মানিয়ে চলুন, সুখে থাকুন

জীবন যেন অদ্ভুত ফ্রেমে বাঁধা, ভাঙা-গড়া; সুখ-দুঃখ; নিয়ম-অনিয়মের ছাঁচে-ঢালা একটা কিছু। সব মেনে নিতে পারলে শান্তি, নতুবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অশান্তি। এই যে হঠাৎ শোনা যায়, কেউ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে—এ কি শুধু বিধাতার উপহাস? নাকি এর কিছু দায়-দায়িত্ব প্রিয়জনের ওপর বা নিজের ওপরও চলে আসে? যে প্রিয়তমা ভাবছেন তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, তিনি হয়তো সারাক্ষণ ঠেলে দিচ্ছেন দূরে। যে হৃদয় ভালোবাসা দিয়ে ভরে দেওয়ার কথা, সেখানে দিচ্ছেন চাপ। যে চাপ এক সময় বাড়তে বাড়তে উচ্চচাপ নিম্নচাপ তৈরি করতে করতে মাথাব্যথা বাড়িয়ে দেয়। যার পরিণতিতে হয়তো অনেক ক্ষেত্রে অকালে চলে যেতে হয় বা স্থায়ীভাবে উচ্চ রক্ত চাপ বইতে হয়। এই ব্যাপারটি নারী-পুরুষ সবার জন্যই সমান। তবে পুরুষ একটা বাড়তি চাপে থাকেন টাকা-পয়সা, চাকরি-ব্যবসার মতো নানা রকম সমস্যা নিয়ে; তাই চাপের মাত্রা তাদের একটু বেশি। জরিপ করলে দেখা যাবে, হৃদ্‌রোগে অল্প বয়সে যে পরিমাণ নারী মারা যান, পুরুষ মারা যান তার চেয়ে অনেক বেশি।
এসব কথার উৎস আমাদের এক সহপাঠীর গবেষণা। মেয়েদের দুঃখের পাশাপাশি ছেলেদের দুঃখ নিয়ে সেদিন তিনি হিসাব করছিলেন। ছেলেদের মধ্যে কে কে মারা গেছেন, কার কার সংসার ভাঙল, কার কার আবার জোড়া লাগল—এসব নিয়ে ছিল তার গবেষণা! আমরা ধরে নিই, মেয়েদের দুঃখবোধ একটু বেশি। আসলে মেঘলা দিনের মতোই দুঃখ দখল করে রাখে মানুষের মন, সে হোক ছেলে হোক বা মেয়ে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সব দুঃখ মেয়েদের। মেয়েদের মাথায় কান্নার ডিভাইস আছে বলে দৃশ্যত তাদের কান্না বেশি। ছেলেরা চাইলেও অনেক কিছু বলতে পারে না, কাঁদতে পারে না। তবে সত্যি বলতে মানিয়ে নেওয়ার মাত্রা ছেলেদেরও কম নেই। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়, মনের বিরুদ্ধে লুকোচুরিতে কখনো একটু বেশি দাম পড়ে যায় ।
এই আলোচনার পর আমাদের সহকর্মীদের মধ্যেও কিছু উচ্চমার্গের কথাবার্তা হলো। সান্ড্রা খুব সংসারী মহিলা। গির্জায় গিয়ে বিয়ে করেছে, মায়ামির এক রিভারক্রুজে মধুচন্দ্রিমা যাপন করেছে। হই-হুল্লোড়ে থাকতে পছন্দ করেন। সব পুরুষ সহকর্মীর গলায় আলিঙ্গন দিয়ে বলেন, ‘Oh my darling, how are you? I am missing you?’ তাই বলে যে তিনি কারও প্রতি অনুরক্ত, তা নয়। ওপরে কাচের দেয়ালে ইশারা করে তিনি নিচের অনেক পুরুষ কর্মীকেই ফোনে মেসেজ পাঠান, ‘Look at me here’।
সান্ড্রা বলছিলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে বলেছি, তুমি তোমার জীবনটা উপভোগ করো। আমার বাড়ি-গাড়ি তেমন কিছুর দরকার নেই। তুমি চাইলে তোমার বান্ধবীদের মেসেজ করো। কারণ মরে গেলে কিছু পাবে না। না পাবে ওরা, না পাব আমি। তার চেয়ে তুমি খুশি থাকো। শুধু দিন শেষে আমার কাছে ফিরে এসো। জীবনটাকে আনন্দে ভরে রাখো।’
সান্ড্রা সব সময়ই বলেন, ‘জীবনে কিছুই তেমন বড় নয়। দেখ সেদিন আমাদের সহকর্মী হঠাৎ ক্যানসারে কেমন মরে গেল? তোমার জীবনটা উপভোগ করো। সব সময় ঝগড়াঝাঁটি করো না।’ তাঁর এই দার্শনিক কথা মুগ্ধ করে আমাকে। আশপাশে যখন সমস্যা দেখি, আতঙ্ক দেখি, তখন মনে হয় মানুষকে কিছু অন্তত আশার বাণী শোনাই।
‘বিয়ে না করেই সুখে শান্তিতে আছেন মাত্র তিনজন’—এটিও আমাদের এক বন্ধুর স্ট্যাটাস। তার অর্থ কি বিয়ে করে সুখের পাশাপাশি দুঃখও কিছু কিনে নেওয়া? জীবনের স্বার্থে দুজন মানুষ কাছাকাছি আসে, কিন্তু সেখানে দেখা দেয় নানা সমস্যা। স্বামী বা স্ত্রীর বন্ধু-বান্ধবী ছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্য হয়ে যায় একটা সমস্যা। শাশুড়ি-ননদ ছাড়াও বৈরিতা আছে অনেক।
যেমন আমাদের আরেক বন্ধুর সংসারে অশান্তির কারণ তার এক ভাতিজি। ওকে তিনি একটু বেশি আদর করেন। বড় ভাইয়ের অবস্থা খুব একটা সচ্ছল না হওয়ায় ভাতিজির সব দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এটি সহ্য করা তাঁর স্ত্রীর জন্য বিরাট কষ্টের বিষয়। সংসারে আসার পর মনে মনে কানে কানে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু যৌথ পরিবারে সবাই যাতে এ নিয়ে কিছু না শোনে, সে জন্য যতটা সম্ভব স্ত্রীকে মানিয়ে চালানোর চেষ্টা করেন। নিজেদের দুই ছেলেমেয়ে হওয়ার পর বউ তো আর চুপ থাকতে পারে না। একপর্যায়ে বড় ধরনের ঝগড়া বাঁধে। সন্দেহ এখন এমন পর্যায়ে যায় যে, স্ত্রী ভাতিজিকে তাঁর স্বামীর সন্তান কিনা এমন প্রশ্ন তোলা শুরু করছেন। এহেন প্রশ্নের মুখে স্বামী বলেন, এ মেয়ে তাদের পালিত কন্যা। কারণ তার মা কুমারী মাতা। তাকে হাসপাতালের রেখে যায়। এখন স্ত্রীর প্রশ্ন, বিয়ের সময় কেন এ কথা বলা হলো না? এ ঘটনা বলতে পরিবারের কেউ বলেনি মানবিক কারণে। সবাই জানে, তাদের বড় ভাইয়ের দুই ছেলে, এক মেয়ে। এর সঙ্গে চাচার বিয়ের সম্পৃক্ততা কোথায়? সংসারে তাদের মধ্যে কেউ কোনো পার্থক্য করে না। কিন্তু বিয়ে নামক বৈধ বন্ধনে বাইরে থেকো আসা একজন মানুষের জন্য ১৮ বছরের একটা মমতা তো বিসর্জন দেওয়া অমানবিক নয় শুধু, গুনাহও বটে। এই সমস্যা একজন মানুষের মানসিক ভারসাম্য বিধ্বস্ত করে। নিজের সন্তান হলে পরিবারের সবাই সগৌরবে বলত বা সন্তানের মাকে মেনে নিত। এ মেয়ের ভবিষ্যৎ ঘরেই যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে সমাজে তো আরও বেশিই হবে।
বউ একদিন রাগ দেখিয়ে নিজের দুই বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন। পরে ফিরে এসেছেন বটে, কিন্তু যে দুঃসময় গেছে তাতে বড় ধরনের অঘটন ঘটতো পারত। তাই বলি, মেনে নেওয়ার বা নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। এ রকম অহরহ কোনো না-কোনো ঘটনা পুরুষকে শুধু সব সময় আহত করছে না, জীবনীশক্তিও ক্ষয়ে দিচ্ছে।
আমাদের জীবনটাকে উপভোগ করা উচিত। তাই বলে বলছি না, যা খুশি তাই করতে। বুঝেশুনে সবারই চলতে হবে, অপার স্বাধীনতায় যেমন খুশি তেমন চলতে গেলে প্রকৃতিও প্রতিশোধ নেয়। এক দিকে হিসাব করলে ছোট্ট জীবন, একে যতটা সহজ রাখা যায়, মিলেমিশে থাকা যায়, ততই ভালো।
সব সময় নিজেকে ভালো রাখা খুব প্রয়োজন। এখন আপনি যদি নিজেই ভালো না থাকেন, আপনি আশপাশের সবাইকে কি ভালো রাখবেন? নাকি ভালোবাসবেন? এখন কে কী করছে, এসব সারাক্ষণ ভাবতে থাকলে নিজেরই অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি ভাবতে থাকেন, সে অনলাইনে কারও সঙ্গে কথা বলে? কতক্ষণ হোয়াটসঅ্যাপে ছিল, কতক্ষণ মেসেঞ্জারে? কোনো জানালা ব্যবহার করেছে? ঘরে আসতেই মুঠোফোন খুঁটিয়ে দেখা—এসব করতে করতে আপনি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবেন। শুধু সঙ্গীর ক্ষেত্রে নয়, ছেলেমেয়েকেও অতিরিক্ত পাহারা দেওয়াটা ঠিক নয়। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে আগে ভালোবাসুন, তখন অন্যকেও ভালোবাসতে পারবেন; মন মুক্ত থাকবে। কাউকে আর শত্রু মনে হবে না। আপনার আমার বড় চেষ্টা থাকুক আমাদের প্রিয় মানুষটি যেন চাপমুক্ত থাকে।