প্রেম, ভালোবাসা এবং সংসার

প্রেম খুব পবিত্র ব্যাপার, যার দেখা সবাই পায় না। সবার জীবনে ভালোবাসা কমবেশি মেলে, কিন্তু প্রেমের দেখা পায় খুব সৌভাগ্যবান মানুষ। এই প্রেম-ভালোবাসা এমন এক আবেগ ও অনুভূতির নাম, যা কখনো কোনো কিছু দিয়ে আটকানো যায় না। আবার কেউ চাইলেও যেমন ইচ্ছা তেমন দেওয়া যায় না। অবস্থা ভেদে একান্তে দমিয়ে রাখতে গেলেও দেখা যায় মানসিক বিপর্যয়। এ জন্য বোধ করি বলা হয়ে থাকে, মানুষ মাতাল হলে আর প্রেমে পড়লে তা গোপন থাকে না।
ভারতীয় যোগী এবং নিউইয়র্ক টাইমসের লেখক সাধগুরু সত্য ভালোবাসাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে-‘The English expression, “Falling in love” is significant, because no one rises in love or climbs in love. You fall in love, because something of who you are has to go. If not the whole of you, at least a part of you should collapse. Only then there is a love affair. You are willing to destroy a bit of yourself for the sake of the other. It essentially means someone else has become far more important than yourself.’
আমি বলি, প্রেম মূলত একতরফা একটা আবেগ বা অনুভূতি, মানুষ কোন একটা বস্তু বা একজন মানুষকে এককভাবে ভালোবাসে। বস্তুর ক্ষেত্রে বলতে পারি, বস্তুকে ভালোবাসলাম সে বিনিময়ে আমাদের ভালোবাসছে না। যেমন ভোরের সূর্যোদয় দেখলে আমার মনে এমন এক অনুভূতির জন্ম হয় যা অনেকটা সুখানুভূতির মতো। প্রেমিককে দেখলে যেমন কবিতা জাগে, তেমন এক আলোড়ন তৈরি হয় আমার মধ্যে, বিনিময়ে সে কিন্তু আমাকে ভালোবাসছে না। এগুলো যদিও সৃষ্টির প্রতি ঐশ্বরিক প্রেম। তেমন একটা ছেলে হয়তো একটা মেয়েকে ভালোবাসে বা বিপরীতও হতে পারে, মেয়েটা ভালোবাসে। দেখা গেল পক্ষান্তরে এরাও একে অন্যকে ভালোবাসছে না। তার মানে কি এখানে তাদের ক্ষেত্রে ভালো লাগাটা একতরফা। কিন্তু যখন দুটি মানুষের চাহিদা এক হয়, পছন্দ এক হয়—তখন তারা একজন আরেকজনের কাছাকাছি আসে। নানা সমস্যার মধ্যেও একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কখনো সে সম্পর্ক অটুট থাকে, আবার অনেক ক্ষেত্রে ভেঙে যায় বা প্রেম থাকলেও দূরে চলে যেতে হয়। প্রেম নিজেও জানে না, সে ন্যায় করছে না অন্যায়। ভালোবাসা, প্রেম, মায়া, টান—এগুলো কখনোই অন্যায় নয়, কিন্তু অবস্থা ভেদে একে রক্ষা না–করা বা অপব্যবহার করার মাত্রাটা প্রেমের বদনাম করে তোলে।
স্বর্গীয় প্রেমে মানুষ হঠাৎ করেই পড়ে, তাই এ ক্ষেত্রে সে বিবাহিত না অবিবাহিত, কিছুই দেখে না। যদি বিবাহিত হয় তবে তার একটা নাম দেওয়া হয়েছে পরকীয়া। এই পরকীয়া প্রেমকে এক সময় প্রেমের সর্বোচ্চ আসন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখন শব্দটা শোনা, লেখা বা বলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় যায় ভিন্নমাত্রার যোগ। কারণ এখন এটা স্বর্গীয় পর্যায় থেকে নেমে সব দরজা–জানালায় অবস্থান করছে। তাই যেখানে প্রেম নেই, সেখানেও মানুষ প্রেম দেখে। সন্দেহের আগুনে পুড়ছে প্রেমিক হৃদয়, পুড়ছে সংসার। একজন আরেকজনকে সন্দেহ করতে করতে নিজেদের মধ্যে অবশিষ্ট যে ভালোবাসাটুকু ছিল, এক সময় তা চরম দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। সত্যিকার প্রেম কোন শর্ত মানে না, কে একা, কে দু’কা—তা দেখে না। অনেকে জীবন একা কাটিয়ে দেয় কিন্তু প্রেম হয়তো তাকে দেখছেই না। পাতানো কোনো কিছুই কিন্তু আধ্যাত্মিক বা স্বর্গীয় নয়—যেমন অনলাইনে অনেক সুন্দরী বা সুদর্শন বসে আছেন। এখন আমরা যাকেই দেখলাম তাকেই ভালো লাগল—এটা কিন্তু প্রেম নয়। আর এসব জিনিসই কিন্তু আজকাল প্রেমকে বদনামের ভাগীদার করছে বেশি।
অনেক নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা প্রেমকে পুরোনো গয়না বা ফাইলপত্রের মতো অতি যত্নে কোন সিন্দুকে তুলে রাখেন। ইচ্ছা হলে নিজের মতো করে কোন স্মৃতি খুঁজে নেন। এটা কারও একান্ত মানসিক প্রশান্তি। নিজের প্রিয় মানুষটিকে পাওয়ার ইচ্ছা সবারই থাকে, কিন্তু সেটার একটা সীমা আছে। সে সীমা কখনো বয়সের ফ্রেম দ্বারা নির্ধারিত, কখনো বা সামাজিক অবস্থান দ্বারা। জীবন এ রকমই। প্রথম যৌবনের শুরুতে যে প্রেম, সেখানে মানব-মানবীর মধ্যে নিতান্ত নৈমিত্তিক চাওয়াটাই থাকে। জীবনের একটা সময় ভালোবাসা শুধু লালন করতে হয়, বিনিময় চাইতে গেলেই সেখানে উঠে আসে দ্বিধা–দ্বন্দ্ব, সংঘাত, ভাঙন।
উদাহরণ স্বরূপ একটা ঘটনা বলি, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে এক ভদ্রমহিলা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। উনি খুব অশান্তিতে আছেন। আমার পুরোনো লেখা ‘ফেসবুকে সম্পর্ক অতঃপর...’ পড়ে উনি কথা বলতে আগ্রহী হয়েছেন।
১ ঘণ্টা ২০ মিনিট ধরে তাঁর পারিবারিক সমস্যার কথা ধৈর্য সহকারে শুনলাম। সেনা কর্মকর্তা স্বামী তাঁকে খুব নির্যাতন করেন। গরম পানি দিয়ে নাকি তাঁর মুখ পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। বিগত ২২ বছর ধরে নাকি উনি এভাবেই সংসার করছেন। বিশাল কাহিনি। উনি নিজে একজন চিকিৎসক। তবে উনি কৃতজ্ঞ তাঁর স্বামী পৃথিবীর অনেক দেশে তাঁকে বেড়াতে নিয়ে গেছেন বা অন্য সব চাহিদা পূর্ণ করেছেন, করছেন। এমনকি শারীরিক সম্পর্কও নিয়মিত। তবে তাঁদের ঝগড়াঝাঁটির করুন শিকার তাঁর ১০ বছর বয়সী মেয়ে। তাঁকে যে স্বামী মারেন, তা দেখে শিশু মেয়েটিই তাঁকে কোথাও পালিয়ে চলে যেতে বলে। ভদ্রমহিলার ছেলে বড়, কলেজে পড়ে, তবে সে হোস্টেলে থাকে।
সবশেষে বললেন, উনি একজনকে ভালোবাসেন যা তাঁর স্বামী জেনে ফেলেছেন। আমিও চিনি তাঁর প্রেমিক পুরুষকে। কিন্তু নাম বলছিলেন না। ভাবলাম হয়তো কোন সেলিব্রেটি কেউ, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে তো আগ্রহ দেখানো অভদ্রতা, তাই চুপ থাকলাম। আমি যথাযথ পরামর্শ কথা শেষ করলাম। তাঁকে যথেষ্ট খুশি মনে হলো এবং বারবার বললেন, খুব শান্তি পেয়েছেন কথা বলে। কেউ ভালো থাকলে ভালো। তবে দুদিন পর আবারও ফোন দিলেন। তখন বললেন, তাঁর প্রেমিক ভদ্রলোক সম্প্রতি নিউইয়র্কে এসেছেন। আমি কি তাঁর নম্বর দিতে পারব? আমি নড়েচড়ে বসলাম, সম্প্রতি অনেকে এসেছে আমার পরিচিত। মনে মনে বললাম, এই গর্হিত কাজ তো করা যাবে না। এ দেশে এমনিতেই কারও নম্বর না বলে দেওয়া অন্যায়। আমি মুঠোফোন কোম্পানিতে কাজ করেছি, তাই কারও নম্বর অন্যকে দেওয়ার বিপজ্জনক বিষয়গুলো অবগত। সুতরাং প্রশ্নই আসে না। নাম বললে চমকে উঠলাম। কারণ আমি জানি, ওই ব্যক্তি নিরীহ প্রকৃতির মানুষ, পারিবারিকভাবে সুখে-শান্তিতেত সংসার করছেন। ওই ভদ্রমহিলা আমার কাছে জানতে চাইলেন, কথা হয়েছে কিনা? বললাম, নিতান্ত প্রয়োজনে কেউ কথা বললে অবশ্যই বলি। ভদ্রলোক অনেক আগে একবার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আসার সময় কী পরিমাণ ডলার আনা যায়, বিমানবন্দরের নিয়ম–কানুন কী?
আমি নম্বর জানি না শুনে চিৎকার দিয়ে কান্না করছিলেন, কারণ তাঁর এই আশাও মুছে গেছে। তাঁর ধারণা, ভদ্রলোক অন্য কাউকে ভালোবাসেন, তাই তাঁকে ব্লক করে রেখেছেন। তাঁর এই ধারণাটাই তাঁকে রীতিমতো মানসিক রোগী করে তুলেছে। মায়া এবং করুণা দুটোই হলো। তিনি পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের হবেন। ওনার এই অসুস্থ আচরণে সান্ত্বনা দেওয়ার কিছু খুঁজে পেলাম না। বললেন, ‘আমি যেন তাঁর ব্যাপারে একটু কথা বলি। নতুবা তিনি আত্মহত্যা করবেন।’
ব্যাপারটা বেশ বিব্রতকর ও বিপজ্জনক। অনেক ভেবেচিন্তে দুদিন পর তাই ভদ্রলোককে বললাম, একবার যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, কারণ ওই ভদ্র মহিলা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। জবাবে ওই ব্যক্তি যা বললেন তা হুবহু এ রকম—‘কেউ মনে মনে একতরফা আমায় বয়ফ্রেন্ড ভেবে বসে থাকলে, সেটা তার দায়িত্ব। এই মহিলার ফেসবুক আইডি বন্ধ করতে করতে এই পর্যন্ত ৮টা ব্লক করেছি। আবারও নতুন আইডি খোলে। কত আর ব্লক করা যায় বলেন? এই মহিলা আমাকে জ্বালিয়ে মারছে, আবার তাঁর স্বামীও জ্বালাচ্ছে। সেখানে আমার কী করার আছে। আমি তো কাউকে আশা দেখাইনি, এমনকি প্রশ্রয়ও দিইনি। যদি এমন হতো, আমি তাকে স্বপ্ন দেখিয়ে তার কাছ থেকে লাভবান হয়েছি, তাহলে না হয় একটা কথা ছিল। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ একতরফা।’
ওই ভদ্রমহিলা নিজেও বলেছেন, তাঁর স্বামী এই ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। উনি এখানে এসে শান্তিতে নিশ্বাস ফেলেছেন। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন ভুয়া অ্যাকাউন্ট আইডি থেকে। কারণ তাঁরটা ওনার স্বামীর কাছে খোলা থাকে। তিনি ভদ্রলোকের পরিচিত সবার কাছেই এমনভাবে নাকি তাঁকে হেয় করছেন। এটা যে কারও জন্য বিব্রতকর।
যদিও নারী বিষয়ক গতানুগতিক বিষয় নিয়ে খুব একটা লিখি না, তারপরও মাঝেমধ্যে কোন কোন লেখা পড়ে কেউ না কেউ ইনবক্সে এসে বলেছেন, পুরুষ নির্যাতনও হয়। কিন্তু আপনারা শুধু নারীদেরটা দেখেন ও দেখান। কথাটা যে মিথ্যা নয়, সেটা সবার মতো আমিও স্বীকার করি। নির্যাতন সাধারণত দুরকম হয়, শারীরিক ও মানসিক। নারীরা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন বেশি এবং তা অবশ্যই মানসিকভাবেও তাদের আক্রান্ত করে। পুরুষেরা হয়তো শারীরিকভাবে কম নির্যাতিত। কিন্তু মানসিকভাবে কমবেশি অনেকেই আক্রান্ত হন। তার প্রথম ধাপ হচ্ছে সন্দেহ।
এখন নির্যাতনের জন্য সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যা এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। প্রেমিক–প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী কেউ কাউকে ছাড়ছেন না। নিজেদের মধ্যে বজায় থাকলেও কথা ছিল। কিন্তু যখনই তৃতীয় পক্ষের কাছে চলে যাচ্ছে তা মারাত্মক হানিকর হয়ে উঠছে। অনেক স্ত্রীও এমন তৃতীয় পক্ষ অবলম্বন করেন। কিন্তু এটা বোঝেন না, স্বামী বা প্রেমিকের সঙ্গে সঙ্গে যে নিজের আত্মসম্মান বলেও আর কিছু থাকছে না। শাসন করতে হয় নিজের মানুষকে, বাইরের মানুষকে নয়।
পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিকে ফরাসি জাত বড়ই সম্ভ্রমের সঙ্গে মেনে চলে। তাই পরকীয়া প্রেম যতই গভীর হোক না কেন, তারই ফলে যদি কোন পরিবার ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নাগর–নাগরী একে অন্যকে ত্যাগ করেছেন।
এই সংযম হচ্ছে পরকীয়ার আসল সৌন্দর্য। প্রেমের বদনামে পরকীয়া প্রেমকে কলুষিত করুক, আমি তা চাই না। বর্ণনাতীত এই মতবাদের নামটা আমি সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছ থেকে মনে মনে ধার নিয়েছি। এই লাইনগুলোর মালিকও উনি। যদিও এগুলো বহু বছর আগের প্রেক্ষাপটে লেখা। তবে সম্ভ্রম রক্ষা করে চলার প্রয়োজনীয়তা সর্বকালের। আমাদের দেশেও অনেক পরিবার আছে ও থাকা উচিত। মানুষের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অনেক সময় তার অপরাধকেও সুন্দর করে তোলে। প্রেমে পড়া গুনাহ নয়। নিজের মনের সব প্রশ্ন সে হোক প্রেম বা সন্দেহ—তা বিস্তৃত বা প্রকাশ করার আগে ভাবুন কতটা উচিত।