নিবারণের মা

ছেলেবেলায় আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। এই কথাটিতে কোনো বিশেষত্ব নেই । শৈশবে সব ছেলেরাই দুরন্ত থাকে। তবে আমার দুরন্তপনার জন্য অনেককেই অযথা অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে, সে কথা ভেবে খুব কষ্ট হয় আমার। আমরা থাকতাম চট্টগ্রাম চন্দনপুরা কলেজ কলোনির ১৪৩ নম্বর বাড়িতে। আমার বাবা চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সেই সুবাদে সিনিয়র শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ সরকারি কলোনির একটি তিন বেডরুমের বাড়িতে আমার শৈশব–কৈশোর কেটেছিল। সমবয়সী বন্ধু–বান্ধবীতে ভরা ছিল কলোনির জীবন। আধবেলা স্কুল শেষ করে মার্বেল খেলা, দুপুর না গড়াতেই ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো আর শেষ বিকেলে মেয়েদের সঙ্গে ‘ছি বুড়ি’ খেলা! এই ছিল আমাদের দৈনিক রুটিন। একবার এক মেয়ের ফ্রকের ভেতরে ‘বিছুটি পাতা’ ঢুকিয়ে দিয়েই দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেই মেয়েটি আজ অবধি আমার সঙ্গে কথা বলে না। ক্রিকেট বলের আঘাতে কলোনির কত বাড়ির কাচের জানালা যে ভেঙেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। একদিন পোস্টমাস্টার কাকু যথারীতি চিঠি বিলি না করে সোজা আমার বাবার কাছে চলে গেলেন; কারণ তাঁর কাছে নিশ্চিত প্রমাণ ছিল সাইকেলের পেছনে বাঁধা সবগুলো চিঠির বিদেশি স্ট্যাম্প আমি চুরি করেছি। এমন কিছু একটা ঘটবে, আমি তা আগে থেকে টের পেয়েছিলাম। সে সময় আমাদের কোনো দেয়াল ঘড়ি ছিল না। সবকিছুই চলতো মসজিদের মাইকে আজানের ধ্বনিতে। মাগরিবের আজান পেরিয়ে সেদিন আকাশ ঘন অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল, আমি মায়ের কড়া আদেশ অমান্য করে তখনো বাড়ির বাইরে ছিলাম । আমি জানতাম আজ বাড়িতে আমার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে । আমি ভয়ে কাতর হয়ে কলোনির রাস্তার ওপারে পোড়ো মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এমনিতে দিনের বেলাতেও আমরা ওই মন্দিরে যেতে ভয় পেতাম; সেদিন আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। হঠাৎ দেখি প্রাত্যহিক পুজা শেষ করে এক প্যাঁচে সাদা পাতলা সুতির কাপড় পরা নিবারণের মা বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে আমি হাউ হাউ করে কেঁদে দিলাম। তিনি আমাকে যথাসম্ভব অভয় দিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলেন ।
ডাকটিকিট সামান্য হতে পারে কিন্তু চুরি করার ব্যাপারটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আমি এখন খুব বুঝি, সেদিন পোস্টমাস্টার কাকুর সামনে বাবা খুবই অপমানিত বোধ করেছিলেন। নিবারণের মাকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে বাবা আমাকে বেদম প্রহার করেছিলেন। খুব মনে আছে আমাকে চড় থাপ্পড়ের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে এই পঞ্চাশোর্ধ্ব ভদ্রমহিলাও সেদিন আঘাত পেয়েছিলেন। জন্মের পর থেকেই নিবারণের মাকে আমি দেখে এসেছি । মহিলাদের যেমন প্রতিটি শাড়ির পেছনে একটি অ-বলা গল্প থাকে তেমনি আমার পিঠে অনেকগুলো ক্ষতের দাগ আছে; সে দাগের সবকটি গল্প নিবারণের মায়ের জানা ছিল।
ইদানীংকালের কথা বাদ দিলে আমি আমার মাকে মায়ের চাইতেও আমি বেশি পেয়েছি চশমাপরা স্কুলশিক্ষক হিসেবে। ঘুম থেকে উঠে তিনি স্কুলে ছুটতেন, আমরা দুই ভাইবোন থাকতাম নিবারণের মায়ের কাছে। বাবা একবার বেরোলে রাতে কখন বাড়ি ফিরতেন আমি জানতাম না । মা অবশ্য স্কুল শেষে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শুরুতে ফিরে আসতেন। এভাবে যে যার সময়ে ফিরে আসত কিন্তু নিবারণ আর কোনো দিন বাড়ি ফিরে আসেনি। আমরা কেউ জানতাম না সে কি পানিতে ডুবে না যক্ষ্মায় মারা গেছে। নিবারণের মাকেও কোনো দিন ছেলেকে নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। তিনি বরাবরই নীরব ও নিভৃত ছিলেন। আপন মনে আজানের শব্দ ধরে সংসারের মুখস্থ কাজ শেষ করে ঠিক এশার আগে একচালা ঘরে চলে যেতেন। পোড়ো মন্দিরের পেছনে ছিল তাঁর ঘরটি। দুপুরে ছাদে ভেজা কাঁথা কম্বল, জামাকাপড়, তোয়ালে ইত্যাদি রোদে উল্টে পাল্টে দিতেন। গোসলের পর আমার মাথায় নারকেল তেল মেখে চুল আঁচড়ে দিতেন। তারপর কাঁসার বাসনে কই মাছের কাঁটা বেছে ভাতের সঙ্গে ঝোল আর আলু ভর্তা মেখে ছোট ছোট ‘ভাতবল’বানিয়ে দিতেন। আমার এখনো মনে আছে, ভাত বলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। প্রথমটার নাম নীলকমল, পরেরটি নীল কমলের বড় দা লালকমল। তারপরেরটা প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা। সে রাজার এক অপরূপা রাজকন্যা আছে এবং অবধারিতভাবে শেষ ভাতবলটি হতো সেই রাজকন্যার নামে। কোনো দিন ওর নাম হতো মাধুরীলতা কোনো দিন কাঞ্চনমালা। শেষ বলটা খেয়ে ফেলা মানেই রাজকন্যার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া।
একবার বাড়িতে বাবার একজন ছাত্র আমার সমবয়সী এক ছেলেকে বেড়াতে নিয়ে এলেন । তখন বিকেল, আসরের আজান হয়েছে। বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তিতাস, ওর নাম আবীর। ওর বাবা মা নেই । আজ থেকে তুমি আর আবীর, তোমরা বন্ধু হলে। যাও, ওকে নিয়ে মাঠে খেলাধুলা করে আস।’ আমি আবীরের হাত ধরলাম। ও একটু ইতস্তত করছিল। মাঠে যাওয়ার আগে আমি অবাক বিস্ময়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওর কি একটা নিবারণের মা ও নাই?’
পাড়ার সবাই তাঁকে ‘নিবারণের মা’ বলেই ডাকতো । এত দিন পরে আমি ভাবছি, অন্তত আমরা বাড়িতে ভাইবোন তাঁকে শ্রদ্ধা করে মাসি, দিদা এমন কত নামেই তো ডাকতে পারতাম! কেন জানি না, তা হয়নি। আসলে তিনি এমন যে তাঁকে আমাদের কখনো কোনো নামে ডাকতে হয়নি । তাঁকে ডাকার প্রয়োজন হওয়ার আগেই তিনি আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হতেন। তবে মনে আছে, কলোনির অনেকে আমাদের অন্দর মহলে একজন হিন্দু মহিলার আসা–যাওয়া, তার হাতের রান্নাবান্না সহজভাবে নিতে পারতেন না। মাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, ‘আমি হিন্দু-মুসলমান চিনি না। আমার ঘরে যাঁরা আসেন, আমি বিশ্বাস করি তাঁরা প্রত্যেকেই ভালো মানুষ। এই নিবারণের মা ছাড়া আমার পক্ষে স্কুল কলেজের চাকরি করে তিয়াসা, তিতাসকে বড় করা সম্ভব ছিল না। নিবারণের মা ছিল বলেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ওযুর পানিটা সবসময় হাতের কাছে পেয়েছি ।’
এরপর কখন যে কী হলো আমরা কিছুই জানলাম না। একদিন মায়ের কাছে শুনলাম বাবার চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে। আমরা চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যাব। সেটা ছিল ১৯৭৬ সাল। ফজরের আজানের পর আমাদের মালপত্র সব ট্রাকে তোলা শুরু হয়েছে। অবশ্য এর কিছুদিন আগ থেকে আমরা এ বাড়ি ও বাড়ি বিদায়ী ভোজ খেয়েছি। আমাদের সাহায্য করার জন্য কলোনির সবাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এসব বিদায় যজ্ঞেও নিবারণের মা ধীরস্থির, তাঁর নিয়মিত কাজ করে যান। আছরের আজান হলো। আমাদের গোছগাছ, বাঁধাসাজা চূড়ান্ত হয়েছে । আমাদের দু’জনকে কাপে করে দুধ ঢেলে দিলেন নিবারণের মা। আমার জন্য আলাদা করে দুধের সর তোলা থাকে সেখানে খানিকটা চিনি ছিটিয়ে দিলেন। চলে যাওয়ার আগে সবাই আমাকে গাল টিপে টিপে আদর করছে। আমি ভীষণ উত্তেজনায় দুধ কিংবা সর কিছুই খেতে পারছিলাম না । আমি ঢাকায় যাচ্ছি, সেখানে আমার নতুন স্কুল হবে। শুনেছি, ঢাকার স্কুল বাড়ি থেকে বেশ দূরে হয়, পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। আমি প্রতিদিন দু বেলা রিকশা চড়তে পারব, আমাদের ঢাকার বাসাতে একটা টেলিভিশন কেনা হবে......। এত সবের ভেতরে নিবারণের মায়ের কথা মনেই ছিল না। তা ছাড়া ওঁনাকে পরিবারের বাইরের কেউ ভাবার কোনো কারণ ছিল না আমার । ঠিক সেই মুহূর্তে মা এসে বললেন, ‘পায়ে হাত ছুঁইয়ে নিবারণের মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নাও। মাগরিবের নামাজ পড়ে আমরা তোমাদের নানার বাড়ি যাব। সেখান থেকে ভোরে ফজরের নামাজের পরে আমাদের ট্রেন স্টেশনে যেতে হবে।’
সন্ধ্যা ঢলে পড়েছে । শৈশবের চিরচেনা চন্দনপুরা কলেজ কলোনি ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি । রিকশার পাদানিতে টুকটাক ছোট কয়েকটি ব্যাগ। বাবা রিকশাচালককে একটু সাবধানে চালাতে বললেন । রিকশাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার এপারে বাড়ির সামনের পোড়ো মন্দিরটাকে ঘন কালো দেখাচ্ছে। আমার সেই ভয়ার্ত রাতের কথা মনে পড়ল । যে রাতে এই মন্দির ছাড়া আমার আর কোথাও কোনো আশ্রয় ছিল না । আমাদের রিকশা ডানে মোড় নেওয়ার আগে আমি শেষবারের মতো মন্দিরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলাম । সেখানে একটি মৃদু প্রদীপের আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না ।
এইতো আমি! আমার ডানপাশে দিনে পাঁচবার আজানের ধ্বনি অন্যপাশে পুজোর প্রদীপ হাতে সার্বক্ষণিকের জন্য নিবারণের মা। কী আমার শৈশব! কী আমার কৈশোর! আমি বেড়ে উঠেছি দু পাশের এই দুই অপূর্ব বৈভব আর বিত্তের ভেতর দিয়ে। বড় হয়ে আমি আর নতুন কোনো ধর্মজ্ঞান অর্জন করিনি। হয়তো আমি ধর্মযাজক হতে পারিনি, তবে আমি অন্ধ নই।