'জরুরি' বনাম 'গুরুত্বপূর্ণ' কাজ

আমেরিকার ৩৪তম প্রেসিডেন্ট আইজেন আওয়ার সময় ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বিখ্যাত পদ্ধতি দিয়ে গেছেন যেটাকে বলা হয় আইজেন আওয়ারের পদ্ধতি। সেটি খুবই চিরন্তন, সবার খুব কাজে লাগতে পারে। কিন্তু সবাই সেই পদ্ধতি হয়তো জানেন না।
আইজেন আওয়ারের এই পদ্ধতি বা সূত্রটি, ‘জরুরি বনাম গুরুত্বপূর্ণ’, ‘আইজেন আওয়ার ম্যাট্রিক্স’, ‘আইজেন আওয়ার নীতি’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এটা ব্যক্তিগত জীবন বা চাকরি/ব্যবসা বা বড় কোনো প্রকল্প, এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনা—সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
পৃথিবীতে সব মানুষের জন্য বরাদ্দ সময় এক। একটি দিন সবার জন্যই ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু কেউ ২৪ ঘণ্টায় অনেক বেশি এবং সার্থক কাজ সমাধা করে ফেলেন, কেউ তেমন কিছুই করতে পারেন না। কীভাবে কীভাবে যেন দিনটাই শেষ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে আইজেন আওয়ার খুব মূল্যবান একটি ব্যাপার সবাইকে দেখিয়ে দিলেন। ‘যা গুরুত্বপূর্ণ তা প্রায়শই জরুরি নয়, যা জরুরি তা সচরাচর গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
আমরা চুলচেরা বিচার করে একটি শব্দ ব্যবহার করি না। কাজেই ‘জরুরি’ এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দ দুটিকে সমার্থকও মনে হতে পারে। তিনি এই জরুরি আর গুরুত্বপূর্ণের ব্যবচ্ছেদ করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, কীভাবে সময় অপচয় হয়, কেন একজন দিনের ২৪ ঘণ্টায় অনেক কিছু করতে পারেন, আরেকজন ইচ্ছে সত্ত্বেও সেই ‘অনেক কিছু’ বাস্তবায়ন করতে পারেন না।
‘গুরুত্বপূর্ণ’ হলো যার দ্বারা আমাদের জীবনের লক্ষ্যগুলো সাধিত হয়। সুস্বাস্থ্য একটি লক্ষ্য হতে পারে। উচ্চশিক্ষা, মনের মতো চাকরি বা সেই চাকরিতে উন্নতি করা—এগুলো জীবনের লক্ষ্য হতে পারে। তাই এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ভালো একটি পরিবার গড়ে তোলা, সন্তানকে ভালো শিক্ষা দেওয়া, দেশের/দশের জন্য মঙ্গলজনক কিছু করা অথবা ধরা যাক একজন বড় চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চান, এসবও জীবনের লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা জরুরি নয়। জরুরি হলো, পাঁচটায় রফিকের সঙ্গে মোস্তফার হোটেলে চা খাওয়া, কারণ রফিক বসে আছে সেখানে, এর মধ্যে তিনবার মিস কল দিয়েছে। অবশ্য জরুরি কাজেরও গুরুত্ব থাকতে পারে।
জরুরির বলা সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, ‘এর দ্বারা নিজের লক্ষ্য পূরণ হয় না, অন্যের লক্ষ্য পূরণ হয়।’
একটা টেক্সটের উত্তর দেওয়া জরুরি। ফোন বাজলে সেটার উত্তর দেওয়া জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ‘জরুরি’ হয়ে আমাদের সামনে দেখা দেয় না, আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে না। সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাওয়া প্রয়োজন, সেটা কোনোভাবেই জরুরি হয়ে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে না। গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর আবার সময়সীমাও অনেক বেশি লম্বা, তাই সেগুলো এক্ষুনি করে ফেলা উচিত মনে হবে না।
আমরা দিনে যত জরুরি কাজ করি, তার সিংহভাগ গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটাই ডুয়াইট আইজেনআওয়ার বলেছেন।
জরুরি বনাম গুরুত্বপূর্ণ চতুষ্কোণ বলে একটি ছকও আছে। সেটা দেখলে ব্যাপারটি ভালো বোঝা যাবে। পরে এই চতুষ্কোণের চারটি ঘরের মধ্যে কোন ঘরের কাজটি কম বা বেশি করা উচিত, সেটাও গবেষকেরা যোগ করে দিয়েছেন।
যেকোনো কাজকে বা সমস্যাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়—
১. গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি
২. গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জরুরি নয়
৩. গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু জরুরি
৪. গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং জরুরিও নয়
ওপরের বিষয়ে কেউই দ্বিমত পোষণ করেন না এবং করতেও পারবেন না।
লক্ষণীয় যে, দ্বিতীয় নম্বরের কাজগুলো কেউই সহসা করতে করতে চান না। সেগুলো যারা করেন, তারাই সময়ের সদ্ব্যবহার করছেন, সময়কে কাজে লাগাচ্ছেন। দ্বিতীয় নম্বরের কাজগুলো মানুষ হেলাফেলা করে, কিন্তু এই কাজগুলোই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। একজন ছাত্র যদি পরীক্ষার জন্য ছয় মাস, এক বছর আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়, সেটা তখন দ্বিতীয় নম্বরে থাকছে, ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কিন্তু ‘জরুরি’ নয়। আবার সারা বছর পড়াশোনা না করলে, পরীক্ষার আগে আগে সেটাই এক নম্বরে চলে আসছে—‘গুরুত্বপূর্ণ’ এবং ‘জরুরি’। কিন্তু এক নম্বরের কাজ করে বেশি দূর এগোনো যাবে না। দুই নম্বররকে হেলাফেলা করার কারণেই সেগুলো সব এক নম্বরে চলে আসে, তখন উপায় কম থাকে।
তৃতীয় নম্বরের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, এসব কাজ সচরাচর অন্যের জন্য করা হয়ে থাকে। তেমনি চতুর্থ নম্বরের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ তাদের বাড়তি সময়টা কাটান।
প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কী খোশ গল্প, ফেসবুক, দিবানিদ্রা, টিভি দেখা, এসব বাদ দিতে হবে? তা নয়।
তবে মানুষ এবং অন্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো, একটি প্রাণী তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি ছাড়া কিছু করে না। মানুষ ভবিষ্যতের জন্য করে, তারা বিলম্বিত পরিতৃপ্তিতে যেতে পারে। মানুষ ইচ্ছা না থাকলেও দ্বিতীয় নম্বরের কাজগুলো বড় একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য করতে পারে। অন্যান্য প্রাণী শুধু জন্মগত স্বভাবে থাকলে তা পারে, নচেৎ পারে না।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে চার/পাঁচ বছরের শিশুদের ওপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়। সেটি ‘মার্শম্যালো পরীক্ষা’ নামে বিশ্বজুড়ে মনোবিজ্ঞানীদের কাছে খ্যাতি পেয়েছে। পরীক্ষাটা এমন—শিক্ষক শিশুদের একটি করে ক্যান্ডি দিলেন তারপর বললেন, তিনি ১৫ মিনিটের জন্য বাইরে যাচ্ছেন। এসে দেখবেন, যারা তখনো ক্যান্ডি খায়নি, তাদের আরেকটি ক্যান্ডি দেবেন, যারা খেয়ে ফেলেছে, তাদের আর দেওয়া হবে না। ১৫ মিনিট পরে এসে দেখলেন, প্রায় সবাই ক্যান্ডি খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু কয়েকটি শিশু তখনো কষ্ট করে অপেক্ষা করছে। তারা দুটা ক্যান্ডি পাওয়ার জন্য এই সাময়িক কষ্টটা মেনে নিতে পেরেছে। তারাই বিলম্বিত পরিতৃপ্তির দলে পড়ে। অন্যেরা তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি চেয়েছে।
এই দুই গ্রুপের শিশুদের নিয়ে পরবর্তীতে প্রায় ৪০ বছর গবেষণাটি চালানো হয়। দেখা যায় যারা ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে পেরেছে, তাদের পরীক্ষার ফলাফল, তাদের স্বাস্থ্য ভবিষ্যতের জীবনের এমন অনেক কিছুই অন্য দলটির থেকে অনেক ভালো হয়েছে।
আবার ফিরে আসি আইজেন আওয়ারের ছকে। জীবনে উন্নতি করতে হলে শুধু তিন আর চার নম্বরে পড়ে থাকলে চলবে না, প্রতিদিন কিছু সময় তালিকার দুই নম্বরকে (‘গুরুত্বপূর্ণ’ কিন্তু ‘জরুরি নয়’) দিতে হবে। ‘বিলম্বিত পরিতৃপ্তি’ ব্যাপারটাকে রপ্ত করতে হবে। তবেই নিজের, পরিবারের এবং সমাজের গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।