সময়ের প্রথা ভাঙা শিরোপা

পরীক্ষার হলে গার্ড দিচ্ছিলাম। শিক্ষার্থীর পরীক্ষার কাগজে স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখি, একাদশ শ্রেণির একটি মেয়ে লিখে রেখেছে, ‘ফ্রান্স এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত।’ দেখে ব্রম্মতালু জ্বলে গেল। বকা দিতে যাব, ঠিক তখনই কোলরিজের মতো ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গিয়েছিলাম, সেই ৯৪/৯৫ সালে। মনে পড়ে গেল, শিরোপায় একবার সাধারণ জ্ঞানের একটা প্রতিযোগিতা চলছিল। শিবতোষ স্যার খুবই সহজ একটা প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু আমরা সেদিন কেউ ঠিক জবাব দিতে পারিনি। অথচ স্যার একবারের জন্যও তিরস্কার করেননি বা বকা দেননি। কেবল বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে খুব সহজ ব্যাপারগুলো আমরা মিস করে যাই। সেদিন বেশ আত্মগ্লানিতে ভুগেছিলাম। মনে পড়ে, এরপর ভূগোলে কখনো আর কম নম্বর পাইনি, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৮৫ নম্বর পেয়েছিলাম।
শিরোপায় প্রায়ই পড়ালেখার পাশাপাশি এ ধরনের আয়োজন হতো, আমাদের সে কি উৎসাহ! আর কিছু হলো, কি হলো না, স্যার প্রচুর পুরস্কার দিতেন। শিরোপার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আমার এক চাচা হাম্মাদের মাধ্যমে। ওর বাসায় একদিন দেখি ঢাউস একটা ট্রফি, শিরোপার চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, মডেল টেস্টে ফার্স্ট হয়ে ট্রফিখানা বাগিয়ে নিয়েছে। আমার বাসায় অসংখ্য বইয়ের ভিড়ে আজও জ্বলজ্বল করছে ‘নৌকাডুবি’, ‘দেশে বিদেশে’, ‘পারাপার’ ইত্যাদি বই। আমাদের সময় পড়ালেখার ব্যাপারে এসব উৎসাহের প্রচলন কম ছিল। দৃশ্যপট এমন ছিল যে, পড়াশোনাটা একান্ত কর্তব্য কর্ম, সেখানে আবার পুরস্কার-টুরস্কার কি! বোধ করি, স্যারই প্রথম সেই সময়, সময়ের প্রয়োজনে সময়ের প্রথা ভেঙেছিলেন।
আর একদিনের ছোট্ট একটা গল্প বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। দশম শ্রেণির এক আপুকে বেশ জোর গলায় বলেছিলাম, ‘আপনার কথাটা মোটেও ঠিক না।’ স্যার বললেন, বড় বোনের সঙ্গে বুঝি এভাবে কথা বলে? আমি বলেছিলাম, ‘এক বছরের বড়, এইটা একটা বড় হলো স্যার?’ স্যার হেসে বলেছিলেন, একদিনের বড় হলেও বড়। আমি স্যারকে আবার যন্ত্রণা দিয়ে বলেছিলাম, ‘ভুল বললেও কিছু বলা যাবে না, এ কেমন কথা!’ বইয়ের বাইরের এ রকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর স্যার অক্লেশে দিয়ে যেতেন।
এই হচ্ছেন আমাদের শিবতোষ স্যার, এই আমাদের শিরোপা। এত বছর পর আমি আবার শিরোপায় যাচ্ছি, নিয়ম করে যাই অশোকা কুঞ্জে। কারণ আমার মেয়েরা এখন শিরোপায় পড়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এত কিছুর বদল হলো, এতগুলো দিন চলে গেল, শিরোপাও কয়েকবার জায়গা বদল করে চলে এল স্যারের মায়ের নামে বানানো বাড়ি অশোকা কুঞ্জে, কিন্তু বদল হলো না কেবল স্যারের। স্যার সেই আগের মতোই আছেন, আগের মতোই নিজে নিজে সাজেশন বানান, লেকচার শিট তৈরি করেন, আবার আমাদের মতো পুরোনো ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সময় নিয়ে গল্পও করেন।
শিরোপায় গেলে আর একটা জিনিস দেখতে পাই, অনেক ছাত্র আছে বিনা বেতনে পড়ে। এমনকি স্যার এদের বই খাতা, স্কুলের বেতনেরও জোগান দেন। আজকাল স্যার বছরের অর্ধেক সময় আমেরিকার নিউইয়র্কে থাকেন, অর্ধেক সময় বাংলাদেশে কাটান। বাংলাদেশে কাটানো পুরো সময়ই তিনি শিরোপাকে দিয়ে যান অক্লেশে, আর আমেরিকার সময়টুকুতে শিরোপা তাঁর কাঁধে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকে, এত ভালোবাসেন শিরোপাকে!! সেই ১৯৮৪ সাল থেকে আজ অবধি শিরোপা টিকে আছে মাথা উঁচু করে।
‘মহিমা তব উদ্ভাসিত মহা গগন মাঝে’।
১৯৭৬ সাল থেকে স্যার টিউশন দেওয়া শুরু করেন এবং ১৯৮৪ সালে গড়ে তোলেন তাঁর স্বপ্নের টিউশন সেন্টার শিরোপা। ২৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং প্রত্যেকেই ভালোভাবে পাস করেছিলেন। তারপর থেকে একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি শিরোপা। বর্ষপূর্তি, ডিনার, সংবর্ধনা সবকিছু পই পই করে পালন করে শিরোপা। তিনি যখন নিউইয়র্কে থাকেন, তখন শিরোপার দায়িত্বে থাকেন স্যারের একমাত্র মেয়ে ঝুমকি চক্রবর্তী। স্যারের দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে চিকিৎসক, নিউইয়র্কে থাকেন। আরেক ছেলে সেখানে পড়াশোনা করছেন, তাঁর স্ত্রীও নিউইয়র্কে বসবাস করেন। শূন্য থেকে জীবন শুরু করেছিলেন যিনি, তিনি আজ পূর্ব পশ্চিমে বিরাজমান। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা আজ সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, স্যারকে তারা আজও ভালোবাসেন। শিরোপার ৩৫ বছর পূর্তিতে আমি লিখতে পেরে সত্যিই আপ্লুত, অশীতিপর শিরোপাকে দেখার আশা রাখি।
‘যে কাল পেছনে ছিল
সে কাল সমুখে ফিরে আসে
অবগুণ্ঠিত মুখে তারকাখচিত পট্টবাসে’
কলম্বাস, ভাস্কো দা গামা থেকে শুরু করে ব্রিটিশ, ওলন্দাজ কে আসেনি আমাদের পূর্বে, আবার হয়তো পশ্চিমারা পূর্বে পাড়ি জমাবেন আলোকিত জনদের বিচরণ স্থান দেখার জন্য।

লেখক: লেকচারার, ইংরেজি বিভাগ
উইমেন্স মডেল কলেজ, সিলেট