নাকফুলের ঝিলিক

গ্রামের নাম সোনাইমুড়ী।
মজিদ শেখ। বাইশ বছরের যুবক। মাকে সঙ্গে নিয়ে থাকে। বাবা মোতালেব শেখের মৃত্যুর পর চৌধুরী সাহেবের জমি চাষ করে সে। একটা ট্রাক্টর আছে। এই গ্রামে সে–ই আধুনিক চাষাবাদ করে। ফসলও ফলে বেশি।
পাশের গ্রামে মায়ের মামার বাড়ি। মা পিঠাপুলি দিয়ে আসতে পাঠিয়েছিল। সেখানে আলপথ দিয়ে আসার সময় জরিনাকে দেখে জলের কলস নিয়ে গোসল করে ফিরতে। উফ! এমন সুন্দর মেয়ে। একটু কথা বলার চেষ্টা করতেই প্রায় পড়িমরি করে বাড়িতে ঢুকে গেল মেয়েটি। সেই থেকে বুকের ভেতর হাজার প্রজাপতি উড়ছে। কানের কাছে ভোমরার গুণগুণ। বাড়ি এসে মাকে জড়িয়ে ধরে।
-আরে ছাড় ছাড় পড়ে যাব তো।
-মা মা।
-অত খুশি ক্যান গো বাজান?
-মা মা আমার কইতর পছন্দ হইসে।
-সে কেমুনগো বাজান?
-তোরে নিয়া যামুনে।
রাতে শুয়ে শুয়ে মন আনচান করে। পরদিন লাল সবুজ রেশমি চুড়ি আর একখান ডুরে শাড়ি নিয়ে আবার যায়। জরিনার বাবার সামনে গিয়ে বলে
-আমার মা পাঠাইছে কাকা।
-তোমার বাপের নাম কি? কোন গেরাম তোমাগো?
-মোতালেব শেখ। সোনাইমুড়ি।
ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন জরিনার বাবা।
-তোমার বাপ আমার দোস্ত ছিল।
-বাপজান মারা গেছে পাঁচ বছর আগে।
-জরিনার মা আমাদের পানি দেও। জরিনা এদিকে আয় মা।
লাল ডুরে শাড়ি দাঁতের নিচে কামড়ে ধরে বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আস্ত একটা লাল মরিচ। টসটসে। হাসলে সাদা দাঁত আর নাকছাবিটা ঝিলিক দেয়।
এই মেয়ের নাম কইতরী। জরিনা না। আমি তোরে কইতরী ডাকুম। ভালো করে দুনয়ন ভরে দেখে। নিচের ঠোঁটের ডানপাশে ছোট একটা তিল। চোখের পাতা তিরতির করে।
-কাকা আমি আসি।
ভরা বর্ষা। বিলের পানি বেড়েছে। করিম মৃধার বাড়ির কাছেই নৌকা ভিড়ল। নৌকায় লাল সবুজ ঝালর বাতাসে উড়ছে। মাইকে গান বাজে। করিম মৃধার বাড়িতে গোলাপি কাগজের ঝালর। দুটো কলা গাছে জরির ঝালরে শুভবিবাহ লেখা। বিয়ে হলো। খাওয়াদাওয়া হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। জরিনাকে নিয়ে নিজ গ্রামে রওনা হলো। জরিনার বাবা কান্না জড়ানো গলায় মেয়েকে ওর হাতে তুলে দিলেন
-গরিব হলেও মেয়ে আমার দুলালী। আদর যত্নে রাখছি বাবা। তুমিও আদরে রাইখো। জরিনার মা কেঁদে কেঁদে ঘাট পর্যন্ত আসে।
বুকের ভেতর সুখপাখি মোচর দেয়। ভালোবাসার গাঙে আকুলী–বিকুলী কর ঢেউ। নৌকায় কইতরীর হাত দুই হাতে নিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। ফুপিয়ে কাঁদে বাপ-মা ছেড়ে আসা দুলালী। লোভীর মতো চেয়ে থাকে সে। খাঁড়া নাকে ওর দেওয়া সাদা পাথরের নাকফুল ঝকমক করে। আধো অন্ধকারেও জ্বলজ্বলে কমনীয় মুখখানা। মাথায় হাত রেখে একবার শুধু কানের কাছে ফিসফিস করে বলে
-আর কান্দিস না বউ। আমার কইতরী।
সে এক স্বপ্নময় রাত।
সামান্য লণ্ঠনের আলোয় ওর ঘর আলো করে বসেছিল জরিনা। লালজরির কারুকার্য করা শাড়ি, অল্পবিস্তর গয়না, চুলে জরির ফিতা আর গায়ে মহুয়ার সুবাস। মাতাল হয়ে যায় মজিদ শেখ, শেখের পোলা। পাহলোয়ান না হলেও শেখের রক্ত শরীরের কোষে কোষে। কালো কয়লার মতো রং গায়ের। পেশি বহুল শরীর। বাইশ বছরের তাগড়া জোয়ান। জরিনাকে বুকে টেনে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে
-আমার কইতরী।
মুখ ঘুরিয়ে আবার দাঁতে আঁচলের কোণ কামড়ে ধরে হাসল জরিনা। এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না মজিদ। বুকের খাঁচায় পুরে একদম নিজের করে নেয়।
-মেয়ে তুই কি? এত রং ঢং জানস?
কেমনে এত ঝিলিক মারস? আমার পরান পাগল হয়্যা যায় রে। শিং মাছের লাখান বুকে ঘাই মারস।
ফরসা সুডৌল হাতে লাল রেশমি চুড়ি আর দুইখান সোনার কঙ্কণ। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলে
-আফনে কি বলেন? আমি আফনারে দুখ দিমু ক্যান?
-তুই আমার কইতরী, তুই না আমার সোনা। আমরা খালি ভালোবাসবো।
শাশুড়ি আর স্বামী। বাড়িঘর গোছানো। টিনের চালা দেওয়া দুইখানা ঘর। ননদ নাই, দেবর নাই। একটু দূরে খড়ের চালা। ওখানেই রান্নাবান্না করার জায়গা। তার পাশে গরুর ঘর। চার পাঁচটা গরু। সামাদ নামের ১৬–১৭ বছরের ছেলে গরু দেখাশোনা করে।
সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি মজিদ শেখের। বাড়ি ফিরে পুকুরে ডুব দিয়ে এসে বসে মায়ের ঘরে। রাতের খাবার খায় তিনজনেই। দুপুরে সামাদের হাতে খাবার পাঠায় জরিনা। পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে পলি পড়ে। চাষ করে রোয়া বুনে দেয়। এ সময়টা খাটনির। বীজ বোনা হয়ে গেলে শুধু দেখাশোনা। এই জমি আধি নিয়েছে ফয়সল চৌধুরীর কাছ থেকে। ধান উঠলে অর্ধেক ফসল দিয়ে আসে চৌধুরীর গোলায়। তারপরও যা থাকে তা দিয়ে ওদের সারা বছরের খাবার আর বিক্রি করে হাতে তবু কিছু টাকা বেঁচে যায়।
মজিদ জরিনাকে বলে
-জানস বউ, আমার স্বপ্ন একদিন এই সব জমি আমার নিজের হবে। সব ধান আমার গোলায় তুলুম।
ঘরে এসে জরিনাকে ডাকে। জরিনা পান নিয়ে ঘরে আসে।
-পান কে খাইবো রে কইতরী?
-ক্যান? আমি আর আফনে।
-আমি পান তামুক খাই না। জানস না বুঝি?
-তয় আমিই খাই।
-তুইওত খাস না। তয় আইজ ক্যান খাস?
-আমার বমি আসতেছে।
-কি কস?
-হ। বলে পান মুখে পুড়ল।
-বউ। কইতরী? জানটা আমার। তুই সত্যি কইরা ক, কি হইসে?
-কিছু না।
-আসেন আপনার হাতে পায়ে তেল দিই।
-উ হু। লাগব না।
-আসেন আসেন। আমি আমার বাপজানরে কত দিসি। কাদায় কাম করলে পা কামড়ায়। এই মেয়ে তো জাদুকরী। মায়ায় আর জাদুতে বশ করে ফেলছে ক্রমাগত। ওর হাতে জাদু, কথায় মায়া, মজিদ ওর মায়াবী বাঁধনে ক্রমশ জড়াতে থাকে।
সেদিন ও ঝিরিঝিরি বাতাসে কাশফুলগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। জরিনা সকালে আধো অন্ধকার থাকতে উঠেছে। গরম খিচুড়ির ঘ্রাণে বাড়ির বাতাস ম ম করছিল। মজিদ হাঁস মুরগির খোপটা খুলে দিল। পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে হাঁসগুলো। জরিনা খুদের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়। মুরগি আর ছানাগুলে দানা খুটে খুঁটে খায়। হাতে কয়লার গুঁড়া নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুরের ঘাটে গেল মজিদ শেখ। সুপারি আর নারিকেল গাছের সারি পুকুর পাড়ে। ঘরের কোণে কলা গাছ। কলার কাদিতে সোনা রং ঠিক যেন জরিনার গায়ের রং। খিচুড়ি খেয়ে খেতের আল ধরে। গামছা নিয়ে ছুটে আসে জরিনা।
-আজ দুপুরে আমি আসুমনে খাবার নিয়া।
-সত্য?
-হেসে গড়িয়ে পড়ে বলে
-সত্যই।
শুঁটকি, কুমড়া দিয়ে চিংড়ি আর কবুতর রান্না করে থালায় সাজিয়ে নিয়ে জমিতে গেল। খাবার নিয়ে বসে মজিদ বউয়ের মুখে তুলে দেয় এক
লোকমা। মজিদ খায় আর জরিনা কথা বলে। সেই ছেলেবেলায় শাপলা তুলতে গিয়ে সাপের কামড় খেতে গিয়ে কেমনে বাঁচল। হঠাৎ কথা থেমে গেল। মাথার ঘোমটা লম্বা করে টানল।
মজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফয়সল চৌধুরীর ছেলে শফিক চৌধুরী। সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু বান্ধব।
-কি মজিদ বিয়ে করছ নাকি?
-জি সাব।
-বউত দেখি এক্কেবারে নায়িকার মতন।
গায়ে আঁচল আরও টেনে নেয় জরিনা। মনে মনে নিজেকে বকে
ইস আজ কেন আমি আসতে গেলাম!!
মজিদ ওদের জমির ধান কেমন হয়েছে দেখাতে নিয়ে যায়।
-মজিদ বিড়ি খাও?
-না সাব আমি বিড়ি খাই না।
অকারণেই ওর হাতে একমুঠো টাকা দিয়ে বলে
-আজ রাতে তোমার বাড়ি আসব। খেতে চাই বুঝলে।
-কি খাইবেন সাব?
ওরা হো হো হাহ হাহ করে অকারণে হেসে একে অন্যের গায়ে হেলে পড়ে।
তিনটা মুরগি জবাই করে রান্না করল জরিনা। ওর শাশুড়ি খিচুড়ি করলেন। রাত নয়টায় ওরা আসলো। উঠোনে বসে খাওয়া দাওয়া হলো। চাঁদ উঠেছে। তারপর ওরা ব্যাগ খুলে বোতল বের করল। মজিদকে খুব যত্ন করে দুই গ্লাসে ঢেলে দিল।
শরবত মনে করে মা আর ছেলে আনন্দে মেতে খেয়ে ফেলল। ঢলে পড়ে মা একদিকে। মজিদের মাথা ঝিমঝিম করে। এইবার জরিনার জন্য এক গ্লাসে ঢেলে ঘরে এসে ঢুকে শফিক চৌধুরী। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। প্রথমেই চিৎকার করে ওঠে জরিনা। জরিনার চিৎকার শুনে ডানা ঝাপটে কবুতরগুলো খোপ থেকে বের হয়ে যায়। কালো হুলোটা ওত পেতে ছিল। ঝাঁপ দিয়ে ধরল সাদা ঝুটিওয়ালা পায়রাটাকে। প্যাঁচার ঝাঁক ডেকে উঠল বাঁশঝাড়ে। রক্তাক্ত নিস্তেজ পড়ে থাকে জরিনা। দরজা খুলে বের হয়ে যায় শফিক চৌধুরী। চোখ মেলে মজিদ বুঝতে চেষ্টা করে কি ঘটেছে। ঘরে উঁকি মেরে দেখে, জরিনার দেহ অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। জরিনার নাকের নাকফুল দ্যুতি ছড়াচ্ছে না।
রান্নাঘরের দাওয়া থেকে বটি তুলে নিয়ে একছুটে গিয়ে পেছন থেকে কোপ মারতে থাকে। শফিক চৌধুরীর মাথা মাটিতে পড়ে যায়।
জরিনার নাকছাবির ঝিলিক চোখ থেকে সরাতেই পারছে না। আর ঠোঁটের নিচে দাঁতে কামড়ে ধরা আঁচল আর সাদা দাঁতের হাসি। ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিল সে জেলের ভেতর। কত দিন? কত দিন তাও মনে পড়ে না। হ্যাঁ আজ একচল্লিশ দিন। ঠিক চল্লিশ দিন আগে চান্নিপসর রাইতে সাদা পাথরের নাকফুলটা আর ঝিলিক দেয় নাই কইতরীর নাকে।