প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, সাংবাদিক জামাল খাসোগির নাম একেকজন সংবাদ উপস্থাপক বা প্রতিবেদক একেকভাবে উচ্চারণ করছেন। কেউ বলছে কাশোগি, কেউ খাসোগজি, কেউ খাশোস্কি ইত্যাদি। তাঁর নামের প্রকৃত উচ্চারণ নিয়ে আমরা এখানে বেশি কথা না বলাই শ্রেয়। বরং আমরা আসল কথায় আসি।
রয়টার্সের মধ্যপ্রাচ্য মনিটরের এক বিলিপত্রে জানা যায়, ইস্তাম্বুলে নিহত হওয়ার মাসখানেক আগে জামাল খাসোগি সৌদি আরবের ওয়াশিংটন দূতাবাসে বন্ধুত্বপূর্ণ বৈঠকের জন্য এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এনবিসি নিউজ চ্যানেলের খবর অনুযায়ী, এই বৈঠকের ব্যাপারে তিনজন জানতেন। খাসোগি ইতিমধ্যে সৌদি সরকারের একজন কট্টর সমালোচকে পরিণত হয়েছেন। এই আলোচনার সময় দূতাবাসের কয়েকজন কর্মী খাসোগিকে চিনতে পারেন এবং তাঁরা উপরতলার অফিসে ওয়াশিংটনের সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালিদ বিন সালমানকে (কেবিএস) খবরটি জানিয়ে দেন। খালেদ বিন সালমান সম্পর্কে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানের (এমবিএস) ছোট ভাই। এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল তিনজন ব্যক্তির কাছ থেকে নিউজ চ্যানেল এই বৈঠকের কথা জানতে পারে। খবর পেয়ে রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালেদ তৎক্ষণাৎ খাসোগিকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠান। ওই অফিসে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তাঁদের আলোচনা চলে।
সৌদি আরবের ওয়াশিংটনের দূতাবাসটি বিখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কাহিনির জন্ম দেওয়া ভবনের সামনে অবস্থিত। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৭ সালের শেষদিকে অথবা ২০১৮ সালের প্রথম দিকে। এনবিসি নিউজের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই খবরটি তারা পেয়েছে খাসোগির দুই বন্ধু ও তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের একজনের কাছ থেকে। সৌদি দূতাবাসে যে বৈঠক হয়েছে, সে ব্যাপারটি তাঁরা নিশ্চিত করেন।
ঠিক কী নিয়ে খাসোগি ও প্রিন্স খালিদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল, তা স্পষ্ট নয়। তবে সৌদি রয়েল কোর্ট খাসোগিকে রিয়াদ ফিরিয়ে নিতে একটি অভিযান চালায়। প্রথম দিকে শান্তিপূর্ণভাবে এবং তারপর ক্রমশ আরও বেশি উদ্ধত পন্থায় যার পরিণতি দাঁড়ায় চলতি মাসে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে।
খাসোগির এক বন্ধু তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ৩০ বছর বয়সী রাষ্ট্রদূত যুবরাজ খালিদ সালমানের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি কোনো রকম আগ্রাসী ভাব বা হুমকির শিকার হয়েছেন কিনা। খাসোগি বলেছিলেন, ‘না না, আমরা বেশ চমৎকার একটা আড্ডা দিয়েছিলাম। আড্ডার পরিবেশ বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। হি ওয়াজ নাইস টু মি।’
ওই তিনজন বলেন, প্রিন্স খালিদ ও সৌদি আরবের মহামান্য আদালতের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা সউদ বিন আবদুল্লাহ আলকাহতানি নাকি গত এক বছর ধরে খাসোগিকে অন্তত এক বছরের জন্য হলেও দেশে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। তাঁরা এও বলেছেন, খাসোগি সৌদি নেতৃত্বের স্পষ্ট সমালোচক হওয়া সত্ত্বেও দেশের কর্তাব্যক্তিরা অনুরোধ করেছে, এভাবে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে না থেকে তিনি যেন দেশে ফিরে যান। সেখানে তাঁকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হবে। সেখানে থেকেও তিনি স্পষ্ট ভাষায় নিজের মতামত জানিয়ে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করতে পারবেন।
খাসোগির দুই বন্ধু বলেন, গত গ্রীষ্মে আল কাহতানি সৌদি রাজকীয় আদালতে খাসোগিকে উচ্চপর্যায়ের একটি চাকরির প্রস্তাব দেন। তিনি খাসোগিকে বলেন, ইচ্ছা করলে তিনি নাকি সৌদি থিংক ট্যাংকেও যোগ দিতে পারেন। তাদের কথাবার্তা নাকি এভাবে ছিল, ‘ওহে জামাল, তুমি বাড়ি ফিরে চলো। এখানে থেকে তো নিজের দেশকে মিস করছ। আমরা তোমার সবকিছু ক্ষমা করে দেব এবং আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে সুন্দরভাবে কাজ করব।’
খাসোগির প্রতি এই আমন্ত্রণ একেবারে নতুন নয়। এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল চারজন বলেছেন, সৌদি গোয়েন্দা বিভাগের স্থায়ী নির্দেশ হিসেবে এটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এবং বছরের পর বছর ধরে তা কার্যকরও করা হচ্ছে। এই আদেশের মূল কথা হলো, যখনই সম্ভব সৌদি কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের সমালোচকদের সঙ্গে সমঝোতা করা উচিত এবং যারা দেশের বাইরে আছে তাদের ফিরিয়ে এনে সৌদি কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত।
কিন্তু খাসোগি নাকি এই বাড়িয়ে দেওয়া হাতটি ঠিক বন্ধুত্বপূর্ণ মনে করেননি। দুই বন্ধুসহ আরেক ব্যক্তি খাসোগির মৃত্যুর আগে বিষয়টি নিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে জানা গেছে। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, তাঁকে সৌদি আরবে প্রত্যাবর্তন করানোর জন্য এটি একটি চাল মাত্র। দেশে ফিরলে হয় তাঁর জেল হবে নতুবা আরও খারাপ কিছু।
খাসোগিকে হত্যার জন্য কোনো আদেশ দেওয়ার কথা সৌদি সরকার অস্বীকার করে বলেছে, সৌদি আরব সরকার তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। খাসোগির মৃত্যুর পর প্রথম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার সৌদি আরব বলেছে, ১৫ জনের দলকে ইস্তাম্বুলে পাঠানোর কারণ, ‘তার দেশে ফিরে আসার একটা ইঙ্গিত ছিল।’
সৌদি আরব বলছে, সেভাবেই এই দলটি খাসোগির সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমঝোতায় আসার চেষ্টা করে। কিন্তু তর্কাতর্কি থেকে সেটা লড়াইয়ে পরিণত হয় এবং তাতে খাসোগি নিহত হন। কিন্তু তুরস্ক সরকার বলছে অন্য কথা। তাদের বক্তব্য, এই দলটি ইস্তাম্বুলে গিয়ে খাসোগিকে হত্যার চেষ্টা করেছে। তারা দাবি করেছে, তাদের অডিও টেপ থেকে বোঝা যায়, খাশোগি কক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁকে হত্যা করা হয়। সাত মিনিটের মধ্যে তার দেহ টুকরো টুকরো করা হয়।
খাসোগি তাঁর আসন্ন বিয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্রের জন্য ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন।
প্রিন্স খালিদ অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান, তিনি রিয়াদে ফিরে এসেছেন খাসোগির নিখোঁজের তদন্তে কমিটিতে যোগ দিতে। তাঁর আমেরিকায় ফিরে না–আসা নিয়ে ব্যাপক জল্পনা শুরু হয়েছে, তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে হয়তো আর ফিরতে পারবেন না। এদিকে কংগ্রেস ও মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি মিথ্যা বলেছেন। তাঁর নানা বিবৃতির একটি সংস্করণে বলা হয়েছে, খাসোগি কনস্যুলেট থেকে জীবন্ত ফিরে গেছেন। ভিডিওতে খাশোগির ফিরে যাওয়ার দৃশ্য বারবার দেখানো হয়েছে। ভেতরে ঢোকা ও বাইরে বেরিয়ে আসা মানুষটি দূর থেকে একই রকম দেখতে লেগেছিল।
কিন্তু পরে প্রমাণ হল, ভিডিওর মানুষটি খাসোগি নন। দেখা যাচ্ছে, খাসোগির একটা ‘বডি ডবল’ ব্যবহার করা হয়েছিল। যে ব্যক্তি বেরিয়ে এসেছে দেখানো হয়েছে, তার গায়ে খাসোগির পোশাক ছিল ঠিকই এবং তার শরীরের অবয়ব প্রায় একই রকম ছিল ঠিকই। কিন্তু দেখা গেছে, তার জুতো জোড়া আলাদা ছিল। এবং চুলও একই রকম ছিল না। তারপর যখন সে খাসোগির পোশাক ছেড়ে নিজের পোশাকে বাইরে আসে, তখন তাকে সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ বলে চিহ্নিত করা যায়।
আরেকটি ব্যাপার ছিল খুবই বিভ্রান্তিকর। তা হলো ওই ১৫ জন যদি আলোচনা করতে গিয়েছিল, তাহলে তাদের কাছে হাড় কাটার করাত (বোন কাটিংস) কেন ছিল? মানুষটাকে কেটে টুকরো টুকরো করাই কি আসল উদ্দেশ্য ছিল না? বিষয়টি নিয়ে সৌদি সরকার বিপাকে পড়েছে। আগে খাসোগি সুস্থ শরীরে অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বললেও তাঁকে যে হত্যা করা হয়েছে, সে কথা এখন স্বীকার করছে। কিন্তু এ কথাও বলছে, এতে এমবিএস-এর কোনো হাত নেই। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এসব হঠকারীদের কাজ। তাঁরা এক মাস ধরে ভালো করে তদন্ত করতে চায়। তারপর দেখা যাবে কোথাকার পানি কোথায় দাঁড়ায়।
মার্কনি পররাষ্ট্র দপ্তর আশা করছে, প্রিন্স খালিদ আমেরিকায় ফিরে আসলে তাঁর কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। এখানে সৌদি দূতাবাস বা রিয়াদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই পদে তাঁকে বহাল রাখবে নাকি অন্য কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করবে—তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এর আগে খাসোগি নিখোঁজ হওয়ার চার দিন পর প্রিন্স খালিদ ওয়াশিংটনে তাঁর পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে এক লম্বা বার্তা পাঠান। পরে সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে গণমাধ্যমে সেটি পাঠানো হয়। এতে তিনি বলেন, ‘ওয়াশিংটন পোস্টের নিখোঁজ ওই কলামিস্টের সৌদি আরবে অনেক বন্ধু আছে যাঁদের মধ্যে আমিও একজন। ওয়াশিংটনে থাকার সময় খাসোগির সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।’ তাঁর কথায়, জামাল একজন সৌদি নাগরিক, যার নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার, যেমনটা অন্য সব নাগরিকদেরও আছে। তাঁকে খুঁজে বের করতে আমরা কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া থেকে সৌদি আরব বিচ্যুত হবে না।
সৌদি আরবের নেতার পজিশনে কি কোনো রদবদল আসবে? তিনি কি চালে ভুল করেছেন? বলা শক্ত। কারণ তেমন কেউ আশপাশে নেই। কেউ কেউ বলছে, তিনি সৌদিকে সংস্কার করে, কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই রাজতন্ত্রকে একটি আধুনিক দেশে পরিণত করতে চান। এটি করতে গিয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয় উঠেছেন। আবার কিছু কিছু লোক বলছে, আগে অনেক নামি প্রিন্স ছিলেন। তাদের সময় সব প্রকল্প ও কার্যক্রমের খসড়া সবার মধ্যে বিলি করা হতো এবং সব বিষয়ে একটা মতামত নেওয়া হতো। কিন্তু এখন সে অবস্থা নেই, তিনিই সর্বেসর্বা।
এ ঘটনার পর সৌদি আরবের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কে কি কোনো চিড় ধরবে? তাও বলা শক্ত। কারণ সবকিছুর মধ্যে শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্য নিহিত। তাতে দুপক্ষেরই স্বার্থ জড়িত। এমনও হতে পারে, টানাপোড়েন হয়তো কিছুদিন চলবে। তারপর আবার সব ঠিক জায়গায় চলে আসবে। ঠিক পানা–পুকুরে ঢিল মারার পর যে দৃশ্য দেখা যায়। তবে ভবিতব্য কে জানে?