রহস্যের জট আজও খোলেনি

সাভাস সাভাপোলাস ও এমি সাভাপোলাস এবং একমাত্র ছেলে ফিলিপ
সাভাস সাভাপোলাস ও এমি সাভাপোলাস এবং একমাত্র ছেলে ফিলিপ

১৯ মে ২০১৫। আমাদের বাসার ওপরে দুটি হেলিকপ্টার এমনভাবে চক্কর দিচ্ছিল যে, মনে হলো ব্রুকলিনে কিছু হয়েছে। আমরা ব্রুকলিনে যে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে থাকি সেটি ছয়তলা। আমরা থাকি দোতলায়। আসলে যখনই লোকালয়ের ওপরে হেলিকপ্টার এতটা নিচ দিয়ে ঘুরতে থাকে, তখনই বুঝি কিছু একটা ঘটেছে। একবার আমার মেয়ের স্কুলের প্লে গ্রাউন্ডে গানম্যান ঢুকে পড়েছিল। সে সময় ওপরে দুটি হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিল। রুদ্ধশ্বাসে আমরা বাবা–মায়েরা বাইরে অপেক্ষা করছিলাম।
আজও সিএনএন আর এবিসি চ্যানেলে অনুসন্ধান করতেই বের হয়ে এল ওয়াশিটংন ডিসির চাঞ্চল্যকর চার খুন হত্যা মামলার তথ্য। ২০১৫ সালে আমাদের বাসার ওপর হেলিকপ্টার চক্কর দেওয়ার চার দিন আগে ১৫ মে ওয়াশিংটন ডিসির অভিজাত আবাসিক এলাকায় নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ধনাঢ্য পরিবারের ১০ বছরের ছেলেকেও রেহাই দেয়নি খুনিরা। তাকে হত্যা করেছে নৃশংসভাবে। ওয়াশিংটন ডিসির অভিজাত এলাকায় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী সাভাস সাভাপোলাস ও এমি সাভাপোলাস একমাত্র ছেলে ফিলিপকে নিয়ে প্রাসাদতুল্য বাড়িতে বসবাস করেন। মেয়ে এবিগেইল সাভাপোলাস আর ক্যাটরিনা সাভাপোলাস স্কুলের হোস্টেলে থাকে। বাসায় কাজে সাহায্য করতে আসে ভেরা ফিগুইরো ও নেলি। কোটি ডলারের প্রাসাদতুল্য বাড়িটির কয়েক ব্লকের মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বাড়ি, আর কয়েক ব্লকের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের। সাভাস সাভাপোলাস আয়রন অ্যান্ড স্টিলের ব্যবসায়ী। আমেরিকান আয়রন ওয়ার্কসের মালিক ।
১৫ মে বেলা ১২টার দিকে সাভাসের প্রাসাদোপম সেই বাড়িটি থেকে প্রতিবেশীরা ধোঁয়া বের হতে দেখে ফায়ার সার্ভিসে কল করে। অগ্নিনর্বাপক কর্মীরা এসে বাড়ির ভেতর থেকে চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। সাভাস সাভাপোলাস, এমি সাভাপোলাস ও গৃহকর্মী ভেরা ফিগুইরো। একটি রুমে চেয়ারে ডাক্ট টেপ ও দড়ি দিয়ে আটকে বেসবলের ব্যাট দিয়ে পিটানো হয়েছে এবং ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, শ্বাসরোধ করার চেষ্টাও করা হয়েছে। পরে আগুন লাগিয়ে খুনিরা পালিয়ে গেছে। সবশেষে শয়নকক্ষে ১০ বছরের ফিলিপকেও মৃত পাওয়া গেল। তাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তার দেহ এতটাই বিকৃত হয়েছে যে, চেনা যাচ্ছিল না।
তদন্তকারী দল তন্ন তন্ন করে সারা বাড়ি খুঁজে কোনো চিহ্ন পায়নি। শেষে বাড়ির বাইরে গারবেজ ক্যানে পিৎজার আধাখাওয়া টুকরো নিয়ে যাওয়া হলো ল্যাবে। সেটির ডিএনএ টেস্ট আর সিকিউরিটি ক্যামেরা দেখে ড্যারন উইন্টকে (৩৪) সন্দেহ করা হলো। এই লোকটি আগে আমেরিকান আয়রন ওয়ার্কস কোম্পানিতে কাজ করত। গানসহ আটক হওয়ার পর কোম্পানির আইন অনুযায়ী তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। জোর করে বাড়িতে ঢোকার কোনো আলামত নাই। তাই খুনি বা খুনিরা অবশ্যই পূর্ব পরিচিত। ড্যারন উইন্টকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল। এদিকে এমির পোরশে ১৯৯৮ কার পাওয়া গেল ম্যারিল্যান্ডের একটি চার্চের পার্কিং লটে যা কিনা আগুনে জ্বলছে।
সিসিটিভি ফুটেজ আর পিৎজার টুকরো থেকে ড্যারন উইন্টকেই সম্ভাব্য খুনি চিহ্নিত করে তাকে ধরতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশী শুরু করা হয়। তাকে ধরিয়ে দেওয়া বা তার অবস্থান জানানোর জন্য ২৫ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ম্যারিল্যান্ডে ড্যারনের বাড়ি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেল, তার প্রেমিকা নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের বাসিন্দা। ফোন ট্র্যাকিঙের মাধ্যমে সারা দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে পুলিশ নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে তার প্রেমিকার বাড়িতে ড্যারনের অবস্থান শনাক্ত করে।
এরই মধ্যে আরও তথ্য পাওয়া গেল। সাভাসের গাড়িচালক জানান, ১৪ মে রাতে তাঁর বস সাভাস সাভাপোলাস তাঁকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে ৪০ হাজার ডলার ব্যাংক থেকে তুলে ম্যানিলা খামে করে এনে পার্কিং গ্যারেজের কারের ভেতর রেখে চলে যেতে বলেন। তিনি সে অনুযায়ী টাকা সাভাসের গাড়িতে রেখে যান।
পার্শ্ববর্তী ডোমিনোস পিৎজা স্টোরে এমি সাভাপোলাস রাতে ফোনে অর্ডার দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর ছেলে অসুস্থ। তাই দরজায় পিৎজার বাক্স রেখে ডোরবেল বাজিয়ে চলে যেতে। ডেলিভারিম্যান সেভাবেই ডেলিভারি দিয়ে যায়।
পরদিন সকালে অন্য গৃহকর্মী নেলিকে কাজে না আসার জন্য মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠান এমি সাভাপোলাস। তাদের ছেলে অসুস্থ, তাই ভেরা তার কাছে রাতে থেকে গেছে। আজ নেলির কাজে আসতে হবে না। নেলি প্রায় ২৪ বছর এই পরিবারের সঙ্গে আছে। তার কাছে কিছুটা অসংগতিপূর্ণ মনে হলেও সে বিশ্বাস করে।

ভেরা
এদিকে অন্য গৃহকর্মী ভেরা ফিগুইরো বাড়ি না ফেরায় ভেরার স্বামী বারবার ফোন করেন। কিন্তু ভেরা ফোন ওঠায় না। ভেরার স্বামী তখন ওই বাড়িতে যান। তিনি ডোরবেল বাজাতে বাজাতে কোনো উত্তর না পেয়ে বাড়ির পেছন দিকে কোনো জানালা বা দরজা খোলা আছে কিনা দেখতে যান। তখন সাভাস সাভাপোলাস তাঁকে ফোন করে বলেন, আমি দুঃখিত ভেরা গতকাল রাতে আমার স্ত্রী অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। এখনো তিনি আমার স্ত্রীর সঙ্গে হাসপাতালে আছেন।’ বলেই ফোন কেটে দেন। তারপর আর রিং করলেও ফোন কেউ ধরেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খুনি খুব চতুর। তবে একা একজন মানুষ কী এই চারজনকে হত্যা করতে পারে? ডিসি থেকে ড্যারন আত্মগোপন করেন। তাকে ধরতে ডিসি, ম্যারিল্যান্ড, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে। নিউইয়র্ক নগর থেকে ট্র্যাকিং করে ম্যারিল্যান্ডের একটা হোটেলে ড্যারনের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে পুলিশ যখন ভেতরে ঢুকবে, তখনই পুলিশ বুঝতে পারে সে হোটেল থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠে গেছে। সে একটা সেডান কারে আছে এবং একটা ট্রাক কারকে কভার দিচ্ছে।
নিউইয়র্ক থেকে আবার ডিসির দিকে যাচ্ছে। অবশেষে ২০ মে পুলিশ ড্যারনকে ম্যারিল্যান্ড–ওয়াশিংটন ডিসি বর্ডারে আটক করে। ওর সঙ্গে গাড়িতে দুজন মহিলা ছিলেন। সেই ট্রাকে ড্যারনের ভাইসহ আরও দুজন লোক ছিলেন। সাভাস সাভাপোলাসের আয়রন কোম্পানির সাবেক কর্মী ড্যারনকে পুলিশ আটক করল। পুলিশ জানায়, ওই গাড়িতে এক শ ডলারের নোট আর মানি অর্ডার ফরম পাওয়া যায়। ওই নোটগুলো সাভাস সাভাপোলাসের চালকের রেখে যাওয়া ৪০ হাজার ডলারেরই অংশ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই হত্যাকাণ্ড? প্রাসাদোপম সুরক্ষিত বাড়িটিতে কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়? চাঞ্চল্যকর তথ্য তথা হৃদয়বিদারক তথ্য একের পর এক পাওয়া যাচ্ছিল। মাত্র ৪০ হাজার ডলারের জন্য এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে? আর কেউ কি জড়িত ছিল? একা ড্যারেন উইন্ট এই চারজনকে হত্যা করল? ব্যবসায়িক কারণ জড়িত কিনা—যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এখনো তদন্ত চলছে। রহস্যের কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না।