যে সয় সেই রয়

আমার শৈশব, কৈশোরের কথা ভাবনায় এলে এখনো মন খারাপের বাঁশি বেজে উঠে বুকের গহিনে। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের সঙ্গে আমার বেড়ে ওঠা। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আমার বড় ভাই-বোনদের মতো আমাকেও পড়ার টেবিলের সঙ্গে মাঝের ঘরে টাঙানো রুটিনটি অনুসরণ করে সকাল, দুপুর, রাতের নির্দিষ্ট কাজগুলো শেষ করতে হতো। ভোরে কয়টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে, কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত পড়তে হবে, কখন স্কুলে যেতে, কয়টায় ঘুমাতে হবে, কতক্ষণ সংবাদপত্র পড়তে হবে ইত্যাদি। কখন কতক্ষণ রেডিও শুনতে পারব, কখন শরীর চর্চা করব, আরবি পড়ব, ঘরের কাজে আম্মাকে সাহায্য করব—সবকিছুই ছিল নিয়মে বাঁধা। ছোটবেলায় ছকের বাইরে যাওয়া কিংবা ইচ্ছেমতো ছুটোছুটি করা আমি এবং আমার ভাই-বোনদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
রুক্ষ আওয়াজের উদ্ভট এক বড় দেয়ালঘড়ি ছিল আমাদের মাঝ ঘরের দেয়ালে। দেশ-বিদেশের অনেক শহরে ঘুরেছি, এমন ঘড়ি কোথাও আমার চোখে আর পড়েনি। প্রতি ঘণ্টায় বিকট শব্দে সময় জানান দিত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমরা পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়াসহ অন্য কাজগুলো শেষ করতাম। এখন জীবনের বড় বেলায় এসেও ছোটবেলার সেই নিয়মতান্ত্রিক জীবনের অভ্যাস থেকে বের হতে পারিনি। সব মানুষ আলাদা। চাইলেও নিজস্বতা থেকে বের হতে পারে না। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তবে রসহীন, রুক্ষ শৈশব আর কৈশোরের জন্য আমার মনে কোনো দুঃখবোধও নেই। কারণ ছোটবেলায় আম্মা, ঘরের শিক্ষক আমাকে এমন অনেক কিছু শিখিয়েছেন, যা পরে আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে।
মনে পড়ে, স্কুল ছুটির দিন শুক্রবার সমবয়সীরা যখন দল বেঁধে এবাড়ি-ওবাড়ি খেলতে যেত, আড্ডা দিত, গল্প করত—আম্মা তখন আমাকে পাশে বসিয়ে আদর করে রান্না শেখাতেন। রান্না করতে আমারও ভালো লাগত। রান্নাটাকে ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে শিল্প মনে হতো। মনযোগ সহকারে স্কুল ছুটির দিন গভীর আগ্রহে আমি আম্মার কাছ থেকে নতুন নতুন রান্না করা শিখতাম। আম্মা বলতেন, সব কাজ জেনে রাখা ভালো। জীবনে যখন যে কাজটি সামনে আসবে, সহজেই করতে পারবে। হোঁচট খেতে হবে না।
আম্মা ছিলেন নরম মনের মানুষ, ভীষণ শান্তিপ্রিয় ও স্বল্পভাষী। মনে পড়ে, একদিন সকালে ঘরের সবাইকে খাইয়ে আম্মা খেতে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ভিক্ষুক এসে আম্মার কাছে খাবার চায়। মুখের কাছে তোলা ভাতের লোকমা প্লেটে রেখে পুরো খাবারের প্লেট ভিক্ষুককে দিয়ে দেন। আমি বিরক্ত হয়ে আম্মাকে বললাম, চাল দিয়েই তো তাঁকে বিদায় করা যেত। মুখের খাবার না দিলেই পারতেন। উত্তরে আম্মা বলেছিলেন, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। ভিক্ষুককে নিজের খাবার খাইয়ে যে সুখ পেয়েছি, নিজে খেয়ে সে সুখ পেতাম না। আম্মাকে দেখেছি, জীবনভর সাধ্যের সবটুকু আপনজন, চারপাশের সবার জন্য উজাড় করে দিতেন।
একদিন সাত সকালে আমার এক আত্মীয়ের চিৎকার, চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে দেখি, উনি অযথাই আম্মাকে কথা শোনাচ্ছেন। আম্মা নিশ্চুপ। কোনো প্রতিবাদ করছেন না। আত্মীয় শান্ত হওয়ার পর দেখলাম, আম্মা তাঁকে সকালের নাশতা খেতে দিলেন। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে তর্ক হচ্ছিল সে বিষয়টি আমার জানা ছিল বলে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন প্রতিবাদ করলেন না? উত্তরে আম্মা বলল, দুপক্ষ একসঙ্গে কথা বললে কেউ কারও কথা শুনবে না। ও বলেছে, আমি শুনেছি। সে তার ভুল একসময় বুঝবে। আমি কথা বললে অহেতুক কথা বাড়বে। কোনো সমাধান হবে না। তর্ক করে কেউ জয়ী হয় না, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুনিয়ায় সব সমস্যার সমাধান আছে এবং তর্ক করে নয়, ঠান্ডা মাথায় সমস্যার সমাধান করতে হয়। রেগে গেলেই হেরে যেতে হয়। রাগান্বিত পরিবেশে মাথা ঠান্ডা রাখতে জানাটা গুণ। যে সয় সেই রয়। সেদিন আম্মার ওপরে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। আম্মাকে আমার চোখে একজন বোকা মানুষ মনে হয়েছিল।
দেশ ছেড়েছি অনেক বছর আগে। আমার স্বামীরা আট ভাইবোন। আমি ঘরের বড় বউ। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আমার অবস্থাও ঢেঁকির মতোই। বিদেশে এসেও ছোটবেলার মতো রুটিন মাফিক জীবনকেই আলিঙ্গন করতে হয়েছে। সংসার, সন্তান, কাজ—সব মিলিয়ে দায়িত্বের কাদাজলে নিমজ্জিত আমি কখনো বসে আরাম করে এক কাপ চাও খেতে পারিনি। ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাতদিন দৌড়াতে হয়। ছোটবেলা, বড়বেলা কোনো বেলাতেই অবসর জোটেনি। কাছের মানুষেরা জানেন, আমি টিভি দেখারও সময় পাই না এখন। কারও সঙ্গে বসে গল্প, আড্ডা সেতো আমার কাছে রূপকথার মতন।
আম্মা আমার কাছে প্রথমবার বিদেশে বেড়াতে আসার পর প্রতিবেশীরা আম্মার কাছে আমার নামে অভিযোগ করেছেন। আম্মা এত মিশুক, কিন্তু আম্মার মেয়ে হয়ে আমি কারও সঙ্গে মিশি না। আম্মা কারণ জানতে চাইলে সেদিন কিছুটা রেগে গিয়েই বলেছি, আপনিইতো এভাবে আমাকে বড় করেছেন। পড়াশোনা, কাজ, ঘুম, খাওয়া। আপনার ‘যে সয় সেই রয়’, ‘ত্যাগেই প্রকৃত সুখ’—এসব জীবন দর্শন বর্তমান দুনিয়াতে অচল। এখন হোল ‘জোর যার মুল্লুক তার’। আপনি বোকা মানুষ, সঙ্গে আমাকেও বোকা বানিয়েছেন। মানুষের সঙ্গে আর মিশব কিভাবে? স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন আমার কথাগুলো শুনে সন্ধ্যার ম্লান আলোয় আম্মার মুখখানি ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।
পাঁচ বছর হল আম্মা আমাকে, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। জীবনের নানা সময়ে কত মানুষ অকারণে কত কথা শুনিয়ে চলে গেছেন। আমি প্রতিবাদ করিনি। বিষয়টা তেমন নয় যে প্রতিবাদ করতে জানি না, আমার প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করেনি। পায়ে পা দিয়ে কত কাছের মানুষ মিছেমিছি ঝগড়া বাঁধাতে এসেছে। আমি উত্তর দিইনি। ক্লান্ত হয়ে তারাই ফিরে গেছে। এতে আমার কোনো ক্ষতিও হয়নি। আমি দেখেছি, সব উন্মাদনার শেষ হয় শীতলতায়।
ছোটবেলায় আম্মার কাছে শিখেছি, ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় কোনো পক্ষই জেতে না। দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ সময় সবকিছু ঠিক করে দেয়। সময় সব ক্ষত মুছে দেয়। শুধু প্রয়োজন ধৈর্যের। আগে আম্মার ওপরে রাগ হতো৷ কেন আম্মা এভাবে বড় করেছেন আমাকে? আজ যত বড় হচ্ছি, ততই উপলব্ধি করছি, আম্মাই সঠিক ছিলেন। দুনিয়াতে কথা বলার মানুষের অভাব নেই। কিন্তু কথা শুনবার মানুষের বড়ই অভাব। কথা বলার চাতুর্য শিখতে পারিনি বলে আজ আমার আর কোনো দুঃখ নেই। জীবনের অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে এসে আমি শিখেছি, জীবনের প্রতিটি স্তরে শান্তির জন্য সহনশীলতার কোনো বিকল্প নেই। দিন শেষে ‘যে সয় সেই রয়’।