বাঙালির পারিবারিক মূল্যবোধ এবং লোরা

দিন শেষে ওর হাতের এই মালিশ আমি খুব উপভোগ করি। সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয় রাতে। ভালো একটা ঘুমের সঙ্গে নতুন সকাল আমাকে নিয়ে যায় নতুন দিনের ব্যস্ততায়। সপ্তাহে দুদিন আমি ওর হাতের ম্যাসেজ নিতে আর ওর সঙ্গে আড্ডা দিতে আসি। আজ ওর হাতে কী হলো ঠিকমতো তাল পাচ্ছি না, একটুও মজা পাচ্ছি না যেন। উপুড় হয়ে শুয়ে ভাবছিলাম আর তখনই সে ভারী গলায় বলল, ফেইস মি। আর মনে হলো ওর এক ফোঁটা চোখের পানি আমার কপালে এসে পড়ল। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। হাই-হ্যালো না করেই শুয়ে গেলাম! ওর মায়ের কিছু হয়নি তো? জানতে চাইলাম, তোমার মা কেমন আছে। ও কিছু না বলে কাঁদতে লাগল। ম্যাসেজও করতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে। আর একটার পর একটা প্রশ্ন করতে লাগল, আচ্ছা তোমরা কেমন করে বাচ্চাদের বড় কর? ওদের কী শেখাও যে ওরা তোমাদের কথা মত চলে!
কোন বয়স থেকে শেখাতে শুরু করো? আমি বাঙালির বয়স্ক একজন রোগীও পাইনি, যে কিনা একা আসে, পরিবারের কেউ না কেউ সঙ্গে থাকেই; এমনকি নাতিপুতিরাও নিয়ে আসে। কেমন করে পরিবারের একজন রোজগার করে আর বাকিরা তার ওপর বসে খায়? অনেক প্রশ্ন তার। এমনিতেই ক্রিকেট খেলা নিয়ে তার সঙ্গে আমার বিরোধ। কেমন করে এতগুলো মানুষ সারা দিন ধরে ঘরে বা স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখে সময় নষ্ট করি। সে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মোস্তাফিজকে এখন ভালো করেই চেনে।
বলি, অনেক জটিল প্রশ্ন। অল্প সময়ে আমি উত্তর দিতে পারব না। আমি বোঝার চেষ্টা করি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে ওর কেন এত আগ্রহ।
লোরা মারিয়া ফিজিওথেরাপিস্ট এবং পেইন ম্যানেজমেন্টের চিকিৎসক। বেশ বড় চেম্বার, নানান দামি আধুনিক সব যন্ত্রপাতিতে সাজানো। চার বছর আগে হাঁটুর ব্যথার চিকিৎসা নিতে এসে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তারপর থেকে লোরা আমার বন্ধু। ওর বয়স ৫২, দেখতে বেশ সুন্দরী। বয়স বোঝা যায় না। তার জন্ম এখানেই, দাদা ছিলেন ইতালীয়। তার দুই ছেলে। দুজন দুই স্বামীর থেকে নেওয়া। তার কোনো বিয়েই বেশি দিন টেকেনি, সে জন্য লোরা নিজেকেই দোষে। এই প্রথম একজন নারীকে দেখলাম, যে কিনা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নিজেকে দায়ী করে।
লোরার কোনো ছেলে বন্ধু নেই। ছেলেদের সে কম পছন্দ করে। এ নিয়ে আমার ঘরের মানুষ আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। তাদের কথা আমি গায়ে মাখি না। লোরা ভীষণ আলাপী; মানুষের সঙ্গে মিশে যায় খুব সহজেই। তার নানা দেশের নানা বয়সী প্রচুর রোগী। মানুষের প্রতি অতি আগ্রহের কারণেই আমি তাকে ভীষণ পছন্দ করি। মানুষের ভেতরে মানুষ খুঁজতে আমিও পছন্দ করি। আমি ওর কাছ থেকে বিনা মূল্যে ম্যাসেজ নিই এবং সঙ্গে হালকা ব্যায়াম করি। সঙ্গে চলে নানান গল্প। ছুটির দিনে দুজনের সময় মিলে গেলে আমরা ঘুরতে বের হই ও হেলাফিনো মার্গারিটা খাওয়া হয়। নানা নামের ড্রিংকস তার পছন্দ। আমরা নাকি ফ্রিতে পেলে আলকাতরাও খাই, আর এ তো মজাদার পানীয়। ওর এই পানীয় ফ্যান্টাসি নিয়ে পরে লিখব। ওর নিজের জীবনের প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা কাজ করে। তবে রোগী ও চেম্বার তার পছন্দের জায়গা।
লোরার কান্নার কারণ হলো, রবিন নামে ২৩ বছর বয়সী এক বাঙালি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থেরাপি নিতে আসছিল। রবিন তাকে অনুরোধ করেছে, সে যেন তার বাবা-মাকে কিছু না জানায় এবংয় বলে তার খারাপ কিছু হয়নি। সঙ্গে এমন কিছু থেরাপি আর ওষুধ দেয় যাতে সে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে কাজে ফিরতে পারে। কারণ তার বাবা-মাকে দেখার আর কেউ নেই, বাবা হৃদরোগে ভুগছে, তাই বাসায় থাকে। সে দ্রুত ভালো না হলে তার বাবা-মা বাসা ভাড়া দিতে পারবে না এবং না খেয়ে থাকবে। আমাদের প্রতি তাই লোরার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কান্না।
লোরার বাবা নেই, মায়ের বয়স ৮২ এবং নার্সিংহোম তার বর্তমান ঠিকানা। লোরার দুই ছেলে, একটার বয়স ২৯, অন্যটা ২৪। দুজনই ভালো ছাত্র, পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করে। তারা নিজের পয়সায় চলে। দুই ছেলেই তার সঙ্গে থাকে। বাসায় মাকে কোনো টাকা দিয়ে সাহায্য করে না। ছুটির দিন ছাড়া তেমন একটা দেখা সাক্ষাৎও হয় না। লোরা চায়, তার ছেলেরা বাসায় থাকা বাবদ ওকে বাসা ভাড়া দিক বা আর না হয় আলাদা থাকুক। এ নিয়ে তার প্রতি মাসেই ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধে। এ দেশে ছেলে-মেয়ে বড় হলে নিজের মত আলাদা এবং পরিবার থেকে দূরে থাকে। মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসে। এখানে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। বাবা-মাও খুশি হয়। বাবা-মায়ের প্রতি রবিনের মায়া, চিন্তা, উদ্বেগ দেখে তার নিজের ছেলেদের কথা মনে করেই কান্না আসে লোরার। ওর মতে, এ বয়সী একটি ছেলের কত টান পরিবারের প্রতি। আমাকে বলে, তোমরা অনেক ভাগ্যবান। আমরা গুড পেরেনটিং করি। ও নাকি আমার মেয়েদের সঙ্গেও কথা বলেছে। তারাও তাকে বলেছে, বড় হয়ে চাকরি করবে আর বাবা-মাকে কাজ করতে দেবে না।
আমি লোরাকে বলি, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ আমার ধর্মেই বলা আছে। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, আমরা জন্মের পর থেকেই শিখি। বড় হয়ে সন্তান বাবা-মায়ের সেবা করবে এটাই আমাদের নিয়ম। বাবা-মা শুধু না, পরিবারে বড়দের দেখাশোনার দায়িত্বের কথা আমাদের সমাজের অন্যতম শিক্ষা, যার জন্য স্কুলে যেতে হয় না। মা-বাবাই আমাদের কাছে প্রথম শিক্ষক। শুধু পরিবার নয়, প্রতিবেশীর প্রতিও আমাদের দায়িত্ব আছে। তেমনি আমাদের বাবা-মাও অনেক পরিশ্রম করে আমাদের বড় করেন। অনেকে ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য মা-বাবা সর্বস্বান্ত হন। নিজেদের কথা না ভেবে সন্তান মানুষ করা আমাদের দেশের বাবা-মায়ের প্রধান কাজ, যা কিনা তোমাদের সঙ্গে মেলে না। সন্তান বড় হলে তাদের পছন্দ মত সংসার গড়ে দিতে সাহায্য করি। তারপরও দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। নাতিপুতি দেখাশোনার কাজও আমদের বাবা-মায়েরাই করেন। তোমাদের সন্তান পেটে আসার পর থেকে সন্তানের বয়স ১৮ হওয়া পর্যন্ত সরকার বাচ্চাদের ভরণপোষণের খরচ দেয়। তোমরা সন্তানের বয়স ১৮ হলেই বাসা থেকে বের করে দাও। যতটুকু আমার মাথায় আছে তা দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, আমদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ দিকে তোমাদের থেকে সমৃদ্ধ ।
আমাদের দেশেও এখন বৃদ্ধা আশ্রম গড়ে উঠেছে। বৃদ্ধ আশ্রমে বাবা-মায়ের খরচ বহন করি বিকাশের মাধ্যমে। বৃদ্ধা আশ্রমে মা-বাবাকে এক নজর দেখতে না যাওয়ার হাওয়া এখন আমাদের দেশেও চালু হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও ছেলে বৃদ্ধ মাকে স্টেশনে ফেলে যায়। মা যেমন সন্তানের সবচেয়ে বড় আশ্রয়, তেমনি বৃদ্ধ বয়সে সন্তানও মায়ের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে অনেক মায়েরই সৌভাগ্য হয় না সন্তানকে আঁকড়ে থাকার। এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রমই হয়ে ওঠে অনেক মায়ের ঠিকানা। আধুনিক নগরায়ণের কারণে আমাদের যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারে মা-বাবা আর সন্তানের প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। যদিও কোনো পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠরা থাকেন, তবে তাঁদের দেখা যায় কোনো রকম আশ্রিত মনোভাব নিয়েই থাকতে হয়। অথচ আগে পরিবারের মুরব্বিরাই প্রধান হর্তাকর্তা ছিলেন। লোরাকে এসবের কিছুই জানতে দিই না, চেপে যাই । ওকে বিশ্বাস করাই, আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ তোমাদের চেয়ে অনেক ওপরে। তাই রবিন হলো আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি।