সুরমা পারের দাপুটে সাধক

বিদিত লাল দাস
বিদিত লাল দাস

চমৎকার শীতের সন্ধ্যা। আলোকিত মঞ্চ। বসে আছেন সিলেট অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সব শিল্পীরা। গাইবেন শফিক উন নুর। গাইবেন শাহ বাদুল করিম, রুহি ঠাকুর। লোকে লোকারণ্য মাঠ।
আগেই সিদ্ধান্ত হলো, নাগরিক দাপটের মাঝে স্বাধীন বাংলাদেশে লোকগান আর গ্রাম বাংলার গানকে যিনি মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি গাইবেন। বিদিত লাল দাস। পরে গাইবেন একই ঘরানার পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বল শিল্পী জামাল উদ্দিন হাসান বান্না।
বাংলার লোকগানের সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের ছেলে মোস্তফা জামান আব্বাসী মঞ্চে। পাশেই সিলেটি কন্যা আসমা আব্বাসী। লোকারণ্য সিলেট স্টেডিয়াম সংলগ্ন মাঠ। সারা রাত গান চলবে। যে বাউলরা গ্রামে-গঞ্জে গেয়ে বেড়ান, তাঁরা গাইবেন নাগরিক মঞ্চে। আমেরিকা থেকে রোটারি ক্লাবের একদল লোক তখন সিলেট পরিদর্শন করছেন। তারাও উপস্থিত বাংলার লোকগানের উন্মাদনা দেখতে।
বিদিত লাল দাস তাঁর বন্দনা সংগীত দিয়ে শুরু করলেন। গেয়ে উঠলেন, সিলেট প্রথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়েছে…। গলা উঠছে ওপরে, পাশে দাঁড়িয়ে একবার বিমোহিত জনতাকে দেখছি। ফিরে দেখছি বিদিত লাল দাস, আমাদের পটল দা’র চোখ বন্ধ। তিনি গাইছেন, না প্রার্থনা করছেন—বোঝা মুশকিল।
মুহূর্তেই পাল্টে যায় সব। একদল উন্মত্ত লোকের অতর্কিত হামলা। বৃষ্টির মতো পাথর ছোড়া হচ্ছে। তখন মৌলবাদীদের উর্বর সময়। বিপদ টের পাই। বিদিত লাল দাসকে আগলে রাখেন বান্না। আমি ব্যস্ত মোস্তফা জামান আব্বাসী আর আসমা আব্বাসীকে নিরাপদ স্থানে নিতে ব্যস্ত। এমন সময় আস্ত একটা ইট এসে পড়ে আমার মুখ বরাবর। দ্রুত রক্তাক্ত হয়ে উঠে মঞ্চ।
আহত হয়ে আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়। কাটা জায়গায় সেলাই করে দিলেন চিকিৎসক। একটি দাঁতের অর্ধেক ভেঙে গেছে। দন্ত চিকিৎসক জানালেন, তেমন কিছু হয়নি, শক্ত ইট সরাসরি মাথায় আঘাত করলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত। ভাঙা দাঁতে জিহ্বা লাগলেই মুহূর্তটির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বিদিত লাল দাস চোখ বন্ধ করে গাইছেন। শরীর কাঁপছে, মাথা দুলছে সুর আর তালের সঙ্গে।
পরদিন বিদিত লাল দাস বললেন, ‘বাংলা সংস্কৃতির ওপর যাদের ক্ষোভ, তারাই কখনো ধর্মের নামে, কখনো অন্য কোনো অজুহাতে এমন হামলা বহুবার চালিয়েছে। এমন হামলা আর হুমকির মুখেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে।’
বিদিত লাল দাস সংস্কৃতির কোনো উদ্বাস্তু মহাজন ছিলেন না। তিনি ছিলেন এর ধারক। ভেসে আসা তস্করদের আমরা দেখি কেউ রাজনীতির কাঠি ধরে, কেউ সংস্কৃতির কাঠি ধরে অস্তিত্ব প্রকাশ করতে চায়।
হামলার পরদিন স্টেডিয়াম চত্বরে এক কুঁজো বিপ্লবী বললেন, তাদের না জানিয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য এমনটি হয়েছে। আরেক উদ্বাস্তু সংস্কৃতি মহাজন মনে হলো খুশিই হয়েছেন। তাকে অনুষ্ঠানে যুক্ত না করার কারণেই অনুষ্ঠান পণ্ড হয়েছে, এমন ভাব প্রকাশ করলেন।
বিদিত লাল দাসকে আমরা ‘পটল দা’ হিসেবেই ডাকতাম। তাঁর কাছে এসব জানালে, কিছুই বললেন না। শুধু হাসলেন। কিছুদিন পর বিদেশে চলে আসি। বিদিত লাল দাসের কণ্ঠ আর শোনা হয়নি। ২০১২ সালের ৮ অক্টোবর তাঁর কণ্ঠ চিরদিনের মতোই স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। তাঁর মৃত্যু দিবসটি পালনের উদ্যোগ কেউ নিয়েছে কি না, জানি না। অনলাইনে পত্রপত্রিকা ঘেঁটে কোনো খোঁজ না পাওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বিদিত লাল দাস ভেসে আসা কোনো সাংস্কৃতিক কর্মী ছিলেন না। সম্ভ্রান্ত জমিদার লাল পরিবারে তাঁর জন্ম। তার দাদা বঙ্ক বিহারি দাস ছিলেন জমিদার। তাঁর বাবা বিনোদ লাল দাস ছিলেন আসাম সংসদের সংসদ সদস্য। নিরহংকার জীবনযাপন ছিল তাঁর। বিদিত লাল দাস কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, তা নিয়ে আলোচনার যোগ্য লোক যারা, তারা করতে পারবেন। এ আমার কর্ম নয়।
ষাটের দশক থেকে এই শিল্পী গেয়েছেন। নিজের আত্মপরিচয় ধারণ করেই মঞ্চ আলোকিত করে গেছেন। মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদুধন’, ‘সিলেট প্রথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়াছে’...এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের সুরকার বিদিত লাল দাস।
হাসন রাজা, রাধারমণ, গিয়াস উদ্দিনসহ অনেক গীতিকারের গানে তিনি সুর করেন। নাটক ও নৃত্যনাট্যের সংগীত পরিচালনাও করেছেন তিনি। লোকসংগীতকে জনপ্রিয় করতে তাঁর ভূমিকা অতুলনীয়। সরকারি–বেসরকারিভাবে দেশের বাইরে গেছেন বাংলার লোকগান নিয়ে। দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার, সংবর্ধনা ও সম্মাননা লাভ করেছেন।
চলনে–বলনে আভিজাত্য ছিল বিদিত লাল দাসের। আমরা যারা রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছি নানা সময়, তাদের অনেক ঋণ। অনেক না জানা কথা আছে পটল দা’কে নিয়ে। আমরা যখন ছাত্র সংগঠনের কর্মী, সাংগঠনিক কাজে চাঁদা ওঠাই। সিলেটে আমাদের ৫০০ টাকার চাঁদা পটল দা–ই দিতেন! সেই আশির দশক থেকে তাঁর কাছ থেকে চাঁদা আনতে যেতাম। গিয়েছি প্রবাসী হওয়ার আগ পর্যন্ত । কোনো দিন খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। আমি জানি, আমাদের সমসাময়িক প্রায় সবার সাংগঠনিক কাজের নীরব সহযোগিতা দিয়ে যেতেন তিনি। গেলেই আপ্যায়ন করাতেন। সদা হাস্য পটল দা, তাঁর লাল কুটি অফিসে বা বাসায় আমাদের বসতে দিয়েছেন। বয়সের ফারাক ভুলে গিয়ে আড্ডায় মেতেছেন। বিনয় দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, আমাদের ঋণী করে গেছেন।
৮ অক্টোবর মৃত্যুর দিনে দূর দেশে বসে স্মরণ করছি সময়ের ভাবুক রাজা, সুরের রাজা, শুদ্ধ সংগীত আর লোকজ উপাদান নিয়ে যিনি দাপট দেখিয়ে গেছেন সে পটল দা’কে। গ্রামে–গঞ্জের লোকজ উপাদানকে তিনি ধারণ করেছেন। নাগরিক আয়োজনে উপস্থাপন করে সম্মানিত করেছেন। হারিয়ে যাননি নিজের শেকড় থেকে। আমরা সুরমা পারের এই দাপুটে ভাববিলাসী মানুষটির গর্বিত উত্তরাধিকার!