'খরা' যেন পাঠকের ক্ষুধা নিবারণের খোরাক

ফেরদৌস সাজেদীন একজন কথাসাহিত্যিক। জীবনে যাপনে আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষের প্রতিচ্ছবি। তাঁকে কেবল গল্পকার, প্রাবন্ধিক বা ভ্রমণ সাহিত্যিক বলা যাবে না। তিনি সমগ্রকে আলিঙ্গন করে, সমগ্রকে সাধনা করেছেন এবং করে চলছেন। সময় তাঁকে উপযুক্ত বন্ধু করেছে, ভবিষ্যৎ তাঁকে সম্মান জানাবে।
ফেরদৌস সাজেদীনের খুব ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়নি; তবে যতটুকু দেখেছি এবং তাঁর কাছ থেকে যতটুকু পেয়েছি তাতেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আসলে তাঁকে দেখলে মনে আসে প্রশান্তি। তাঁর সদা হাসিমুখ দেখলে শিরঃপীড়া দূর হয়ে যায়। তিনি যখন কথা বলেন হতাশা দূরে পালায়। আর তাঁর লেখা স্প্রিংয়ের মতো দোল খেতে খেতে পাঠককে মুগ্ধতায় দোলায়। লেখক-পাঠকের কাছে পৌঁছানোর আগে তিনি নিজেই নিজের কাছে পৌঁছে গেছেন।
২০১৮-র নিউইয়র্ক বইমেলায় তাঁর লেখা ছোটগল্পের বই খরা দিয়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানাতে বলেছিলেন। নিজের অপ্রতুল জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার ভয়ে কিছু লিখতে নিজেকে বিরত রাখি, আবার ভালো লেখার প্রশংসা না করাও স্বভাব বিরুদ্ধ। এমন শাঁখের করাত থেকে মুক্তি পেতেই এই ধৃষ্টতা।
মানুষ প্রতিদিন গল্পের মধ্যই বাস করে। নিজের গল্প, অন্যের গল্প, গাছের গল্প, মাছের গল্প, ঘাটের গল্প, মাঠের গল্প। ডানে গল্প, বাঁয়ে গল্প, ওপরে, নিচে শতসহস্র গল্প। কিন্তু ঘটনাকে লেখনীর শৃঙ্খলে গল্পের খাঁচায় বন্দী করতে সবাই পারে না। চারপাশের সবকিছু, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে নিজের করে, পাঠকদের পাতে সুচারুভাবে পরিবেশনা খুব সহজ কাজ নয়। একজন ছোটগল্পকারকে সময় ও পরিধির সীমার মধ্যে কাজ করতে হয়। ছোটগল্পের বিষয়বস্তু কী হবে, এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা আছে। এর মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প নিয়ে ভাষ্য সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তিনি বলতে চেয়েছেন, জীবনের ছোট ছোট সমস্যা ও সমাধানের বিষয় নিয়ে যে গল্প লেখা হয় তাই ছোটগল্প। জীবনের জটিলতায়, যখন নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে বা সমস্যা নিয়ে গল্প লিখতে লেখককে প্রেরণা দেয় তখনই তা সার্থক ছোটগল্পের রূপরেখা হয়ে দাঁড়ায়।
খরা বইয়ে ১২টি গল্পকে লেখক তাঁর সুনিপুণ তুলিতে রূপায়িত করেছেন এক-একটি চিত্রকর্মে। সহজ সরল শব্দের মজবুত গাঁথুনি, প্রকাশের সাবলীলতা, লেখকের দরদি দৃষ্টিভঙ্গি গল্পগুলোকে করেছে অনবদ্য ও সুখপাঠ্য।
আমার কাছে পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে লেখক গল্পে টান টান উত্তেজনার পরিবর্তে পাঠককে একই গতিতে কোথাও বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে পুরো গল্পে সাবলীল ভ্রমণ করিয়ে শেষে নিয়ে গেছেন। এই বইয়ে তিনি ১২টি গল্পেই সমাজজীবনের, মনস্তাত্ত্বিক যাপনের, বাস্তবমুখী সমস্যা চিহ্নিত করে পাঠকদের ভাবনার খোরাক জুগিয়েছেন।
এই লেখক মার্কিন পাথুরে মাটিতে চাষ করে চলছেন একের পর এক কাব্য-কানন। ভ্রমণ তৃষ্ণায় দেশ থেকে দেশে, ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতার সমাহারে, সৃষ্টিকে করেছেন বিস্তৃত ও পরিপূর্ণ। অভিবাসী জীবনে বিশ্ব মানুষকে খুব কাছ থেকে অবলোকন তাঁর খরা গ্রন্থের গল্পগুলোর উৎস।
ফেরদৌস সাজেদীনের গল্পগ্রন্থ খরার বিষয় মানুষ। চারপাশের পারিপার্শ্বিকতাকে ভেতর থেকে অনুধাবন করার দরদি চোখ রয়েছে তাঁর। জীবনের বাস্তবতা ও গল্পের বাস্তবতা এক নয়। লেখক সেখানে মিশিয়েছেন শিল্পরুচি। শব্দের বুননে শৈল্পিক সত্তার পরিচয়ের সঙ্গে বাক্যগুলোকে করেছেন আকর্ষণীয় ও ইঙ্গিতবাহী। তাই গল্পের কোনো একটি অংশ বাদ দিয়ে পড়লে, পুরো গল্প অধরাই থেকে যাবে।
বইয়ের প্রথম গল্পই ‘খরা’। এই গল্পে আবহমানকাল থেকে বাঙালি নারীদের দমিয়ে রাখার পুরোনো অস্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন লেখক। নিজের অক্ষমতাকে ও ব্যর্থতাকে ধর্মের আভরণে ঢেকে নারীদের দমিয়ে রাখার বাঙালি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে গল্পটি যেন সচেতন একটি প্রতিবাদ।
বইয়ের অন্যরকম একটি গল্প ‘খেলা’ পুরো গল্প জুড়ে, সংলাপে-সংলাপে লেখক এক ধরনের রহস্য সৃষ্টি করে পাঠককে শেষাবধি টেনে নিয়ে গিয়ে সফল সমাপ্তি টেনেছেন।
বিমল ও সুবল দুই ভাই। বিমল বড়, সুবল ছোট। কিশোরগঞ্জ শহরের ‘বসাক অ্যান্ড বসাক হেয়ার কাটিং সেলুনে’র ক্ষৌরকার কাম মালিক। এখানে নিউইয়র্কের জ্যামাইকার বাঙালিপাড়ায় সেই উৎপাটিত সেলুনকে অমর করে রাখতে তারা একই নামে দোকান দিয়েছে, শুধু একটু পরিবর্তন কয়েকটি শব্দের। এখন, বারবারস অ্যান্ড ওনার্স’, আর হেয়ার কাটিং-এর জায়গায় ‘বিউটি’। ব্যস-বসাক অ্যান্ড বসাক বিউটি সেলুন।
দাঁড়িতে চাপা-পড়া ফরসা চামড়ার মুখে লোশন লাগাতে-লাগাতে হঠাৎ বিমল সেই মুখে অনেক দিন আগের একটা মুখ দেখল। অবিকল কাস্টমারের মতো। তবে সে মুখ, মাস্টারের যৌবনের মুখ। বিমল দেখল, পাকুন্দিয়ার বড় দাদাকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে উঠোনে নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলেছে, আর বলছে হালা মালাউনের বাচ্চা, মর। হালা নমশূদ্রের বাইচ্চা, ইন্দুর মর।
[উদ্ধৃত অংশটি, ‘বসাক অ্যান্ড বসাক বিউটি সেলুন’ গল্পের]
আমেরিকার প্রেক্ষাপটে রচিত চমৎকার ১২টি গল্পের প্রতিটি বাক্যই অনিবার্য। প্রতিটি গল্পই মনস্তাত্ত্বিকভাবে পাঠক মনে নাড়া দিতে সক্ষম। আদর্শ ও সুখপাঠ্য গল্পের বই উপহার দেওয়ার জন্য অভিনন্দন লেখক ফেরদৌস সাজেদীনকে।
অন্বয় প্রকাশ থেকে প্রকাশিত, ধ্রুব এষ-এর নজরকাড়া প্রচ্ছদযুক্ত বইটি হোক পাঠকদের ক্ষুধা নিবারণের খোরাক।