হাতে মাঝারি আকারের একটি কাপড়ের ব্যাগ। দেশে বড়লোক বোঝানোর আধুনিক সিম্বল আড়ংয়ের ছাপ খেয়া ব্যাগের মাঝ বরাবর। ভেতরে রাজ্যের জিনিসপত্র—বাংলা পত্রিকা, পানির বোতল, বাংলাদেশি চিপসসহ নানা কিছু। দেখে বেশ ভারী মনে হলো যখন মেঝেতে ব্যাগটি রাখলেন। চেহারায় খানিক বিরক্তির ছাপও ছিল। তবে সেটি প্রকাশ করতে চাইছেন না। ঠোঁটের কোণে কষ্টের হাসিটি ধরে রেখে সাহেবকে খুশি রাখতে চাইছেন। এত কিছুর পরও সাহেব ব্যাগটি হাতে নিচ্ছেন না। ভাবখানা যেন তিনি এখনো দেশেই আছেন। যদি কেউ দেখে ফেলে, নিজ হাতে ব্যাগ নিয়ে ঘুরছেন তা হলে তো ইজ্জতের বারোটা বেজে যাবে। যার হাত ব্যাগ থেকে শুরু করে বাক্স প্যাটরা অন্যরা বহন করল, উনি কীভাবে স্ত্রীর হাতের ব্যাগ নিয়ে ঘুরবেন? সেই বিষয়টি যেন তাঁর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠল। দুজন বসলেন আমার পাশেই। দেশের সংসারসহ এখানে ছেলে অথবা মেয়ের সংসারের নানা টুকিটাকি আলাপ করছেন, তবে যথা সম্ভব নিচুস্বরে এবং গম্ভীরভাবে।
নিইউয়র্কে এখন গ্রীষ্ম মৌসুম চলছে। গরমে সবার হাঁসফাঁস অবস্থা। সপ্তাহের শেষ দিনে বিদেশিসহ অনেকেই বেরিয়েছেন শহরের নানা দর্শনীয় স্থানে দেখতে। ই ট্রেনের শেষ মাথা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। এ সময়ে ট্রেনে বেশ ভিড় থাকে। প্রতিটি স্টেশনে লোকজন নামছে, কেউ আবার উঠছে। অধিকাংশ যাত্রী গরমে বিরক্ত ও তৃষ্ণার্ত। গরমে তাই তৃষ্ণা নিবারণের জন্য হাতে পানীয় ভর্তি বড় বড় বোতল আর পরনে সংক্ষিপ্ত পোশাক। গ্রীষ্মের এই ভীষণ উত্তাপপূর্ণ দিনে একেবারে বেমানান নয়। শেষ স্টেশনে নামার ৩/৪ স্টেশন আগে জনাচারেক তরুণ-তরুণী হুড়মুড় করে কামরায় ঢুকল। কামরায় বসা ও দাঁড়ানো সবার চোখের দৃষ্টি নিমেষে সদ্য আসা তরুণ–তরুণীদের দিকে চলে গেল। গ্রীষ্মের রং–বেরঙের পোশাক পরিহিতাদের দুজনের পোশাকই ছিল তুলনামূলক বেশ সংক্ষিপ্ত। মনে হলো, ওরা কোন সাগরতীরে বেড়াতে চলছে। কিন্তু সময় বাঁচাতে অ্যাপার্টমেন্ট হতেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেছে। সবার চোখ সরাসরি নয়তো ডানে কিংবা বামে সামান্য নড়াচড়া করে চার তরুণীর দিকেই নিবদ্ধ। হঠাৎ শুনি, নিম্ন স্বরে একজন মহিলার আওয়াজ ‘নাউজুবিল্লা’।
না তাকিয়ে ধরে নিলাম আওয়াজের উৎস বাংলাদেশি বয়স্কা ভদ্রমহিলা। কামরার ওপাশে বসা আরব চেহারার এক যুবক মুচকি হাসছে। বুঝলাম, সে ‘নাউজুবিল্লা’ আওয়াজ শুনেছে এবং এর অর্থও জানে। তারপরও বাঙালি প্রবীণ যুগলের যৌথ প্রতিক্রিয়া জানতে তাঁদের দিকে তাকাতেই শুনি, ভদ্রমহিলা বলছেন, এই অবস্থায় কেউ বাইরে বেরোতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তবুও ভালো বাংলাদেশের গার্মেন্টসে কর্মরত লাখ লাখ নারী–পুরুষ কর্মীদের বাঁচাতে মনে হয়। এই দেশে গরমকাল তিন মাসের বেশি রাখেনি। বাকি সময় ওরা মনে হয়, জান বাঁচাতে কাপড় পরে। পুরো সময় ধরে পাশে বসা গম্ভীর সাহেবের মুখে এই প্রথম একটি বাক্যই শুনলাম, তুমি বেশি কথা বল, শুনলে গা জ্বলে যায়। তবে চেহারাতে গা জ্বলার কোন লক্ষণই দেখলাম না। বরং চারপাশের সব নয়নাভিরাম যে তাঁরও চক্ষু এড়িয়ে যায়নি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
জ্যাকসন হাইটসের এক ফাস্ট ফুড দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে এক সুহৃদের অপেক্ষয় ছিলাম। উনি এলে ফাস্ট ফুডের দোকানটিতে একসঙ্গে ঢুকব। দোকানটি বেশ ব্যস্ত। সব বয়সের, নানা জাত আর বর্ণের লোকজন ভেতরে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। কেউ আবার ভেতরে বসে সেরে নিচ্ছে খাবার পর্ব। জানালা ঘেঁষে এক বয়স্ক বাঙালি দম্পতি বসা। দুজনের চেহারায় সুখী সুখী ভাব। দুজন কথায় কথায় প্রচুর হাসছেন যা সচরাচর দেশে কিংবা বিদেশে বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় না। বাঙালি স্বামী-স্ত্রী দুজন পাশাপাশি কিংবা হাত ধরাধরি করে হাঁটছেন এমন চিত্র দেখা বড়ই দুষ্কর। যে চিত্র বেশি দেখা যায় তা হলো, স্বামী নির্বিকার হয়ে চার পাঁচ ফুট ব্যবধান রেখে সোজা সামনে তাকিয়ে হেঁটে চলছেন। আর স্ত্রী কখনো একা, নয়তো মেয়ের হাত ধরে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন। কোন দরকারে কোথাও স্ত্রী থেমে গেলেন, স্বামী প্রবর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বেগম সাহেবাকে শাপান্ত করছেন। আর এদিকে বেগম সাহেবা ‘কুছ পরোয়া নেই’ ভাব নিয়ে তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাজকর্ম নয়তো বাজার সওদা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এমনি সাধারণ চিত্রে দুজন প্রবীণ বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ এত প্রাঞ্জল হয়ে আছেন, তা দেখে যেমন অবাক হলাম তেমনি আফসোস লাগছে চেনা জানা অনেক প্রবীণ দম্পতির জন্য। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে এ মনোরম ভালোবাসার চিত্র। এই নির্মম আর কঠিন বাস্তবতার নগরে এ চিত্র দেখার কথা নয়।
ভদ্রলোক কতক্ষণ পর উঠে কাউন্টারে যাচ্ছেন আবার হাতে করে খাবারের তালিকা নিয়ে ফিরে আসছেন। সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে পুরুষ লোকটি ফেরত গেলেন কাউন্টারে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিয়ে এলেন খাবার ভর্তি লাল ট্রে। ভদ্রমহিলার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। স্বামীর বুকের কাছের শার্ট ধরে কী যেন বলেই চলছেন। মুখে আনন্দ মিশ্রিত কৃত্রিম রাগের অভিব্যক্তি নিয়ে শাসনের সুরে কী যেন বলছেন। আর তা শুনে স্বামী প্রবরের উঁচু আওয়াজের ভঙ্গিতে কী যে উল্লসিত হাসি! চমৎকার দুজনের আন্তরিক ভাবের বিনিময়। আমার কাছে মনে হলো, তাঁরা দুজনই যেন এই মাত্র স্বর্গ থেকে শান্তি আর প্রেমের মধুময় বাণী নিয়ে মর্ত্যে নেমে এলেন। তাও মুক্ত চিন্তা আর মুক্ত ভালোবাসার দেশ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। বাহ চমৎকার! অবিশ্বাস্য তো বটেই। তখনই মনে হলো, শেখ ফজলুল করিমের প্রেম নিয়ে বিখ্যাত সেই উক্তি—
‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক,
কে বলে তা বহুদূর,
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক
মানুষেতে সুরাসুর।’

আমরা প্রতি ক্ষণে খুঁজে বেড়াই খানিক ভালোবাসা, আপন করে নেওয়ার মত ছোট্ট একটি ডাক। তুমি কোথায়? আমি তোমায় খুঁজেই চলেছি। এসো না দুজনে কোথাও বসি, একাকী নীরবে নিভৃতে। দুজনের আপন জিজ্ঞাসার স্বপ্নরথে চড়ে ঘুরে আসি সাত আসমান আর কাটিয়ে আসি সাত সাতটি অনন্ত প্রহর। কতই না সংক্ষিপ্ত একটি মাত্র জীবন আমাদের! কারও কারও জীবনের সিংহভাগ চলে যায় শান্তি দেবীর সন্ধানে। আর কেউ ছোট্ট পরিসরের ফাস্ট ফুডের দোকানে নিয়ে আসেন স্বর্গের সব সুখ। স্বর্গ হতে নেমে আসা ভালোবাসার নিখুঁত এপিসোড, আপন উল্লাসে।
সুহৃদের ডাকে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এসে দোকানে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম, দুজনে একটি পানীয়ের গ্লাসে দুটো স্ট্র দিয়ে পান করছেন সাদামাঠা এক পানীয়। অথচ তাদের দেখে মনে হলো, প্রবীণ এই দম্পতির পান করা সুখের সে পানীয় যেন স্বর্গের অমৃত সুধা পানের অবিশ্বাস্য আর অবিস্মরণীয় দৃশ্য। তা দেখে মনে হলো, জগতের সবাইকে ডেকে বলি, প্রেম তুমি চিরায়ত হয়ে এভাবেই আমাদের সব মানব–মানবীর মাঝে বিরাজ করো, স্থায়ী হও। তাই হোক আমাদের সবার প্রার্থনা।