ঠাট্টা-তিরস্কারে জবাব যেভাবে দেবেন

হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে খেয়ে না-খেয়ে আপনার পরিবারের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে দিন-রাত কতই না চেষ্টা করে যাচ্ছেন আপনি। আপনার ব্যস্ততার কারণে সময় বাঁচাতে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে না পারায় সময়ে-অসময় কিছু লোক আপনাকে অসামাজিকও বলছে। সব-ই মাথা পেতে নিচ্ছেন। কারণ, আপনি মহান। কেমন লাগবে যখন আপনারই স্ত্রী আপনার শ্বশুরবাড়িতে বা পাড়ার অন্যান্য লোকের কাছে আপনার শতসহস্র ক্ষমার অযোগ্য দোষ-ত্রুটি তুলে ধরে নিন্দা-বন্দনা করে? এসব বিষয় নিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ হতে আমি নিজের চোখেই দেখেছি। কারণ এটা সহ্য করার মতো বিষয় নয়।
ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে গিয়ে আপনার স্ত্রীর চক্ষুশূল হয়েছেন। নিজের সঞ্চয়ী হিসাবের সব টাকা খরচ করেও যখন কাজ হয় না, ধার-দেনা করেও ছোট ভাই-বোনদের চাকরি খোঁজার সময় দিচ্ছেন বছর-বছর ধরে। কখনোই বুঝতে দেননি আপনার কষ্ট। কেমন লাগবে যখন ওরা চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আপনারই হাজারো অপারগতা তুলে ধরে ওদের জীবন নষ্ট করার মূলে আপনাকেই দায়ী করে? অনেক মানুষকেই দেখেছি, এসবের পর তারা এতই ভেঙে পড়েন যে, তারা আর কাউকেই কোনো সাহায্য করেন না, আপন ভাই-বোনদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন বা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যান। অনেক বড়, গুণী-জ্ঞানী মানুষকেই দেখেছি, এসব বিষয় নিয়ে থমকে যেতে। হয়তো এসব পরিস্থিতিতেও আপনি স্থির রাখতে পারেন নিজেকে। কারণ আপনি মহানুভব, দয়াবান। কিন্তু আমরা সবাই কি পারছি আপনার মতো হতে?
কীভাবেই পারব বলেন? এখনো পর্যন্ত আমার জানা মতে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে গভীর ও সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসা হচ্ছে মায়ের ভালোবাসা। যে মা তাঁর নিজ সন্তানের জন্য মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যথা সহ্য করে নিজ নাড়ি ভেঙে একটা সন্তানের জন্ম দেন, যে মা তাঁর নিজ সন্তানকে খাওয়াতে নিজের খাবার সন্তানের মুখে তুলে দিয়ে নিজে খেয়েছি বলে মিথ্যা কথা বলে উপোস নির্ঘুম রাত পার করে দেন, সেই মাকেও দেখেছি নিন্দা ও তিরস্কারের মতো হিংস্র হাতিয়ার ঘায়েল করে দেয় সহজে। আর সে ক্ষেত্রে আমরা তো খুবই স্বাভাবিক মানুষ।
আপনি যে ধর্মের মানুষই হোন না কেন, আপনার ধর্ম নিশ্চয়ই আপনাকে এই বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা দিয়েছে, কী করতে হবে এমন পরিস্থিতিতে। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী বলেন বা যিশুখ্রিষ্ট আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনীই বলেন—তাঁরা হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। কিন্তু, আমরা তো কখনোই তাঁদের সমান হতে পারব না।
তবে আমি বলতে চাই, এ রকম ঠাট্টা-উপহাস এবং নিন্দা-বন্দনার পরিস্থিতিতে আমি কী করি। যদি মনে করেন এটা ভালো, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, হয়তো আপনিও জয়ী হবেন, না হলে আমাদের সবাইকে উপদেশ দেবেন।
ক) কেউ আমাকে ঠাট্টা-উপহাস এবং নিন্দা-বন্দনা করলে আমি তা নিয়মিত একটা গোপনীয় ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখি, যে ডায়েরির কথা আমার মা এমনকি আমার স্ত্রীও জানেন না। কোনো এক কথা প্রসঙ্গে গতকাল আমি সেটা বলতে বাধ্য হই আমার ছোট ভাই তনয়কে।
খ) সেই ডায়েরি থেকে যখনই সময় পাই, তখনই চিন্তা করে দেখি তিরস্কার কতটুকু যৌক্তিক। যদি যৌক্তিক মনে হয়, আর নিজের ভুল বুঝতে পারি, নিজে লজ্জিত হই। প্রয়োগক্ষেত্রে ক্ষমা চাই এবং পরবর্তীতে যেভাবে এটা আরও ভালো করতে পারি সেদিকে নজর দিই।
গ) যেসব নিন্দা-বন্দনা মোটেই যৌক্তিক নয় এবং এতে আমি আমার জ্ঞান-বুদ্ধিমতো এর চেয়ে ভালো কিছু করার বিকল্প পাই না, সেগুলো কেটে ফেলি।
ঘ) অপেক্ষা করি অনেক দিন এবং (খ) নম্বরে বর্ণিত তিরস্কারগুলোর পুনরাবৃত্তি না ঘটলে সেগুলো মুছে ফেলি।
ঙ) যদি আমার জ্ঞান-বুদ্ধিতে কোনো তিরস্কারের কারণ বা আমার ভুল বুঝতে না পারি, সেটা রেখে দিই। এ বিষয়ে আরও জানার চেষ্টা করি। অনেক দিন যাওয়ার পরও এ বিষয়ে কিছু না পেলে এবং জানতে গিয়ে কিছু শিখতে পারলে, এটি আমার তালিকা থেকে কেটে ফেলি।
চ) নিজে অনেক সময় অনেক কষ্ট পেলেও কাউকে কিছু বলি না।
ছ) অনেক সময় আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেও সন্তোষজনকভাবে তা পারি না। সেটাই আমাকে কষ্ট দেয়। এখনো এটিকে আরও নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জানি না, তাতে কোনো দিন পুরোপুরি সফল হব কিনা।
জ) যে যা-ই বলুক না কেন, বোকার মতো হলেও মুচকি হাসার চেষ্টা করি।
ঝ) ইদানীং আরেকটা অভ্যাস চর্চা করছি, তা হলো—যে যা-ই বলুক না কেন, তার মতামতের জন্য ধন্যবাদ জানানো। তবে, মাঝে মাঝে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে যাই।
আপনি যদি এই ঠাট্টা-উপহাস এবং নিন্দার সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জয়ী হতে চান, আপনাকে আমি শুধু একটাই পরামর্শ দেব। এই পরামর্শটা এতই সহজ যে, আপনাকে অনেক পয়েন্টও মনে রাখতে হবে না, কোনো সময় বের করতে হবে না, কোনো কিছু শিখতেও হবে না, কোনো কিছু জানতেও হবে না, কোনো কিছু করতেও হবে না, কোনো কিছু বলতেও হবে না, কোনো কিছু এমনকি ভাবতেও হবে না। আর সেটি হলো পরবর্তীতে, এমনকি এখন থেকে যখনই আপনি কোনো ধরনের ঠাট্টা-উপহাস, নিন্দা বা তিরস্কারের সম্মুখীন হবেন, কিছুই করবেন না। এই কিছু না করার মন্ত্রটা আপনার ক্ষেত্রে মহৌষধের মতো কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
আপনি যদি মনে করেন, ডায়েরিতে লিখলে কি লাভ? চলুন, তা হলে দেখা যাক আমার ডায়েরির সারমর্ম; যে ডায়েরিটা আমি লেখা শুরু করি ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমার জন্মদিন থেকে।
ক) মোট ঠাট্টা-উপহাস ও তিরস্কার ৩১০টি
খ) মোট পর্যালোচনা ৩০০টি যার মধ্যে আমার ভুল বুঝতে পারি ২৭৮টিতে এবং আমার ভুল পাইনি ২২টিতে
গ) পর্যালোচনার বাকি ১০টি, এর মধ্যে বুঝতে পারিনি আটটি এবং বাকি দুটিতে এখনো সময় দিইনি।
ঘ) ২৭৮টি ভুলের মধ্যে শুদ্ধ করেছি বা ভালো করার চেষ্টা করেছি মাত্র ২৩০টি
ঙ) ২৭৮টি ভুলের মধ্যে ১২টির জন্য ক্ষমা চেয়েছি। একটি ভুলের মনে হয় ক্ষমার সুযোগ নেই। কারণ উনি আর পৃথিবীতে নাই। ক্ষমা চাইব আরও দুটি ভুলের।
চ) ২৭৮টি ভুলের মধ্যে শুদ্ধ করার চেষ্টায় আছি ১০টি
ছ) বাকিগুলোর জন্য কী করব, এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।
যখনই আমি এগুলোর হিসাব করতাম, আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করতাম, কত ভুল করি আমি! লজ্জা পেতাম, নিজেকে খুবই ছোট মনে হতো, অনেক সময় কান্নায় ভেঙে পড়তাম। তবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম এই ভেবে যে, মানুষ এসব ভুল না ধরে দিলে কি যে হতো!