শিশুদের ভালোবাসা

নিউইয়র্কে আমি যে এলাকায় থাকি, সেখানে আশপাশে কোনো বাংলাদেশি নেই। মূল সড়কের দিকে যাওয়ার পথে ঢালু যে রাস্তাটি নেমে গিয়েছে, সেদিকটায় একটি ভারতীয় পরিবার আছে। বাদ বাকি প্রতিবেশীদের সবাই চীনা। দীর্ঘ ১৮ বছর যাবৎ একই এলাকায় বসবাসের সুবাদে প্রতিবেশীদের সবার সঙ্গে সবার বেশ সখ্য। পাশের বাসার মিস্টার চাও মাঝে মাঝেই ঝকঝকে হাসি হেসে বলে উঠেন, তোমার ছেলেরা সেই দিন না জন্মাল, কত দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে! ওপর তলার মিস্টার চেং ইংরেজি জানেন না। ইশারায় দেখাযন, এতটুকু শিশুরা এত বড় হয়ে গেল!
আমাকে দিনে একাধিকবার ছেলেদের নিয়ে বাইরে বের হতে হয়—বিশেষ করে স্কুলে, কোচিংয়ে বা মসজিদে যেতে হয়। তাই সবচেয়ে বেশি দেখা হয়ে যায় মিস্টার ফেংয়ের সঙ্গে। কেননা মিস্টার ফেং আর আমার গ্যারেজ একই দিকে। বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি। ছেলেদের নিয়ে বাড়ির পাশের মাঠে খেলা করা দেখে খুব দুঃখের সঙ্গে একদিন জানালেন, নিজের ফেলে আসা সময়ের ভুল–ত্রুটির কথা। কর্মব্যস্ততায় কেমন করে যে যাপিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, টেরই পায়নি। ভেবেছিলেন সন্তানদের দেখভালের জন্য ওদের মা তো আছেই সার্বক্ষণিক। দিনভর ব্যস্ততা শেষে রাতে বাড়ি ফিরে ওঁদের ঘুমে দেখা যেত। সকালে ঘুম ভেঙে দেখত ওরা স্কুলে। এখন একজন পড়ছে অন্য রাজ্যে, আরেকজন চাকরি করছে। অখণ্ড অবসর, তাই সন্তানদের মা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। বললেন, ‘শূন্য ঘরে অন্ধকার হাতড়ে বাতি জ্বালাই যখন, ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। সন্তানদের খুব মিস করি, বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হয়। ওদের সেই অর্থে সময় দেওয়া হয়নি কোনো দিন। একটু গুছিয়ে ওঠার আগেই সময় এত দ্রুত চলে গেল!’
অতঃপর পাশ দিয়ে লং আইল্যান্ডের দিকে ছুটে চলা ট্রেনের হিস হিস শব্দে ক্ষণিক থামলেন। আমি ব্যস্ততার অজুহাতে শিশুদের ছুড়ে মারা বল আনার ছলে মাঠের অন্যপ্রান্তের দিকে ছুটি। কেননা, মানুষের এসব বেদনা আমার ভেতরেও সংক্রমিত হয়। ভেতরটা আর্দ্র করে তোলে। মাঝে মাঝে কুইন্স মলের পাশের পার্কে যাই ছেলেকে নিয়ে। পার্কের বাইরের প্রশস্ত ফুটপাত দিয়ে নিয়ম করে হাঁটেন একজন বাংলাদেশি আপু। তিনি ডায়াবেটিসের সমস্যায় ভুগছেন বলে মনে হয়। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হলে ভেতরে বেঞ্চিতে এসে বসেন। ক্ষণিক জিরিয়ে নেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানালেন দুই মেয়ের কথা। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা স্বামীর সংসারে ভালো আছে। কিন্তু ভালো নেই তিনি। আমি বিস্ময়ে তাকাই। বললেন, মেয়েরা যখন ছোট ছিল, মায়ের হাতের এটা-সেটা খেতে আবদার করত। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতেন, আজ পারব না, অন্যদিন বানিয়ে খাওয়াব। গায়ে জড়ানো ওড়নায় চোখ মুছে বলেন, ‘জানো, মেয়েদের পছন্দের ওই সব খাবার আমারও পছন্দের। কিন্তু এখন আর সেসব খাবার গলা দিয়ে নামতে চায় না, তাই বানাই না। খুব মনে পড়ে ওদের চাওয়াগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সময়ের কথা। যদি জীবনটা পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া যেত, আমি আমার সন্তানদের ছোট ছোট আবদারগুলো পূর্ণ করতাম।’
জীবন চলার পথে এমন কত টুকরো টুকরো ঘটনার মুখোমুখি হই! অগ্রজদের থেকে কত কী শিখি! তাঁদের যাপিত জীবনের ভুল থেকে শিখি, হাহাকার থেকে শিখি। সময় থাকতেই সংশোধন হতে শিখি। আর তাই তো একদিন ছোট ছেলে রিহান তাঁর শিক্ষক আংকেলের বাসায় ডালের পিঁয়াজি খেয়ে এসে দুচোখ গোলাকৃতি করে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে যখন বলল, ‘বিলিভ মি আম্মু, আই অ্যাম নট লাইইং, রিয়েলি পেঁয়াজু অনেক মজা!’ আর অমনি পরদিনই আমি পেঁয়াজু বানিয়ে তাঁর সামনে পরিবেশন করি। সে খুশিতে জড়িয়ে ধরে। আমার কোনো দিন বলা হয় না, আজ পারব না, কাল বা পরশু বানিয়ে খাওয়াব। বড় ছেলের পছন্দের খাবার যখন কিনে আনি, কিংবা বানিয়ে দিই, ঠিক একইভাবে সেও খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানায়। জড়িয়ে ধরে। এই নির্ভেজাল ভালোবাসাটুকু পেতে আমি শত ব্যস্ততার মাঝেও ক্লান্তি ভুলে যাই, বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভুলে যাই। ওঁদের নিয়ে মেতে থাকি। যেন কোনো দিন আত্মজদের ছোট ছোট চাওয়াগুলো পূর্ণ করতে না পারার অতৃপ্তি কিংবা অপরাধবোধ পেয়ে না বসে।
বছর তিনেক আগে ছোট ছেলে রিহান সবে কিন্ডারগার্টেনে পড়ছিল। রোজ ভোরে স্কুলের ফটকে ঢোকার ঠিক আগে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকাত। আমি কাছে টেনে আদর দিয়ে যেই না বিদায় নিতে চাইতাম, অমনি অশ্রুজলে বুক ভেসে যেত তাঁর। ছোট্ট হাতের শক্ত মুঠিতে আমার জ্যাকেটের কোনা ধরে রাখত। সেই সময় স্কুল ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা মেলানি এগিয়ে আসত। ইউনিফর্ম পরিহিতা তরুণী মেলানি স্কুলের ফটকে দাঁড়িয়ে স্কুল সেফটি এজেন্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন। রোজ সকালে স্কুলের ফটকে হাসিমুখে শিশুদের সাদর সম্ভাষণ জানাতেন তিনি। আমাদের মা-ছেলের এই সাময়িক বেদনাবিধুর বিচ্ছেদের সময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতেন মেলানি। গভীর মমতায় রিহানকে বুকে টেনে নিতেন। অতঃপর কী সব বলে বুঝিয়ে ভেতরে নিয়ে যেতেন।
তিন বছর বাদে রিহান এখন থার্ড গ্রেডে পড়ছে। কিন্তু আজও রোজ ভোরে স্কুলে ঢোকার ঠিক আগে মেলানিকে জড়িয়ে ধরে। ভরদুপুরে স্কুল শেষে সব শিশু যখন বাবা-মায়ের হাত ধরে ললিপপ কিংবা আইসক্রিম কিনতে ছুটে যায় বাইরে, সেই সময়ে রিহান আমার হাত ছেড়ে ছুটে যায় মেলানির দিকে। ওরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে, গুডবাই বলে বিদায় দেয়। আমি বাড়ি ফেরার পথের দিকে যেতে যেতে জানতে চাই,—তুমি মেলানিকে পছন্দ করো? রিহান হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায়। শেষে মুখ তুলে তাকায়। প্রেজেন্ট টেন্স, পাস্ট টেন্স গুলিয়ে বলে,—‘হোয়েন আই ওয়াজ লিটল, আমি স্কুলে তোমাকে মিস করি। লোনলি ফিল করি। দ্যাট টাইম মেলানি আমাকে এত্তগুলো লাভ করে।’
ছোট্ট রিহান হয়তো তাঁর অনুভূতির সবটুকু বুঝিয়ে বলতে পারেনি কিংবা প্রকাশ করতে পারেনি। কিন্তু তাঁর চোখে–মুখে মেলানির প্রতি অগাধ কৃতজ্ঞতাবোধ বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি। বিশ্বাস করুন, শিশুরা ভালোবাসা পেলে কয়েকগুণ বেশি ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়, সম্মান জানায়। সে ভালোবাসা খুব নির্ভেজাল, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।