তবু স্বপ্নেরা বেঁচে থাক

শোনা যাক এক এষার কথা। পোশাকি নাম সারোয়াত হোসেন। বরফের ওপর পড়ে হাত ভাঙলেন বলে সেখানে স্বপ্নের সমাধি হয়ে গেল তাতো নয়! ইমিগ্রেশন অফিসের লোভনীয় চাকরিটা বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হলো। দুই বার অস্ত্রোপচারের পরও তাঁর হাত এখনো ভালো হয়নি। ডান হাতে ফ্র্যাকচার নিয়ে ঘরে বসে থাকতে থাকতে এষার মাথায় এল পোশাকের ব্যবসার কথা। সেই ভাবনার পরে কেটে গেছে এক যুগ। এষার ‘নীলাঞ্জনা ফ্যাশন’ হাউসের নাম এখন নিউইয়র্কের ফ্যাশন পিপাসুদের মুখে মুখে। চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৫০০ পিস ড্রেস বানিয়ে এনেছিলেন তিনি। প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গেছে।
এষা জানালেন, তিনি এখান থেকে ডিজাইন তৈরি করে বাংলাদেশে পাঠান। সেখানে তাঁর কারখানায় ডিজাইন অনুযায়ী পোশাক প্রস্তুত করা হয়। গাজীপুর ও উত্তরা মিলিয়ে এষার তিন কারখানায় কাজ করছে ১৯ জন শ্রমিক। জীবন তাঁকে কঠিন অবস্থায় ফেললেও স্বপ্নটাকে মরতে দেননি এষা।
উন্নত দেশে উন্নত জীবনের আশায় আমেরিকায় আসে মানুষ। সেই আশায় ধাক্কা খেতে থাকে জীবনের প্রতি পদে। দেশে থাকতে ছবিতে দামি গাড়ি নিয়ে স্বামীর ছবি দেখেছেন। বাস্তবে দেখা যায়, স্বামী হয়তো ট্যাক্সি কিংবা উবার চালান। তারপর এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি নিয়ে আসা হলো বেসমেন্টের বাসায়, যেখানে ছারপোকা, ইঁদুর, তেলাপোকা নিত্যসঙ্গী। ঢাকায় নিজেদের ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটের জন্য মন কাঁদলেও কিছু করার নেই। এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই। কোনো গৃহকর্মী নেই সাহায্য করার। তদুপরি অনেক সময় অজানা-অচেনা মানুষের সঙ্গে সাবলেট থাকতে হয়। ভাগাভাগি করে নিতে হয় একটা বাথরুম।
এষার মতো কেউ আছেন, যারা সবকিছু গুছিয়ে নেবার পরও হয়তো কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চাকরি করতে পারেন না। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে নানা ভাবে নিজের স্বপ্নকে বিকশিত করা সম্ভব। আবার অনেকের ছোট শিশু থাকার কারণে কাজ করতে পারেন না। শিশুকে বেবি সিটারের কাছে রেখে যাওয়ার সংগতি নেই। তাদের জন্য বাড়িতে বুটিকের ব্যবসা করা একটা ভালো উপায়। অনেক সময় খাবার বানিয়েও দোকানে-রেস্টুরেন্টে সরবরাহ করা যায়। বাসায় বানানো আটা বা চালের রুটি, নানা ধরনের ভর্তা, পিঠা-কেক ক্রেতারা খুব পছন্দ করেন। আগে নিজেকে জানতে হবে, আমার মধ্যে কোনো গুণটা আছে। তারপর সেটাকে বিকশিত করার চেষ্টা করতে হবে। কারণ আমেরিকা হলো ভাগ্যান্বেষীদের দেশ। এখানে যে কেউ নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। বয়স কিংবা সামাজিক অবস্থান কোনো বাধা হতে পারে না।
পড়াশোনা করতে চাইলে অনলাইনে পড়ারও সুযোগ আছে। আবার কলেজে গিয়ে পড়তে চাইলে ছুটির দিনে কিংবা বিকেলে পড়ার সুযোগ আছে। যারা ইংরেজিতে ভালো নন, তাদের জন্য বিনা মূল্যে ইএসএল ক্লাস আছে। কম্পিউটার ক্লাস আছে। এসব করেও যারা নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারছেন না, তারা বেছে নিতে পারেন হোম অ্যাটেন্ডডেন্ট কিংবা বেবি সিটারের চাকরি। এসব কাজের জন্য খুব বেশি মেধা লাগে না।
যেমনটি স্বামী মোহাম্মদ ওমর হোসেন খোকন ও স্ত্রী নাসরিন সুলতানা দুজনে মিলে বাংলা ফ্যাশন হাউস চালান। ব্যাক পেইন সমস্যার কারণে ২০০৮ সালে ওমর হোসেন কাজ ছেড়ে নিজের বাসার লিভিং রুমে পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন। তাঁকে সাহায্য করেন স্ত্রী নাসরিন সুলতানা। এটা তাদের খণ্ডকালীন আয়ের উপায়। শীতকালে নাসরিন হোম অ্যাটেন্ডডেন্ট-এর চাকরি করেন। আগে ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ডে তাদের শো রুম ছিল। এখন সেটা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাসায় যেসব ক্রেতা আসেন, তাদের কাছে কাপড় বিক্রি করেন। অন্য সময় হোম অ্যাটেন্ডডেন্টের কাজ করেন নাসরিন। নিউইয়র্কের ঊর্ধ্বগতির বাসাভাড়া দিয়ে সংসার চালানো তো সহজ ব্যাপার নয়।
বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাংবাদিক—অনেকে এ দেশে এসে ম্যাকডোনাল্ডস কিংবা ডানকিন ডোনাটে সামান্য বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতে মন খারাপের কিছু নেই। আমেরিকায় সব কাজকেই সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। মেধা থাকলে যেকোনো ভালো কাজ পাওয়া সম্ভব। শুধু লক্ষ্যটিকে স্থির রাখতে হয়। পুরোনো জীবনের কথা মনে আসবেই। কিন্তু বেশিক্ষণ অতীতে বাস করলে বর্তমানকেই কেবল তিক্ত করা হয়। ভবিষ্যৎও হয়ে যায় অনিশ্চিত। কাজের মধ্যে থাকলেই মন ভালো থাকে। কড়কড়ে ডলার আয়ের সুযোগ যেখানে আছে, সেখানে কেবল অতীত হাতড়ে ঘরে বসে থাকা কেন!
শুধু যে বাংলাদেশের মানুষ তাতো নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসে মানুষ। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা হতে পারে, কিন্তু সমস্যা অভিন্ন। কথা হলো, কলকাতা থেকে ১৬ বছর আগে আসা মহুয়া সাহার সঙ্গে। বেলরোজে স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে বাস করছেন। ছোট মেয়ের বয়স যখন দুই বছর, তখন ওর একবার খিঁচুনি হয়। তারপর ওর কথা বন্ধ হয়ে যায়। এখন মেয়েটির জন্য বাইরে কোনো কাজ করতে পারেন না মহুয়া। তখন থেকে বাড়িতেই কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলেন তিনি। নিয়মিত মেলায় অংশ নেন। মেলাগুলো সাধারণত ছুটির দিনেই হয়। কখনো স্বামীর কাছে, কখনো বড় মেয়ের কাছে ছোট মেয়েটাকে রেখে সেসব মেলায় অংশ নেন। কলকাতার পার্কস্ট্রিট-গড়িয়াহাট থেকে পণ্য আনেন মহুয়া। মেয়ে বাক প্রতিবন্ধী বলে কেঁদেকেটে নিজের জীবন বরবাদ করেননি, নিজের স্বপ্নকে বিকশিত করেছেন অন্যভাবে। মহুয়া মনে করেন, বুটিকের ব্যবসার যে কাজটি তিনি করছেন, এটাও কম সৃজনশীল নয়!