আমাদের পেনসিল পেনসিলের আমরা

‘সতত হে নদ তুমি
পড়ো মোর মনে’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত টেমস নদীর পাড়ে বসে কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে লিখেছিলেন কবিতা। আমরা যারা হাডসনের পাড়ে থাকি, আমরাও কেউ পদ্মা, কেউ যমুনা, কেউ খোয়াই, কেউ তিতাস, কেউ সুরমার জন্য বিরলে বসে কাঁদি। ইংরেজিতে কথা কথা বলতে বলতে মন ক্লান্ত। মন চায় বাংলায় কথা বলি, বাংলায় হাসি, বাংলায় কাঁদি। পেনসিল-এর দ্বিতীয় জন্মদিন উপলক্ষে আমরা পেনসিলরা মিলেমিশে একাকার হয়েছিলাম বাংলায়। আমরা বাংলায় কথা বলেছি। আমাদের জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি আবেগ অনুভূতি ছিল বাংলায়। ‘পেনসিল’ অনলাইন গ্রুপটি দুই বছর আগে চোখ মেলেছিল। এখন এর সদস্য সংখ্যা ৯৭ হাজার। নিউইয়র্ক এক নির্ঘুম নগরী। এখানে দিনে–রাতে মানুষ কেবলই ছুটছে। কিছুটা অবসর বের করে ‘পেনসিল’-এর কল্যাণে আমরা কিছু ছুটন্ত মানুষ একত্রিত হই ২৯ সেপ্টেম্বর ।
প্রতিটি মানুষ আলাদা সত্তা, কেউ লেখে গল্প, কেউ কবিতা, কেউ আঁকে ছবি, কেউ গান করে, কেউ সাংবাদিক, কেউ চিকিৎসক, কেউ আবৃত্তিকার। সবাই পেনসিল গ্রুপে অবসরে সময় কাটিয়ে আনন্দ বেদনার কাব্য রচনা করে। ‘পেনসিল’-এর শক্তিতে আমরা একত্রিত, গান গেয়ে, কবিতা পড়ে, গল্প বলে আনন্দে সময় কাটালাম ।
গত কয়েক দিনের বৃষ্টি বিধৌত দিনের পর ২৯ সেপ্টেম্বর, মোহময়ী হয়ে উঠেছিল নিউইয়র্কের রোদেলা সকাল। মৃদুমন্দ বাতাস খেলা করছিল। গাছের পাতারা যেন দুলে দুলে গাইছিল শুভ জন্মদিন পেনসিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন, রাস্তা ছিল যানজটমুক্ত। ঠিক ১২টায় নির্দিষ্ট ভেন্যু টক অব দ্য টাউনে ব্রুকলিন থেকে পৌঁছে গেলাম আমি। আমি পৌঁছানোর মিনিট তিনেক আগে পেনসিল–এর শাহীন ভাই ও খাদিজা পারভীন ম্যানহাটন থেকে পৌঁছান। উপস্থিতির দিক থেকে তাঁদের পর আমি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছলাম। ফরিদা ইয়াসমিন তৃতীয়। রওশন চতুর্থ হলেও তৃতীয় স্থানের পর আর কোনো পজিশন দেওয়া হবে না। বেচারি! আমার ভেতরে প্রচণ্ড উত্তেজনা। বেশির ভাগ মানুষকে প্রথম দেখব। অন্তর্জালের জগতে কারও লেখা, কারও গান, কারও কবিতার সঙ্গে চেনা পরিচয় আছে কিন্তু সামনাসামনি দেখা হবে। আমাকে দেখে শাহীন ভাই বললেন, ‘রোমেনা লেইস না? আমার আনন্দ দেখে কে?’ সালেহীন সাজু কবি তিনি তাঁর এই টক অব দ্য টাউন রেস্টুরেন্টকে ‘পেনসিল’-এর সব মিলনমেলার ভেন্যু করতে বললেন। আজ এই আড্ডা আয়োজনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। ‘পেনসিল’-এর জন্য সব সময় উন্মুক্ত থাকবে এই ভেন্যু। কবিদের হৃদয় এ রকমই হয়! ‘পেনসিল’–এর সদস্যদের জন্য ভীষণ গৌরবের বিষয়। জয়তু পেনসিল!
কবি ও লেখক ইশতিয়াক রূপু, মনিজা রহমান এসে আলো ছড়ালেন। পেনসিলের ফরিদা ও শাহেদার স্বামী আমাদের আড্ডায় নূতন মাত্রা যোগ করেন। ডা. সাইমুম, শাবানা, আলম, শাহীন, নাসরীন সুলতানা ও হাসিনা রহমান—সবাই এসে জমজমাট করে তুলেছে আসর। মাসুম ভাই ও হাবীব ফয়েজীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা মহানন্দে সময় কাটালাম। জয়তু মাসুম ও হাবীব, সব গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্য।
সোনিয়া কাদের নিউইয়র্কের স্বনামধন্য সাহিত্যসেবী। আমার আহ্বানে ব্রঙ্কস থেকে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আমরা ধন্য তাঁকে পেয়ে।
জমজমাট আড্ডা, পরিচয়, হইচই, ফটোসেশন সবই চলছে। একটি পেনসিল পরিবার শাহেদা আপার। স্বামী-স্ত্রী সন্তান সবাই মিলে দুর্দান্ত সব কাজ করে এনেছেন ব্যানার, ফটোফ্রেম, বেলুন পোস্টার—সব, সব। ব্যস্ত নগর নিউইয়র্কে সপ্তাহ শুরু হয় সোমবারে ভোর ছয়টায় দৌড়ানোর মধ্য দিয়ে। সকালে কাজে গিয়ে দুপুরে কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে বিকেল। পরদিনের রান্না, রাতের খাবার খেয়ে ঘুম। তার মধ্যে সময় বের করে এত সব করা সোজা ব্যাপার নয়।
আমাদের সবার প্রিয় স্মৃতি ভদ্র আসার পরপরই আমরা পরিচয় পর্ব শেষে জাতীয় সংগীত গেয়ে আয়োজন শুরু করলাম। ফরিদা পারভিন আবৃত্তি করলেন মেঘবালিকা। শম্পা রহমান আপু গান গাইলেন, ‘আমি বাংলার গান গাই’। সঙ্গে সবাই গাইল। আমার মনে হয়, সবার ভেতরে এক ধরনের অনুরাগ বাংলার জন্য। তাই সবাই গলা মিলিয়ে গাইল ওর সঙ্গে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতা আবৃত্তি করলেন সাবিনা ইয়াসমিন। রওশন হক আবৃত্তি করলেন শুভদাশ গুপ্তের কবিতা। আমি আমার ‘প্রবাসী’ কবিতা থেকে পাঠ করলাম। সোনিয়া কাদের, সালেহীন সাজু আর হাবীব ফয়েজী নিজেদের লেখা কবিতা পাঠ করলেন। ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ আবৃত্তি করলেন প্রিয় পেনসিলের শাহেদা আপু। শেখার কোন বয়স নেই। ইচ্ছা থাকলেই শেখা যায়। আর শিক্ষকদের কোনো বয়স নাই। আমরা আমাদের বাচ্চাদের কাছ থেকে শিখি। আপু তার মেয়ের কাছে কবিতা আবৃত্তি শিখে আবৃত্তি করলেন। অনেক সুন্দর হয়েছে।
আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদের আশার আলো। শাহেদা আপার মেয়ে নুসরাত নাবিলা তাবাসসুম কাজী নজরুল ইসলামের ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ আর পেনসিলের ফখরুল ইসলামের ছেলে ফারহান তাহমিদ সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদিনের সারা জীবন’ আবৃত্তি করল। সম্পূর্ণ কবিতা মুখস্থ। কী অনায়াসে আবৃত্তি করল! পেনসিলের সাবিনা ইয়াসমিনের ছেলে সাইয়ান ‘মেঘনা পাড়ের ছেলে’ আবৃত্তি করল। মুগ্ধ আমরা। কাহলিল জীবরানের ‘তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়’—এখানে মিথ্যে হয়ে যায়। আমাদের ভাবনা চিন্তাগুলো কী দারুণভাবে পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরা ধারণ করেছে। ইশতিয়াক রুপু দুটি গল্প শোনালেন। একটি দেশের প্রেক্ষাপটে আর একটি পরবাসী জীবনের। ক্যামেরা নিয়ে দীপ্ত ছিল ছবিয়ালের ভূমিকায়। স্মৃতি ছিল লাইভ সঞ্চালনায়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা পেনসিলরা নিউইয়র্কের পেনসিল-এর জন্মদিন উপলক্ষে মিলনমেলা দেখতে পেয়েছেন। গান গাইল তাহমিনারা আপু। অনেক মিষ্টি তাঁর গলা। শম্পা রহমান গাইল, ‘আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। এক সময় দেখা গেল সবাই গলা মিলিয়েছে। গানের সঙ্গে সঙ্গে মুখরোচক খাবার–দাবারের পাশাপাশি আমাদের আড্ডার মধ্যে দুপুর গড়িয়ে গেল। পেনসিল-এর শুভ কামনা করে, জন্মদিনের কেক কেটে আমরা বের হয়ে এলাম। এ যেন শীতের বিকেল। কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে সূর্য গেল পাটে। আমাদের জন্য বাঁধা সময় শেষ। চা খেতে খেতে আমরা বাইরে বের হয়ে দেখি অদ্ভুত কমলা রং রোদ মেখে সুন্দরী নিউইয়র্ক। আমাদের ফটোসেশন চলল আরও ঘণ্টাখানেক।
সব পাখি ঘরে ফেরে
আমাদেরও ফেরার সময় হলো। আমরা সবার আবার দেখা হবে—এই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ফিরে চলি আপন আপন ঠিকানায়। ফেরার পথে গাড়িতে বসে ভাবছিলাম ‘পেনসিল’-এর অ্যাডমিনদের কথা। এক ‘পেনসিল’-এর কত শক্তি। পৃথিবীর সব প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা লেখক, কবি, ছবিয়াল, আঁকিয়ে, বাচিকশিল্পী—সবাইকে এক প্লাটফরমে একত্রিত করে রঙিন করে তুলেছে আমাদের সময়কে। জীবনের সব রং এক ক্যানভাসে। আমার অবসর বর্ণিল হয়ে ওঠে ‘পেনসিল’-এ। পেনসিল-এর যূথবদ্ধতা দৃঢ় হোক। শুভকামনা সব পেনসিলদের জন্য।
হ্যাপি পেনসিলিং